তাইওয়ানকে কব্জা করতে ফের চালবাজি চিনের। সমুদ্রের গভীরে থাকা ফাইবার-অপটিক্যাল কেব্ল কেটে এ বার টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করার চেষ্টা চালাল বেজিং। ড্রাগনের এ হেন ‘ধূসর-এলাকা-হয়রানি’তে (গ্রে এরিয়া হ্যারাসমেন্ট) অতিষ্ঠ প্রশান্ত মহাসাগরের ওই দ্বীপরাষ্ট্র। যে কোনও মুহূর্তে পরিস্থিতি বড় সংঘাতের দিকে মোড় নিতে পারে বলে মত প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের।
তাইওয়ানের অভিযোগ, চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ৫ জানুয়ারি তাঁদের জলসীমায় ঢোকে ‘শুনসিন-৩৯’ নামের একটি চিনা জাহাজ। কিলুং বন্দরের কাছে নোঙর করে সমুদ্রের তলদেশে থাকা ফাইবার-অপটিক্যাল তার কেটে দেয় ওই জলযান। এর পর চুপচাপ সেখান থেকে জাহাজটিকে অন্যত্র সরিয়ে নেয় বেজিং।
সমুদ্রের গভীরে থাকা ফাইবার-অপটিক্যাল কেব্ল কাটার বিষয়টি প্রথম নজরে আসে তাইওয়ানের চুংহওয়া টেলি যোগাযোগ দফতরের আধিকারিকদের। এর জেরে বিঘ্নিত হয় পরিষেবা। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে দ্বীপরাষ্ট্রের উপকূলরক্ষী বাহিনী। তাদের দাবি, অভিযুক্ত চিনা জাহাজটিতে মোট সাত জন ক্রু সদস্য ছিলেন। হংকংবাসী এক ব্যক্তি ওই জলযানটির মালিক। জাহাজটি কিলুং বন্দরের কাছে আসার আগে আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন এবং তানজ়ানিয়ায় নোঙর করেছিল।
কিন্তু তাইপের এই অভিযোগ হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে ‘শুনসিন-৩৯’-এর পরিচালন সংস্থা। গত ১০ জানুয়ারি এই ইস্যুতে বিবৃতি জারি করে তারা। সেখানে বলা হয়েছে, বন্দরের কাছে এলে নোঙর ফেলা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে সমুদ্রের গভীরে থাকা ফাইবার অপটিক্যাল কেব্ল নষ্ট হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই।
তাইওয়ানের জলসীমায় ঢুকে এই ধরনের দাদাগিরি চিন প্রথম বার করল, এমনটা নয়। ২০২৩ সালে বেজিঙের বিরুদ্ধে একই রকমের অভিযোগ তুলেছিল তাইপে। সে বার মূল তাইওয়ানের সঙ্গে মাৎসু দ্বীপপুঞ্জের সংযোগকারী দু’টি কেব্লকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ড্রাগনের নৌবাহিনী। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রে ব্যাহত হয়েছিল ইন্টারনেট পরিষেবা।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা একে চিনের ‘বৃহত্তর হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশল’ বলে উল্লেখ করেছেন। লম্বা সময় ধরে তাইপেকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে আসছে বেজিং। প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র ড্রাগনের কাছে একটি ‘বিদ্রোহী প্রদেশ’, কোনও স্বতন্ত্র দেশ নয়।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আবার একে ‘ধূসর-এলাকা-হয়রানি’ বলে থাকেন। তাঁদের ব্যাখ্যা, চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ তাইওয়ানকে ধূসর এলাকা বলে মনে করে। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি দখল করতে সরাসরি যুদ্ধের রাস্তায় যেতে চাইছেন না ড্রাগনের ফৌজি কম্যান্ডারেরা। এই ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে তাইপের উপর মানসিক চাপ তৈরি করতে চাইছেন তাঁরা।
বেজিঙের দ্বিতীয় লক্ষ্য হল তাইওয়ানের বিদেশি সমর্থন হ্রাস। গত কয়েক বছরে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রের। একে সন্দেহের চোখে দেখছেন চিনের চেয়ারম্যান তথা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। আর তাই তাইপেকে কিছুটা শিক্ষা দিতে চাইছেন তিনি।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিনা লালফৌজের ‘হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশল’-এর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল, তাইওয়ানকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে পিএলএ নৌসেনার বড় আকারের যুদ্ধাভ্যাস। গত দু’বছরে এ ভাবে বহু বার তাইপের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে বেজিং।
