হু-হু করে কমছে বৈদ্যুতিন গাড়ির (ইলেকট্রিক ভেহিকল বা ইভি) চাহিদা। ব্যাটারিচালিত ইঞ্জিনের কথা শুনলে হঠাৎই নাক সিঁটকোচ্ছেন গাড়িপ্রেমীদের বড় অংশ। ফলে সঙ্কটের মুখে পড়েছে চিনের গাড়ি নির্মাণশিল্প। বলা বাহুল্য, এতে বেশ খানিকটা ধাক্কা খেয়েছে বেজিঙের অর্থনীতি। এই ইস্যুতে ড্রাগন-সরকারেরও বাড়ছে চিন্তা।
হঠাৎ করে বৈদ্যুতিন গাড়ির বিক্রি কমে যাওয়ায় সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছে নির্মাণকারী সংস্থাগুলির সংগঠন ‘চায়না প্যাসেঞ্জার কার অ্যাসোসিয়েশন’ (সিপিসিএ)। তাদের দাবি, চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) প্রথম ১২ দিনে পুরোপুরি বৈদ্যুতিন এবং হাইব্রিড মডেলের গাড়ি বিক্রির সূচক ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের নিরিখে ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছে।
মূলত দু’ধরনের বৈদ্যুতিন গাড়ি উৎপাদন করে চিন। একটি হল, পুরোপুরি ব্যাটারিচালিত ইঞ্জিনের চারচাকা। দ্বিতীয় শ্রেণিতে রয়েছে, ব্যাটারি এবং জ্বালানি দু’ভাবেই চালানো যায় এমন গাড়ি। এগুলিরই পোশাকি নাম হাইব্রিড মডেল। দ্বিতীয় শ্রেণির এই গাড়ির চাহিদা বরাবরই বেশি ছিল বলে জানিয়েছে বেজিঙের নির্মাণকারী সংস্থাগুলির সংগঠন।
‘চায়না প্যাসেঞ্জার কার অ্যাসোসিয়েশন’-এর তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের (পড়ুন ২০২৫) জানুয়ারির প্রথম ১২ দিনে সম্পূর্ণ ব্যাটারিচালিত এবং হাইব্রিড মডেলের গাড়ি বিক্রির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২.০৬ লক্ষ। কিন্তু গত বছর (পড়ুন ২০২৪) এই ধরনের গাড়ি বিক্রিতে ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল। নতুন বছরের গোড়াতেই সূচক নিম্নমুখী হওয়ায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন চিনের গাড়ি নির্মাণশিল্পের কর্তারা।
ড্রাগনভূমিতে ইভি বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন সাংহাইয়ের বিশ্লেষক গাও শেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘আগে বৈদ্যুতিন গাড়িতে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছিল সরকার। কিন্তু পর্যায়ক্রমে সেটা বন্ধ করা হয়েছে। জানুয়ারিতে বিক্রির সূচক নিম্নমুখী হওয়ার সেটাই সবচেয়ে বড় কারণ।’’ ইভির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেলেও এর বাজার অস্থির থাকবে বলেও দাবি করেছেন তিনি।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) জুলাই মাসে বৈদ্যুতিন গাড়িতে ভর্তুকির পরিমাণ দ্বিগুণ করে চিনের শি জিনপিং সরকার। ফলে প্রতিটি ইভিতে ২০ হাজার ইয়েন বা ২,৭২৯ ডলার করে ছাড় পাচ্ছিলেন ক্রেতারা। ভারতীয় মুদ্রায় টাকার অঙ্কটি প্রায় ২.৩৬ লক্ষ টাকা।
জিনপিং সরকার ইভি কেনার ক্ষেত্রে এই ছাড় তিন মাসের জন্য ঘোষণা করেছিল। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ৩১ ডিসেম্বর এটি বন্ধ করে দেয় বেজিং সরকার। ছাড়ের নিয়ম বন্ধ হতেই ক্রেতারা বৈদ্যুতিন গাড়ির থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেন, জানিয়েছেন সাংহাইয়ের বিশ্লেষক গাও শেন।
সিপিসিএ-এর জারি করা তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে চিন জুড়ে গাড়ির শোরুমগুলিতে সরবরাহ করা মোট ইভির সংখ্যা ছিল ১৩ লক্ষ ৮০ হাজার। নভেম্বরের তুলনায় বছরের শেষ মাসে ১০ শতাংশ বেশি বৈদ্যুতিন গাড়ি শোরুমগুলিতে পাঠানো হয়েছিল। কারণ, ওই সময়ে তুঙ্গে উঠেছিল ইভির চাহিদা।
