ইরান মদতপুষ্ট লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজ়বুল্লার কোমর ভাঙতে উঠে পড়ে লেগেছে ইজ়রায়েল। এ বার তাতে বড় সাফল্য পেল ইহুদি সেনা। শিয়াপন্থী এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের প্রধান সৈয়দ হাসান নাসরাল্লাকে খতম করল বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ফৌজ।
শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ইজ়রায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র নাদভ শোশানি এই সাফল্যের কথা জানিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘হাসান নাসরাল্লা নিহত’’।
ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) থেকেই ৬৪ বছরের হিজ়বুল্লা প্রধানের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে দিতে সমাজমাধ্যমে আলাদা করে একটি পোস্ট দিয়েছে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ।
এক্স হ্যান্ডেলে আইডিএফ লিখেছে, ‘‘হাসান নাসরাল্লা আর কখনওই বিশ্বকে সন্ত্রাসবাদের ভয় দেখাতে পারবেন না।’’ লেবাননের রাজধানী বেইরুটেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত কয়েক দিন ধরেই উত্তরের প্রতিবেশী দেশটির পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তে মারাত্মক বোমাবর্ষণ চালিয়েছে ইহুদি বায়ুসেনা। বাদ যায়নি রাজধানী বেইরুটের দক্ষিণ অংশ। এই এলাকাগুলি হিজ়বুল্লার শক্তি ঘাঁটি বলে পরিচিত।
লেবাননের রাজনীতিতে নাসরাল্লার প্রভাব ছিল প্রশ্নাতীত। পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির জনগোষ্ঠীর একাংশের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বা সংঘর্ষের সময়ে মধ্যস্থতা করা, দু’টি ক্ষমতাই ছিল নাসরাল্লার।
দক্ষিণ বেইরুটে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনার ভয়ানক বোমাবর্ষণে নাসরাল্লার কন্যা জায়নাবের মৃত্যু হয়েছে বলেও দাবি করেছে ইহুদি সংবাদমাধ্যম। যদিও লেবানন বা হিজ়বুল্লার তরফে এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
ইহুদি সেনার হাতে শিয়াপন্থী এই জঙ্গিনেতার মৃত্যুর খবর এ বারই যে প্রথম এল এমনটা নয়। ২০০৬ সালে ইজ়রায়েল-লেবানন যুদ্ধের সময়ে তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছিল। কিন্তু সংঘর্ষ থামতেই গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসেন নাসরাল্লা। তার গায়ে যে ইহুদিরা আঁচড়টি কাটতে পারেনি, তা তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
প্রায় তিন দশক (প্রায় ৩২ বছর) ধরে ইরানের মদতপুষ্ট সশস্ত্র সংগঠন হিজ়বুল্লার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন হাসান নাসরাল্লা। সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেলের পদ সামলাতেন তিনি।
১৯৬০ সালে দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় নাসরাল্লার। ছোটবেলায় ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। হিজ়বু্ল্লায় যোগ দেওয়ার আগে জড়িয়ে পড়েন শিয়াদের আন্দোলনে।
শিয়াদের আন্দোলন চলাকালীন আধা সামরিক সংগঠনে যোগ দেন নাসরাল্লা। এর পর বিদ্যুৎ গতিতে উত্থান হতে থাকে তাঁর। ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে হিজ়বুল্লা তৈরি হলে সশস্ত্র সংগঠনের শীর্ষপদে চলে আসেন তিনি।
১৯৯৭ সালে হিজ়বুল্লাকে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করে আমেরিকা। তখন এই সংগঠনের মাথায় ছিলেন নাসরাল্লা। ওই সময়ে সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছিল তাঁর।
হিজ়বুল্লার জন্মদাতা ইরানি সেনাবাহিনী (পড়ুন ইরান রেভলিউশনারি গার্ড) ১৯৮২ সালে এই সংগঠনের জঙ্গি যোদ্ধাদের লেবাননে পাঠিয়েছিল। ওই বছরে ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় পশ্চিম এশিয়ার এই দেশ। হিজ়বুল্লাকে দিয়ে ইহুদি সেনাকে পাল্টা মার দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল ইরান।
২০০০ সালে প্রায় ১৮ বছর পর দক্ষিণ লেবাননের দখল করা এলাকা থেকে বাহিনী সরিয়ে নেয় ইজ়রায়েল। ইহুদিদের এতে রাজি করানোর পিছনে নাসরাল্লার বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা।
এর ছ’বছরের মাথায় ২০০৬ সালে ফের ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় হিজ়বুল্লা। যা ৩৪ দিন ধরে চলেছিল। ওই সংঘর্ষের কোনও জয়-পরাজয় হয়নি। ফলে একে ‘ঐশ্বরিক বিজয়’ বলে মনে করে এই সংগঠন। যার নেপথ্যে নাসরাল্লার মস্তিষ্কই কাজ করেছিল বলে দাবি গোয়েন্দাদের।
গত বছরের ৭ অক্টোবর প্যালেস্টাইনের গাজ়া স্ট্রিপ থেকে ইজ়রায়েলের উপর ভয়ঙ্কর হামলা চালায় ইরান সমর্থিত হামাস নামের আর এক সশস্ত্র সংগঠন। ইহুদি দেশে ঢুকে নির্বিচারে হত্যালীলা চালায় তারা। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েক জনকে অপহরণ করে গাজ়ায় নিয়েও যায় হামাসের সদস্যেরা।
ওই ঘটনার পর হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। গাজ়ায় সংঘর্ষ শুরু হতেই ইহুদিদের বেকায়দায় ফেলতে তাঁদের সেনা পোস্টে লেবাননের দিক থেকে হামলা শুরু করে হিজ়বুল্লা।
চলতি বছরের পয়লা অগস্ট শিয়া জঙ্গি সংগঠনের প্রধান নাসরাল্লা বলেন, ‘‘আমাদের এখন প্যালেস্টাইনবাসীর পাশে দাঁড়াতে হবে। সেখানকার জনগণকে রক্ষার জন্য আমাদের মূল্য দিতে হবে।’’
ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধ চলাকালীন নাসরাল্লাহ আরও দাবি করেন, ইহুদিরা যুদ্ধ বন্ধ না করলে কোনও অবস্থাতেই হিজ়বুল্লা পিছু হটবে না। বরং ইজ়রায়েলের উপর হামলা অব্যাহত থাকবে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর বেইরুটে ইহুদি বায়ুসেনার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হিজ়বুল্লার দুই কমান্ডারের মৃত্যু হয়। এ বার নাসরাল্লার সঙ্গে আলি কারাকে নামের আরও এক কমান্ডারের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এই জঙ্গি যোদ্ধা দক্ষিণ ফ্রন্টে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, এ ভাবে একের পর এক নেতা ও কমান্ডারকে উড়িয়ে দিয়ে হিজ়বুল্লাকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে ইজ়রায়েল। এই আবহে এ বার লেবাননে আইডিএফ গ্রাউন্ড অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে স্পষ্ট করেছেন ইহুদি দেশগুলির সেনাকর্তারা।
সম্প্রতি দু’পক্ষকে ২১ দিনের জন্য যুদ্ধ বন্ধ রাখার আর্জি জানিয়েছিল আমেরিকা ও ফ্রান্স। যা পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
সব ছবি: সংগৃহীত।