পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধের শঙ্খনাদ! রণভেরি বাজিয়ে মুখোমুখি ইরান-ইজ়রায়েল। পশ্চিম এশিয়ার শিয়া-ইহুদি ফৌজের মধ্যে সংঘর্ষ ব্যাপক আকার নিলে তার প্রভাব যে ভারতের উপর পড়বে, তা বলাই বাহুল্য। এতে কতটা রক্তাক্ত হবে এ দেশের অর্থনীতি? বাড়বে মূদ্রাস্ফীতি? আকাশ ছোঁবে খনিজ তেলের দাম? সেই হিসেব-নিকেশ শুরু করে দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিরা।
ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতের প্রভাব ইতিমধ্যেই ভারতের শেয়ার বাজারে আছড়ে পড়েছে। চলতি বছরের অক্টোবরের প্রথম তিন দিনে হু-হু করে নেমেছে স্টকের সূচক। ফলে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। আগামী দিনে সংঘাত ছড়াতে থাকলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।
ভারতীয় অর্থনীতির উপর দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বড় আঘাত হানতে পারে খনিজ তেল। বর্তমানে প্রায় ৮৫ শতাংশ অপরিশোধিত তেল বিদেশ থেকে আমদানি করে নয়াদিল্লি। ‘তরল সোনা’ উৎপাদনকারী দেশগুলির মধ্যে অন্যতম হল ইরান। ইহুদি ফৌজ শিয়া দেশটির তেলের ঘাঁটি উড়িয়ে দিলে বিশ্ববাজারে আগুনে দামে বিক্রি হবে খনিজ তেল। যা ভারতীয় অর্থনীতির কোমর ভাঙতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
ইরান-ইজ়রায়েলের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হতেই বিশ্ববাজারে চড়তে শুরু করেছে অশোধিত তেলের দর। ৪ অক্টোবর ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৭৭ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। যা ৮০ থেকে ৮৫ ডলারে পৌঁছবে বলে অর্থনীতিবিদদের থেকে এসেছে সতর্কবার্তা। তাঁদের যুক্তি, বিশ্ববাজারে দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে ঘরোয়া বাজারে বাড়তে পারে পেট্রল-ডিজ়েল ও রান্নার গ্যাসের দাম।
সাম্প্রতিক সময়ে রেপো রেট কমানো নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আরবিআই। অর্থনীতিবিদদের দাবি, তরল সোনা অস্বাভাবিক দামি হলে সেই প্রস্তাব থেকে সরে আসবে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। তখন লাফিয়ে বা়ড়বে মুদ্রাস্ফীতির হার। যা নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে আরবিআইকে।
তবে অর্থনীতির এই হামলা সামলাতে ভারতের হাতে যে কোনও ‘আয়রন ডোম’ নেই, তা ভাবলে ভুল হবে। কারণ, ইরানের উপর আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেখান থেকে খনিজ তেল কেনে না নয়াদিল্লি। শুধু তা-ই নয়, তরল সোনা আমদানির ক্ষেত্রে পশ্চিম এশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে কমাচ্ছে সাউথ ব্লক।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণের উপর রাশিয়ার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করে ওয়াশিংটন-সহ গোটা পশ্চিমি বিশ্ব। এর পরেই যুদ্ধের খরচ জোগাতে ও দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে নয়াদিল্লিকে সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রির প্রস্তাব দেয় মস্কো। যা গ্রহণ করে নরেন্দ্র মোদী সরকার। বর্তমানে আমদানি করা অপরিশোধিত তেলের প্রায় ৩০ শতাংশ রাশিয়া থেকে পাচ্ছে ভারত।
এ ছাড়া দুনিয়ার সর্বাধিক খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব-সহ পশ্চিম এশিয়ার একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে নয়াদিল্লির। সেই তালিকায় আছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির নামও। সংঘাত বাড়লে ‘অর্গানাইজ়েশন অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ়’ বা ওপেকের অন্তর্গত এই দেশগুলিকে তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ করতে পারে ভারত।
আমদানি করা তরল সোনার প্রায় ২৩ শতাংশ ওপেকভুক্ত দেশগুলির থেকে নিয়ে থাকে নয়াদিল্লি। রাশিয়া থেকে তেল কেনার আগে এই পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৪ শতাংশ। ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাত বড় আকার নিলে সৌদি বা আমিরশাহির থেকে তেল কেনার পরিমাণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের সামনে।
এ বছর এখনও পর্যন্ত ভারতীয় শেয়ার বাজারে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগের (ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট বা এফপিআই) পরিমাণ এক লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার সঙ্কট এতে বিপরীত গতি আনতে পারে। খুচরো লগ্নিকারীদেরও শেয়ার বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে বন্ড বা সোনা কেনার দিকে ঝোঁকার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এগুলিকে অনেক নিরাপদ বলে মনে করা হয়। সে ক্ষেত্রে শেয়ার সূচক অনেক নীচে নেমে যেতে পারে।
