প্রথমে গাজ়া। তার পর লেবানন। গত এক বছরে ইরান সমর্থিত দুই জঙ্গি গোষ্ঠী ‘হামাস’ ও ‘হিজ়বুল্লা’-র বহু গুপ্তঘাঁটি উড়িয়ে দিয়েছে ইজ়রায়েল। শুধু তা-ই নয়, বেছে বেছে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের নেতাদের নিকেশ করছে ইহুদিদের গুপ্তচর সংস্থা ‘মোসাদ’। এই আবহে ই়জ়রায়েলের উপর ইরান ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানোয় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
সমর বিশ্লেষকদের দাবি, শিয়া দেশটির থেকে ইহুদিদের উপর এ ভাবে আক্রমণ নেমে আসায় পশ্চিম এশিয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। লড়াইয়ের ময়দানে একে অপরকে মাত দিতে, কোন কোন হাতিয়ার ব্যবহার করবে ইরান ও ইজ়রায়েল? এই নিয়ে ইতিমধ্যেই দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স’ সমীক্ষক সংস্থার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৪৫টি দেশের মধ্যে সামরিক শক্তিতে ইরানের স্থান ১৪তম। এর ঠিক তিন ধাপ পিছনে রয়েছে ইজ়রায়েল। অর্থাৎ ফৌজি শক্তিতে ইহুদিদের স্থান ১৭।
চলতি বছরের ১ অক্টোবর ইহুদি দেশটির উপর ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় ইরান। এই ধরনের হামলা আটকানোর জন্য ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের হাতে রয়েছে একাধিক স্তরের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। যা দিয়ে তেহরানের এই আক্রমণ ঠেকিয়েছে ইহুদি ফৌজ। ইরান মোট ১৮১টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে বলে দাবি করেছে ইজ়রায়েল।
ইজ়রায়েলকে প্যাঁচে ফেলতে তাঁদের তৈরি একাধিক জঙ্গি সংগঠনকে কাজে লাগাচ্ছে ইরান। যার মধ্যে গাজ়ার হামাস ও লেবাননের হিজ়বুল্লা ছাড়াও রয়েছে ইয়েমেনের হুথিরা। তেহরান এই সন্ত্রাসবাদীদের হাতে যে আগামী দিনে আরও বেশি হাতিয়ার তুলে দেবে, তা বলাই বাহুল্য। সকলে একসঙ্গে ইহুদিদের উপর হামলা চালালে একাধিক ফ্রন্টে লড়তে হবে ইজ়রায়েলকে। যা সামলানো বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকারের পক্ষে কঠিন হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
সূত্রের খবর, ইহুদিদের ধ্বংস করতে ইরানের হাতে রয়েছে ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ়, দু’ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র। যার প্রথমেই আসবে ‘শাহাব’-এর নাম। ৩০০ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ২,৫০০ কিলোমিটার পাল্লার এই ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটির একাধিক ধরন রয়েছে। এর মধ্যে ছোট ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরান থেকে সরাসরি ইজ়রায়েলের উপর হামলা করা সম্ভব নয়। কারণ এগুলির পাল্লা ৩০০ থেকে ৭০০ কিলোমিটার।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, হামাস ও হিজ়বুল্লার মতো জঙ্গি সংগঠনকে ব্যবহার করে ছোট ও মাঝারি পাল্লার শাহাব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইহুদি-ভূমিতে হামলা চালাবে তেহরান। তবে এর ২,৫০০ কিলোমিটার পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি দিয়ে নিজেদের জমি থেকে ইজ়রায়েলকে নিশানা করতে পারবে পশ্চিম এশিয়ার এই শিয়া দেশ।
শাহাবকে বাদ দিলে ইরানের অস্ত্রাগারে থাকা ছোট পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে নাম আসবে ‘জোলফা’র’-র নাম। ৭০০ কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েও তেহরান থেকে নেতানিয়াহুর দেশে হামলা চালানো সম্ভব নয়। তাই এগুলিও জঙ্গিদের হাতে তুলে দিতে পারে পশ্চিম এশিয়ার এই শিয়া দেশ।
ইরানি তৃতীয় যে ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইহুদিদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে তা হল ‘কিয়াম-১’। এর পাল্লা ৭৫০ কিলোমিটার। এটির সাহায্যে তেহরানে বসেই ইজ়রায়েলকে নিশানা করতে পারবে শিয়া ফৌজ। কিন্তু কিয়াম-১ ইহুদিদের দেশের খুব ভিতরে ঢুকে হামলা চালাতে পারবে না। সীমান্ত এলাকায় বড় লোকসান করানোর ক্ষমতা রয়েছে এই ক্ষেপণাস্ত্রের।
