পশ্চিম এশিয়া জুড়ে ঘনিয়েছে যুদ্ধের মেঘ। হামলা-পাল্টা হামলায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। ইরানের মদতপুষ্ট লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী হিজ়বুল্লার সঙ্গে ইজ়রায়েলের সংঘাতের মধ্যেই ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েলে। ইরানকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইজ়রায়েল থেকে আমেরিকা। ইজ়রায়েলের বার্তা, ‘ইরান সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে’।
ইরানের ১৮০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার জবাবে ইজ়রায়েল জানিয়েছে, তারা চুপ করে বসে দেখবে না। ইরান যা করেছে, তার যথাযোগ্য ‘জবাব’ তারা পাবেই।
গত বছর অক্টোবর থেকে সংঘাতে জড়িয়েছে প্যালেস্টাইনি গোষ্ঠী হামাস এবং ইজ়রায়েল। সেই সময় হামাসের সমর্থনে নেমে ইজ়রায়েলে ঘন ঘন হামলা চালাতে থাকে হিজ়বুল্লা। সম্প্রতি হিজ়বুল্লার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে ইজ়রায়েল। লেবাননে হিজ়বুল্লার একের পর এক ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছে। হিজ়বুল্লার একাধিক কম্যান্ডার নিহত। লেবাননে প্রায় ৭০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হিজ়বুল্লার সমর্থনে মঙ্গলবার দিনভর ইজ়রায়েলের বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান।
তেহরানের দাবি, তারা তেল আভিভের কাছে তিনটি সামরিক ঘাঁটিকে নিশানা করেছে। এ ছাড়াও ইজ়রায়েলি বিমানঘাঁটি, গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের অফিসেও হামলা চালিয়েছে তারা।
ইরানের ‘ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড’-এর দাবি, তাদের ছোড়া ৯০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র নিশানায় গিয়ে পড়েছে। তবে ইজ়রায়েলি কর্তৃপক্ষ সগর্বে জানিয়েছেন, শত্রুর ছোড়া বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্রই আটকে দিয়েছে তাদের আকাশ নিরাপত্তা প্রযুক্তি আয়রন ডোম। এ পর্যন্ত কোনও ইজ়রায়েলির মৃত্যুর খবর নেই।
এর পরেই পাল্টা দেখে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইজ়রায়েল। এই পরিস্থিতিতে মনে করা হচ্ছে, ইজ়রায়েলের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একটি বিবৃতি সে দেশের সরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। তাতে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, এ বার নিশানা খামেনেই।
তাই কূটনীতিবিদদের আশঙ্কা, যে কোনও মুহূর্তে বড় আকারে যুদ্ধের ডঙ্কা বেজে উঠতে পারে পশ্চিম এশিয়ায়। সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে পারে ইরান এবং ইজ়রায়েল।
এই পরিস্থিতিতে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন শক্তিধরেরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে এবং এই মুহূর্তে কে কোন দেশের পাশে দাঁড়িয়েছে।
বিখ্যাত ‘এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’ বা আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’-এর সাহায্যে গত বছরের অক্টোবর থেকে বহুমুখী লড়াই লড়ছে ইজ়রায়েল। গাজ়া উপত্যকায় হামাস, লেবাননের হিজ়বুল্লা এবং ইয়েমেনের বিদ্রোহী শিয়া গোষ্ঠী হুথি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে এক যোগে।
ইজ়রায়েল এই লড়াইয়ে বন্ধু হিসাবে পেয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জর্ডন এবং সৌদি আরবকে। তাদের বিপক্ষে— হামাস, ইরান, হিজবুল্লা এবং হুথি।
অতীতে ইজ়রায়েলের সঙ্গে একাধিক বার ছায়াযুদ্ধ হয়েছে ইরানের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নজিরবিহীন পদক্ষেপে সরাসরি একে অপরের দিকে হামলা-পাল্টা হামলা শুরু করেছে এই দুই দেশ। হিজ়বুল্লা প্রধান হাসান নাসরাল্লার হত্যা এবং তেহরানে হামাসের শীর্ষনেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে মঙ্গলবার ইজ়রায়েলে প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান।
উল্লেখ্য, মাস কয়েক আগেই ইরানি দূতাবাসের চত্বরে হামলার পর ইজ়রায়েলে ১৭০টি বিস্ফোরক-বোঝাই ড্রোন এবং ১২০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় ইরান। এর পর আবার মঙ্গলবারের ক্ষেপণাস্ত্র হানা। পাশাপাশি, ইজ়রায়েলকে কোণঠাসা করতে পশ্চিম এশিয়ায় বন্ধু দেশগুলিকে একজোট করতে উদ্যত হয়েছে ইরান।
ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে ইরান পাশে পেয়েছে ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ এবং হামাসকে। প্রতিরোধের অক্ষ হল পশ্চিম এশিয়ায় ইরান সমর্থিত সশস্ত্র এবং রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলির একটি নেটওয়ার্ক, যা তৈরিও করেছে ইরান। ইজ়রায়েল এবং আমেরিকাকে শত্রু হিসাবে মনে করে এই গোষ্ঠী।
তবে ইরান এবং তার বন্ধুদের এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রয়েছে ইজ়রায়েল, আমেরিকা এবং সৌদি আরব।
ইজ়রায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে সৌদি আরব। এক দিকে যেখানে ইজ়রায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিল সৌদি আরব, তেমনই এ বছরের এপ্রিলে ইরান যে ইজ়রায়েলে হামলা চালাতে পারে সে খবরও নাকি বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকারের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল সৌদি আরবই।
ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইজ়রায়েল এবং হামাসের মধ্যে সংঘর্ষে মধ্যস্থতায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে কাতার। গত বছরের নভেম্বরে হামাসের হাতে অপহৃত ইজ়রায়েলিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য মধ্যস্থতা করেছিল পশ্চিম এশিয়ার এই দেশ। উল্লেখ্য, নিহত হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকেও আশ্রয় দিয়েছিল কাতার। ইরানের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে সে দেশের যা ইজ়রায়েলের অপছন্দ। তবে পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি রয়েছে কাতারেই।
সৌদি আরবের মতো কূটনৈতিক টানাপড়েনে আটকে জর্ডনও। এ বছরের জানুয়ারিতে ইরান-সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীরা জর্ডনে থাকা আমেরিকার সেনাঘাঁটিতে হামলার পর সে দেশও জড়িয়ে পড়েছে এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে।
এক দিকে যেমন জর্ডন গাজ়ায় সাহায্য পাঠিয়েছে, অন্য দিকে, ইজ়রায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও বজায় রেখেছে। ১৯৯৪ সালে ইজ়রায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল জর্ডন। এপ্রিল মাসে, ইরান থেকে ইজ়রায়েলের দিকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলে জর্ডনই।
১৯৭৯ সালে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে মিশর এবং প্রতিবেশী ইজ়রায়েলের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা খারাপ হয়নি। সংঘাতের পর থেকে মিশর স্পষ্ট ভাবে কোনও পক্ষকে সমর্থন না করলেও গত মে মাসে ইজ়রায়েলি সেনা গাজ়া এবং মিশরের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রাফা সীমান্ত এলাকা দখল করার পর থেকে ইজ়রায়েলের সঙ্গে মিশরের সম্পর্কে সামান্য টানাপড়েন তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সিরিয়া এবং ইরাক— ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল বলে ধরা হয় এই দু’টি দেশকে। ইরাকে থাকা আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিতে কয়েক ডজন হামলা চালিয়েছে সেই গোষ্ঠীগুলি। বেশ কয়েকটি ইরাকি সশস্ত্র গোষ্ঠী আমেরিকার ঘাঁটিতে হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যদি আমেরিকা ইজ়রায়েলের উপর ইরানের হামলার প্রতিশোধ নেয় বা ইজ়রায়েল যদি তেহরানের বিরুদ্ধে হামলায় ইরাকের আকাশসীমা ব্যবহার করে তা হলে ছেড়ে কথা বলা হবে না বলেই জানিয়েছে ইরাক।
তুরস্ক এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে সম্পর্ক এক সময় উষ্ণ থাকলেও বর্তমানে সেই সম্পর্ক চিড় ধরেছে। এ বছরের শুরুর দিকে তুরস্ক দাবি করেছিল ইজ়রায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের ৩০ জনকে গ্রেফতার করেছে তারা। যা নিয়ে দু’দেশের সম্পর্কে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি, গাজ়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েক জন আহত প্যালেস্টাইনিকে চিকিৎসার জন্য এয়ারলিফ্ট করেছে তুরস্ক।
সব ছবি: সংগৃহীত।