ইরান ও ইজ়রায়েল, দু’টি দেশেই বেশ কিছু কৌশলগত প্রকল্পে কাজ করছে ভারত। শিয়া দেশটিতে ‘চাবাহার বন্দর’ তৈরি করেছে নয়াদিল্লি। যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ৭ হাজার ২০০ কিলোমিটার লম্বা আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ করিডোর (ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর)। এই রাস্তা দিয়ে মধ্য এশিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালায় ভারত। ইহুদি ফৌজ তেহরানের উপর প্রত্যাঘাত হানলে এই রাস্তা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্য দিকে আবার উত্তর ইজ়রায়েলের ‘হাইফা বন্দর’ অধিগ্রহণ করেছে এ দেশের আদানি শিল্পগোষ্ঠী। ভূমধ্যসাগর সংলগ্ন এই বন্দরটির ভূমিকাও ভারতের অর্থনীতিতে কম নয়। এর মাধ্যমে দক্ষিণ ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি থেকে আমদানি-রফতানি চালায় নয়াদিল্লি। শিয়া বাহিনীর ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে বন্দরটির ক্ষতি হতে প্রভাব পড়বে এ দেশের অর্থনীতিতে।
এ ছাড়া পারস্য উপসাগরের ‘হরমুজ প্রণালী’ দিয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ খনিজ তেল ঘরের মাটিতে নিয়ে আসে ভারতীয় মালবাহী জাহাজ। সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম ব্যস্ত পথ হিসাবে সারা বিশ্বে এর পরিচিতি রয়েছে। সংঘাত ছড়ালে আর্থিকভাবে ইরানকে ভাতে মারতে যা বন্ধ করতে পারে ইজ়রায়েল। তখন হরমুজ প্রণালী আদৌ ভারতীয় মালবাহী জাহাজগুলি ব্যবহার করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতের জেরে জীবনহানি ঠেকাতে দু’টি দেশ থেকেই ভারতীয়দের দেশে ফেরাতে হতে পারে নয়াদিল্লিকে। যা অর্থনীতির পক্ষে মোটেই ভাল নয়। এতে ঘরোয়া বাজারে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইহুদি ও শিয়া মুলুকে ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক ভারতীয় সংস্থার। যুদ্ধের কারণে যা পুরোপুরি ডোবার আশঙ্কা রয়েছে। অন্য দিক থেকে দেখলে আবার শেয়ারের দর কমার পাশাপাশি হু-হু করে বাড়বে ‘হলুদ ধাতু’-র দাম। যা মধ্যবিত্তের ধরাছোঁয়ার বাইরে গেলে খুচরো গয়না বিক্রির পরিমাণ কমবে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর প্যালেল্টাইনি ভূখণ্ড গাজ়া থেকে ইহুদি ভূমিতে হামলা চালায় ইরান সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘হামাস’। ত্রিমুখী সেই আক্রমণে প্রাণ হারান ইজ়রায়েলের বহু সাধারণ মানুষ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
হামাসকে ধ্বংস করতে গাজ়ায় ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ বোমাবর্ষণ শুরু করতেই তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে ইরান সমর্থিত আরও দুই জঙ্গিগোষ্ঠী। তারা হল, লেবাননের হিজ়বুল্লা ও ইয়েমেনের হুথি। ইহুদি ভূমিতে চোরাগোপ্তা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে থাকে দুই সন্ত্রাসবাদী সংগঠন।
এই পরিস্থিতিতে বেছে বেছে হামাস ও হিজ়বুল্লার নেতাদের খতম করার পরিকল্পনা করে ইজ়রায়েলের গুপ্তচর সংস্থা ‘মোসাদ’। মাস কয়েক আগে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ে তেহরানে গেলে রহস্যজনক বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় তার। যার নেপথ্যে ইহুদি গুপ্তচরদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তোলে ইরান।
হানিয়ের মৃত্যুর পর হামাস আর সে ভাবে আইডিএফের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে এ বার হিজ়বুল্লার দিকে নজর দেয় ইহুদি ফৌজ। সেপ্টেম্বরের একেবারে শেষে আইডিএফের বিমান হামলায় লেবাননের রাজধানী বেইরুটে প্রাণ হারান হিজ়বুল্লা প্রধান সৈয়দ হাসান নাসরাল্লা। মৃত্যু হয় তাঁর মেয়েরও। প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে হিজ়বুল্লার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন তিনি।
নাসরাল্লা খতম হতেই দক্ষিণ লেবাননে গ্রাউন্ড অপারেশন শুরু করে আইডিএফ। যার বদলা নিতে পয়লা অক্টোবর ১৮০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালিয়েছে ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস বা আইআরজিসি। ইহুদিদের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অবশ্য মাঝ আকাশেই অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে সক্ষম হওয়ায় বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ওই ঘটনার পর ইরানকে চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, শিয়া দেশটির খনিজ তেলের ভান্ডারকে নিশানা করতে পারে আইডিএফ। তেহেরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলিতে ইহুদি বায়ুসেনার হামলার আশঙ্কা রয়েছে। যা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।