অন্য দিকে ইরানের এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে ইহুদিদের কাছে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যা ব্যবহার করে মাঝ আকাশেই শত্রু ক্ষেপণাস্ত্রকে উড়িয়ে দিতে পারে আইডিএফ। গত এক বছরে বহু বার যা প্রত্যক্ষ করেছে গোটা দুনিয়া।
ইহুদিদের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের তিন থেকে চারটি স্তর রয়েছে। একেবারে প্রথম স্তরে রয়েছে ‘আয়রন ডোম’। যা ছোট পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে সক্ষম। এর পিছনে থাকে ‘ডেভিডস্ স্লিং’। যাকে এড়িয়ে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের ইজ়রায়েলের উপর আছড়ে পড়ার আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে। মাঝ আকাশে ৩০০ থেকে ৭০০ কিলোমিটার পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অনায়াসেই ধ্বংস করে দেয় ডেভিডস্ স্লিং।
ইজ়রায়েলের এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের একেবারে শেষ স্তরে আছে ‘অ্যারো’। যা ব্যবহার করে ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আটকায় আইডিএফ। বায়ুমণ্ডলের বাইরে থেকে আসা ক্ষেপণাস্ত্রকে আঘাত হানার আগেই ধ্বংস করতে পারে অ্যারো।
আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস বা আইআরজিসি পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে বড় সৈন্যবাহিনী, যাতে রয়েছে ৫ লক্ষ ৮০ হাজার সৈনিক। এ ছাড়াও দু’লক্ষ রিজার্ভ বাহিনী রয়েছে তেহরানের হাতে।
বাহিনীর নিরিখে ইজ়রায়েলি ফৌজ অনেক ছোট। স্থল-নৌ-বায়ু সেনা মিলিয়ে আইডিএফে কর্মরত রয়েছেন ১ লক্ষ ৬৯ হাজার ৫০০ জন সৈনিক। এর রিজার্ভ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার। ইহুদিদের আধাসেনার সংখ্যা প্রায় আট হাজার।
বায়ুসেনার দিক দিয়ে বিচার করলে অবশ্য তেহরানের থেকে এগিয়ে রয়েছে নেতানিয়াহুর ফৌজ। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্সের সমীক্ষা অনুযায়ী, ইজ়রায়েলের কাছে আছে ৬১২টি যুদ্ধবিমান। ৫৫১টি জেট রয়েছে ইরানি বায়ুসেনার কাছে। তবে ইহুদিদের কাছে আমেরিকার তৈরি এফ-১৫, এফ-১৬ ও এফ-৩৫র মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান রয়েছে। যা ইরানের কাছে নেই।
ইজ়রায়েলের আক্রমণ ঠেকাতে রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবহার করে আইআরজিসি। কয়েক মাস আগেই যার একটি ইউনিট ধ্বংস করেছিল ইহুদি বায়ুসেনা। ইজ়রায়েলের কোনও যুদ্ধবিমানই ওই সময়ে গুলি করে নামাতে পারেনি শিয়া ফৌজ।
দুই দেশের অস্ত্রাগারেই রয়েছে বিপুল সংখ্যায় ড্রোন। ইউক্রেন ফৌজকে নাস্তানাবুদ করতে ইরানের তৈরি ‘শাহেদ ১৩৬’ মানববিহীন উড়ুক্কু যানের ব্যাপক ব্যবহার করছে রাশিয়া। অন্য দিকে, হার্মিস-৯০০ ও হেরনের মতো উন্নত ড্রোন ব্যবহার করে ইহুদি সেনা।
ট্যাঙ্কের সংখ্যার দিক থেকে ইরান-ইজ়রায়েলের মধ্যে পার্থক্য উনিশ-বিশ। ১ হাজার ৩৭০টি ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে আইডিএফ। আর আইআরজিসির ট্যাঙ্কের সংখ্যা ১ হাজার ৯৯৬। তবে ইহুদি ফৌজে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ‘মেরকাভা’ ট্যাঙ্ক।
ইহুদি ও শিয়া সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের সংখ্যাও তুল্যমূল্য। ইজ়রায়েল ১৪৬টি কপ্টারের মধ্যে ৪৮টি যুদ্ধে ব্যবহার করে। ইরানের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা যথাক্রমে ১২৯ ও ১৩। শিয়া ফৌজ ব্যবহার করে ৬৫ হাজার ৭৬৫টি সাঁজ়োয়া গাড়ি। আর আইডিএফের কাছে সাঁজ়োয়া গাড়ি রয়েছে ৪৩ হাজার ৪০৩টি।
ছোট-বড় মিলিয়ে ইরানের হাতে রয়েছে শতাধিক যুদ্ধজাহাজ। ইজ়রায়েলের যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা ৬৫। ডুবোজাহাজের নিরিখে ইহুদিদের থেকে এগিয়ে রয়েছে শিয়া ফৌজ। আইআরজিসির ডুবোজাহাজের সংখ্যা ১৯। আর আইডিএফ ব্যবহার করে মাত্র ৫টি ডুবোজাহাজ।
তবে ইজ়রায়েল পরমাণু শক্তিধর দেশ। যা নেই ইরানের কাছে। দ্বিতীয়ত, আমেরিকা-সহ ইউরোপের বহু রাষ্ট্র সরাসরি ইহুদিদের পাশে রয়েছে। ইরান ইসলামীয় দেশগুলির সমর্থন পেতে চাইছে। যা শেষ পর্যন্ত তেহরান জোগাড় করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।