সচিন তেন্ডুলকর ও রোহিত শর্মা। ভারতীয় ক্রিকেটের দুই কিংবদন্তির মধ্যে রয়েছে একাধিক সাদৃশ্য। মুম্বইয়ের ভূমিপুত্র এই দুই খেলোয়াড়ের ব্যাটে ভর করে কত ম্যাচ যে ভারত জিতেছে, তার হিসাব করা শক্ত। এক দিনের আন্তর্জাতিকে দু’জনের নামের পাশেই রয়েছে বিধ্বংসী ওপেনারের খেতাব।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) অগস্টে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে জাতীয় দলের জার্সিতে শেষ বার ৫০ ওভারের ম্যাচ খেলেন রোহিত। সেটি ছিল তাঁর ২৬৫তম এক দিনের আন্তর্জাতিক। সাদা বলের ক্রিকেটে ‘হিটম্যান’-এর পরিসংখ্যানের সঙ্গে ইতিমধ্যেই ‘মাস্টার ব্লাস্টার’-এর তুলনা টানা শুরু করেছে ভক্তকুল। শুধু তা-ই নয়, ওয়ান ডে ক্রিকেটে সচিনের চেয়ে রোহিতকে এগিয়ে রেখেছেন ক্রিকেট বোদ্ধাদের একাংশ।
জাতীয় দলের জার্সিতে এক দিনের আন্তর্জাতিকে রোহিতের অভিষেক হয় ২০০৭ সালে। প্রতিপক্ষ ছিল দুর্বল আয়ারল্যান্ড। অন্য দিকে ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ওডিআই খেলেন সচিন। তিনি ২৬৫তম ওয়ান ডে খেলেছিলেন ২০০১ সালে ঘরের মাঠে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। এর পর অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত আরও ১৯৮টি এক দিনের আন্তর্জাতিকে জাতীয় দলের জার্সিতে মাঠে ছিলেন তেন্ডুলকর।
সচিন ও রোহিত দু’জনেই কেরিয়ারের শুরুর দিকে ভারতের হয়ে মিডল অর্ডারে ব্যাট করতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ওপেনিংয়ে নিজেদের জায়গা পাকা করে নেন তাঁরা। ২৬৫তম এক দিনের আন্তর্জাতিক খেলার সময়ে ওডিআইতে ১০ হাজার রান পূর্ণ করতে সচিনের প্রয়োজন ছিল ৭৬। সেই মাইলস্টোন অবশ্য ওই ম্যাচে ছুঁতে পারেননি তিনি।
২৬৫তম ওডিআইয়ে মাত্র ৩২ রানে সাজঘরে ফেরেন তেন্ডুলকর। ওই ম্যাচের শেষে এক দিনের আন্তর্জাতিকে ‘মাস্টার ব্লাস্টার’-এর মোট রান দাঁড়ায় ৯,৯৬৬। তাঁর গড় ছিল ৪২.২৩, স্ট্রাইক রেট ৮৬.২৬। পরের ওয়ান ডেতেই পাঁচ অঙ্কের সংখ্যায় পৌঁছে যায় তাঁর রান।
অন্য দিকে, ২৬৫টি এক দিনের আন্তর্জাতিক খেলার অনেক আগেই ১০ হাজার রানের মালিক হয়ে গিয়েছেন রোহিত। ২০২৩ সালে এশিয়া কাপে ২৪৮তম ওডিআইতে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। ওই বছর আইসিসি এক দিনের আন্তর্জাতিক বিশ্বকাপেও বিধ্বংসী মেজাজে ছিলেন ‘হিটম্যান’। টুর্নামেন্টে তাঁর গড় দাঁড়ায় ৪৯.১৭। স্ট্রাইক রেট ছিল ৯২.৪৪। ২৬৫তম ম্যাচ শেষে রোহিতের মোট রান সংখ্যা ১০,৮৬৬।
জাতীয় দলের হয়ে ৭৭তম ওয়ান ডেতে প্রথম শতরান পান সচিন। কিন্তু তার পর অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন তিনি। ক্রিকেটের এই ফরম্যাটে মোট ৪৯টি শতরান রয়েছে তাঁর। ২৬৫টি এক দিনের আন্তর্জাতিকে সচিনে মোট ২৭টি শতরান করেন। তবে ওডিআইতে তাঁর করা শতরানের রেকর্ড ভেঙেছেন বিরাট কোহলি। প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক এক দিনের আন্তর্জাতিকে এখন পর্যন্ত করেছেন ৫০টি শতরান।
রোহিত অবশ্য জাতীয় দলের হয়ে প্রথম শতরান পান ৪৩তম ওডিআইতে। এই ফরম্যাটের ক্রিকেটে ২৬৫টি ম্যাচে তাঁর শতরানের সংখ্যা ৩১। এর মধ্যে তিনটি দ্বিশতরান রয়েছে। ওয়ান ডেতে সর্বাধিক শতরানের তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছেন ‘হিটম্যান’।
ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে এক দিনের আন্তর্জাতিকে প্রথম বার দ্বিশতরান অবশ্য করেন সচিনই। ২০১০ সালে ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ২০০ রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি। ১৪৭ বল খেলে ওই রানে পৌঁছন তেন্ডুলকর। বিশ্বের প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন তিনি।