এ বছরের (পড়ুন ২০২৫) ৮ জানুয়ারি বৈদ্যুতিন গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থাগুলিকে উৎসাহ দিতে ভর্তুকি বজায় রাখার কথা ঘোষণা করে চিনের জাতীয় উন্নয়ন এবং সংস্কার কমিশন। এতে বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের তথা আমেরিকার শিল্পপতি ইলন মাস্কের সংস্থা ‘টেসলা’ লাভবান হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ। ভর্তুকি বজায় থাকায় সুবিধা হয়েছে ইভি প্রস্তুতিকারী সংস্থা ‘বিওয়াইডি’-রও।
সিপিসিএ-র শীর্ষ পদাধিকারীরা বলেছেন, ‘‘ইভি বিক্রির লেখচিত্রকে ঊর্ধ্বমুখী করতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ফের ক্রেতাদের জন্য ভর্তুকির ঘোষণা করবেন বলে আমরা আশাবাদী। বৈদ্যুতিন গাড়িকে আরও জনপ্রিয় করতে ভোক্তাদের কথা ভেবে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে এই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন।’’
গত বছর (পড়ুন ২০২৪) চিনের বিভিন্ন প্রদেশের স্থানীয় সরকারগুলি ইভিকে জনপ্রিয় করতে গাড়িপিছু ১৫ হাজার ইয়েন করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। শুধু তা-ই নয়, পুরোপুরি নগদ টাকায় বৈদ্যুতিন গাড়ি কিনলে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছিল সরকার।
মূল চিনা ভূখণ্ডে যে সমস্ত ইভি বিক্রি হয়, এক থেকে দু’লক্ষ ইয়েনের মধ্যে ঘোরাফেরা করে সেগুলির দাম। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) জুলাই থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বৈদ্যুতিন গাড়ির চাহিদা ড্রাগনভূমিতে বাড়তে শুরু করে। একটা সময়ে এর বিক্রি ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু সরকারি ভর্তুকি নীতির জেরে চিনা ইভি শিল্প যে দুর্দান্ত লাভের মুখ দেখেছে এমনটা নয়।
সিপিসিএ জানিয়েছে, ইভি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির মধ্যে বর্তমানে মাত্র তিনটি সংস্থা লাভে চলছে। সেগুলি হল, বিওয়াইডি, লি অটো এবং হুয়াওয়ে টেকনোলজিস।
গত বছরের শেষ দিকে হাইব্রিড মডেলের ইভির দাম হ্রাস করে দুনিয়ার অন্যতম বড় ইভি প্রস্তুতকারী চিনা সংস্থা বিওয়াই়ডি। সিলিয়ন-০৫ মডেলের বৈদ্যুতিন এসইউভির দাম ১১.৫ শতাংশ কমিয়ে দেয় তারা। ফলে ড্রাগনভূমিতে ওই গাড়িটির দর কমে দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ৮০০ ইয়েন। কিন্তু তার পরও এর বিক্রি কমেছে বলে জানা গিয়েছে।
বৈদ্যুতিন গাড়ির বিক্রি বাড়াতে একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাস্কের সংস্থা টেসলাও। সাংহাইতে তৈরি ‘ওয়াই’ এসইউভির দাম ১০ হাজার ইয়েন কমিয়েছে তারা। ফলে বর্তমানে এর বিক্রয়মূল্য চিনা মুদ্রায় ২ লক্ষ ৪৯ হাজার ৯০০-তে নেমে এসেছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে মোট চার শতাংশ ছাড় দিচ্ছে টেসলা।
গাড়ি নির্মাণকারী সংগঠন ‘চায়না অ্যাসোসিয়েশন অফ অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স’ (সিএএএম) জানিয়েছে, ইভি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি এখন বিদেশের বাজার ধরার মরিয়া চেষ্টা করছে। কারণ সেখানে লাভের মাত্রা অনেকটা বেশি। গত বছর (পড়ুন ২০২৪) দেশের মাটিতে তৈরি ৫৮ লক্ষ ৬০ হাজার বাস এবং ট্রাক বিদেশে রফতানি করেছে বেজিং। ২০২৩ সালের তুলনায় যা ১৯.৩ শতাংশ বেশি।
সরকারি তথ্য বলছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইভি রফতানির পরিমাণ ৬.৭ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে চিন। মোট ১২ লক্ষ ৮০ হাজার বৈদ্যুতিন গাড়ি বিদেশে পাঠিয়েছে বেজিং।
‘গ্লোবাল কনসালটেন্সি বেন অ্যান্ড কোম্পানি’-এর অংশীদার চেং জ়িন বলেছেন, ‘‘বিদেশে ইভি রফতানি বৃদ্ধি করতে চিনা সংস্থাগুলির দৃঢ়সংকল্প হয়ে কাজ করছে। বিশ্ববাজারে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার মতো ক্ষমতা রয়েছে এখানকার গাড়ি প্রস্ততকারী কোম্পানিগুলির।’’
সব ছবি: সংগৃহীত।