নামের মধ্যেই লুকিয়ে রোমাঞ্চ। ‘আই লভ ইউ’-এর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল এক মারাত্মক ভাইরাস। ভালবাসার ছদ্মবেশে এসে গোটা পৃথিবীর কম্পিউটার সিস্টেমকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
২০০০ সালের ৪ মে মাসে তৈরি হয়েছিল ‘আই লভ ইউ’ বা লাভ বাগ নামে পৃথিবীর অন্যতম ভয়ঙ্কর ইমেল ভাইরাস। ফিলিপিন্সকেই এই ভাইরাসের জন্মস্থান বলে ধরা হয়ে থাকে।
ফিলিপিন্সের ২৪ বছর বয়সি ছাত্র ওনেল ডি গুজ়ম্যানের মস্তিষ্কপ্রসূত এই বিধ্বংসী ইমেল ভাইরাসটি।
লক্ষ লক্ষ কম্পিউটারকে সংক্রামিত করার ২০ বছর পরে কৃতকর্ম স্বীকার করে নেন ওনেল। ৪৪ বছর বয়সি এই ফিলিপিনো অবশ্য জানিয়েছিলেন এটি বিশ্ব জুড়ে ছড়ানোর কোনও উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না।
তাঁর তৈরি কোডের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে সে জন্যও তিনি অনুতপ্ত। ফিলিপিন্সের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই ভাইরাস আমেরিকা বা ইউরোপে পৌঁছে যাবে তা ঘুণাক্ষরেও নাকি টের পাননি ওনেল।
বিবিসির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাসওয়ার্ড চুরি করার জন্য ‘লভ বাগ’ কম্পিউটার ভাইরাসটি বার করেছিলেন, যাতে তিনি বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন।
ওনেল ডি গুজ়ম্যানকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ঘটনার পর পরই। সে সময় কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের জন্য ফিলিপিন্সে কোনও আইন ছিল না এবং গুজ়ম্যান-সহ কাউকেই এ জন্য অভিযুক্ত করা হয়নি।
২০০০ সালের মে মাসের একটি সকাল। ‘আই লভ ইউ’ লেখা বিশেষ বার্তা ছড়াতে থাকে ইন্টারনেটে, ইমেলের মাধ্যমে। প্রথমে ফিলিপিন্স, তার পর হংকং থেকে ইউরোপের একাধিক দেশে। এবং সবশেষে আমেরিকায়।
মাইক্রোসফ্ট ছাড়াও গাড়ি নির্মাতা সংস্থা ফোর্ড (এফ) এবং রিয়্যাল এস্টেট সংস্থা মেরিল লিঞ্চ থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দফতর পেন্টাগন এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কম্পিউটারের সিস্টেমে হানা দেয় ‘লভ বাগ’টি।
ইতিহাসে এর থেকে ভয়ঙ্কর ভাইরাস নাকি আসেনি, এমনই দাবি করেন কম্পিউটার বিশেষ়জ্ঞদের একাংশ। এর ফলে প্রায় ৪২ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়তে হয় গোটা বিশ্বের তাবড় সংস্থাগুলিকে।
ফোটোগ্রাফ, অডিয়ো ফাইল এবং নথি-সহ সব ধরনের ফাইল ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে এই মারাত্মক ভাইরাসটি। উইন্ডোজ় অপারেটিং সিস্টেমচালিত এক কোটিরও বেশি কম্পিউটারকে আক্রমণ করেছিল এই ভাইরাস।
‘আপনার জন্য ভালবাসার বার্তা আছে’, খুবই অদ্ভুত পন্থায় এই শিরোনামে একটি সংযুক্ত ফাইল পাঠানো হত। এটি ব্যবহারকারীকে ইমেলের ফাইল খুলতে প্ররোচিত করত।
ফাইলটিতে ছিল ভাইরাস কোড, যা প্রথমে কম্পিউটারটিকে সম্পূর্ণ অকেজো করে দিত। তার পর বিভিন্ন ফাইল নতুন করে লিখে দিত।
ভাইরাসটির নিজের প্রতিচ্ছবি তৈরি করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা ছিল। মাইক্রোসফ্ট আউটলুকে থাকা সব ঠিকানায় স্বয়ংক্রিয় ইমেল পাঠাতে শুরু করত এটি।
ফিলিপিন্সের আন্ডারওয়ার্ল্ডের ফোরামে এক জন গ্রাহক ২০১৬ সালে দাবি করেছিলেন যে, এই ভাইরাসের জনক ডি গুজ়ম্যান ম্যানিলার কুয়াপো জেলায় একটি মোবাইল ফোন মেরামতির দোকান চালান।
বহু খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে সন্ধান মেলে ওনেলের। বেশ কয়েক ঘণ্টা খোঁজার পর ম্যানিলার একটি শপিং মলে একটি ঘুপচি ও অগোছালো স্টলে দেখা মেলে একদা ত্রাস সৃষ্টি করা এই হ্যাকারের।
ঘটনার পর ২৪ বছর অতিক্রান্ত। আজও এই ভাইরাসের নাম শুনলে বুক কেঁপে ওঠে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞদের। বাড়ির সাধারণ কম্পিউটার থেকে পেন্টাগনের সুপার কম্পিউটার, কেউই এই ভাইরাসের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
সব ছবি: সংগৃহীত।