জাতীয় দলের জার্সিতে বিদেশের মাটিতে বড় রান করা ক্রিকেটারদের কদর সব সময়েই বেশি। এ ক্ষেত্রে সচিন এবং রোহিতের পারফরম্যান্স প্রায় সমান সমান বলা চলে। ২৬৫টি ওডিআইয়ের মধ্যে ১৬৭টি ইনিংসে বিদেশের মাটিতে ব্যাট করেছেন ‘হিটম্যান’। সেখানে তাঁর গড় ৪৪.০৪। বিদেশের মাটিতে ওয়ান ডেতে রোহিত করেছেন ৬,১২১ রান। তাঁর স্ট্রাইক রেট ৮৫.৪৮।
২৬৫টি ওডিআইয়ের ক্ষেত্রে সচিনের বিদেশের মাটিতে গড় ৩৯.৯৪। মোট ৬,৪৩০ রান করেছেন তিনি। এই সংখ্যার ম্যাচে বিদেশের মাটিতে তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল ৮৫.৯৪। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের দাবি, এক দিনের আন্তর্জাতিকে মোট রানের নিরিখে সচিনকে পিছনে ফেলতে পারবেন না রোহিত। তবে প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের থেকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে তাঁর। ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হতে পারেন তিনি।
চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে এই টুর্নামেন্টের সমস্ত ম্যাচ খেলবে ভারত। ইতিমধ্যেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দল ঘোষণা করেছে বোর্ড। সেখানে অধিনায়কত্ব করবেন রোহিত।
গত কয়েক মাস ধরে অবশ্য ‘হিটম্যান’-এর ব্যাটে রানের খরা চলছে। ফলে সমালোচনায় বার বার বিদ্ধ হচ্ছেন তিনি। ক্রিকেট বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, আসন্ন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি রোহিতের কাছে অগ্নিপরীক্ষা হতে যাচ্ছে। এই টুর্নামেন্টে তাঁর ব্যাট জ্বলে উঠলে ২০২৭ সালের বিশ্বকাপেও জাতীয় দলের জার্সিতে দেখা যেতে পারে তাঁকে।
২০১১ সালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নেতৃত্বে আইসিসি এক দিনের আন্তর্জাতিক বিশ্বকাপ জেতে ভারত। সেই দলের সদস্য ছিলেন সচিন। অন্য দিকে ২০২৩ সালে ওডিআই বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে ট্রফি হাতছাড়া করে রোহিত শর্মার নেতৃত্বাধীন টিম ইন্ডিয়া। গত বছর (পড়ুন ২০২৪) আইসিসি টি-২০ বিশ্বকাপ অবশ্য ‘হিটম্যান’-এর অধিনায়কত্বেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারত।
আইসিসির কুড়ি-বিশের বিশ্বকাপ অবশ্য মোট দু’বার জিতেছেন রোহিত। ২০০৭ সালে ধোনির নেতৃত্বে প্রথম বার ওই ট্রফি আসে টিম ইন্ডিয়ার সাজঘরে। সেই দলেও ছিলেন রোহিত। টুর্নামেন্টে মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে নেমে একাধিক দৃষ্টিনন্দন ইনিংস খেলেন তিনি। তখনই সকলের নজরে পড়েছিলেন মুম্বইয়ের এই ডানহাতি ক্রিকেটার।
গত বছর (পড়ুন ২০২৪) আইসিসি টি-২০ বিশ্বকাপ জেতার পর জাতীয় দলের হয়ে এই ফরম্যাটে আর খেলবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন রোহিত। তাঁর সঙ্গেই কুড়ি-বিশের ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে ইতি টেনেছেন বিরাট কোহলি।
এক দিনের আন্তর্জাতিকে রোহিতের সর্বোচ্চ রান ২৬৪। এখনও পর্যন্ত খেলা ২৬৫টি ওডিআইতে ৩৩১টি ছক্কা মেরেছেন তিনি। এ ছাড়া ১,০১২টি বাউন্ডারি এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে। পাশাপাশি এই ফরম্যাটে ৫৭টি অর্ধ শতরান রয়েছে তাঁর।
অন্য দিকে টেস্ট ক্রিকেটে ৬৭টি ম্যাচ খেলেছেন রোহিত। সেখানে তাঁর সর্বোচ্চ স্কোর ২১২। পাঁচ দিনের ম্যাচে ভারত অধিনায়কের সংগ্রহ ৪,৩০১ রান। এই ফরম্যাটে ১২টি শতরান করেছেন তিনি। আর টেস্ট ক্রিকেটে সচিনের করা শতরানের সংখ্যা ৫১। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে শেষ পর্যন্ত রোহিতের চওড়া ব্যাট ফের পুরনো মেজাজে কথা বলে কি না, সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।