এ ছাড়া চিনা বিমানবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায়ই তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি, দ্বীপরাষ্ট্রটিকে নিয়ে সারা বছর ধরেই নানা রকমের বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চালিয়ে থাকে ড্রাগন ফৌজ। মূলত অনলাইন মাধ্যমে এই কাজ চালিয়ে যায় তারা।
পাশাপাশি নিরাপত্তার অজুহাতে তাইওয়ানের নাগরিকদের আটক এবং ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে আতঙ্ক তৈরি করছে চিন। দ্বীপরাষ্ট্রটিকে বশ্যতা স্বীকার করাতে গুপ্তচরবৃত্তি, সাইবার হামলা, কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক চাপ ক্রমাগত দিয়ে চলেছে বেজিং। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা একে ড্রাগনের ‘ত্রিস্তরীয় যুদ্ধ’ (থ্রি লেয়ার ওয়ার) বলে উল্লেখ করেছেন।
এই ধরনের অপারেশনে পিএলএর পাশাপাশি ইউনাইটেড ফ্রন্ট ওয়ার্ক ডিপার্টমেন্ট (ইউএফডব্লুডি), উপকূলরক্ষী বাহিনী (চায়না কোস্ট গার্ড বা সিসিজি) এবং সামুদ্রিক ভাড়াটে সেনাকে (মেরিটাইম মিলিশিয়া) কাজে লাগিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি। বিশ্লেষকদের দাবি, এর জেরে পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে চিনের সম্পর্ককে দিন দিন অবনতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আগ্রাসী ড্রাগনের মোকাবিলায় তাইপে হাত গুটিয়ে বসে আছে ভাবলে ভুল হবে। ইতিমধ্যেই কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে বিপুল বিনিয়োগ করছে সেখানকার সরকার। পাশাপাশি, সামরিক শক্তিবৃদ্ধির দিকেও নজর দিয়েছে তাইওয়ান। বাড়িয়েছে প্রতিরক্ষা বাজেট।
সম্ভাব্য চিনা আক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন ধরনের সামরিক মহড়ার মাধ্যমে নিজেদের প্রস্তুত রাখছে তাইপের সেনাবাহিনী। বেজিঙের হামলায় পুরোপুরি ইন্টারনেট পরিষেবা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কী কী করণীয়, তারও অনুশীলন সেরে রেখেছেন তাঁরা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার দিকেও নজর দিয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রের প্রশাসন।
পাশাপাশি, আমেরিকা থেকে বিপুল পরিমাণে অত্যাধুনিক হাতিয়ার পেতে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে তাইওয়ান। দ্বীপরাষ্ট্রটিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী। সেই সৈন্যসংখ্যা আগামী দিনে বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই অনুষ্ঠানে চিনা প্রেসিডেন্ট জিনপিংকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ট্রাম্পের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের বাইরে পা রাখেননি শি। ফলে ওয়াশিংটন এবং বেজিঙের মধ্যে আগামী দিনে যে সম্পর্ক খুব মধুর থাকবে, এমন চিন্তা না করাই ভাল।
ট্রাম্প ইতিমধ্যেই চিনের সঙ্গে শুল্ক-যুদ্ধে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সেই রাস্তায় হাঁটলে আর্থিক দিক থেকে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেজিং। ফলে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে ড্রাগন। এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট শির সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর সেই লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে তাইওয়ান, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের শপথে হাজির ছিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ট্রাম্পের সঙ্গেই শপথ নিয়েছিলেন আমেরিকার নতুন বিদেশ সচিব মার্কো রুবিও এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ়। তাঁদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সারেন জয়শঙ্কর। অনুষ্ঠানে একেবারে সামনের সারিতে বসেছিলেন তিনি।
এ ছাড়া ট্রাম্পের শপথের দিনেই বৈঠকে বসেন কোয়াডভুক্ত দেশগুলির বিদেশমন্ত্রীরা। সেখানে জয়শঙ্কর এবং রুবিও ছাড়াও ছিলেন অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের বিদেশমন্ত্রী। বৈঠক শেষে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মুক্ত করার কথা বলে যৌথ বিবৃতি দেন তাঁরা। টোকিয়োর তরফে সম্ভাব্য চিনা আক্রমণের আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আগ্রাসী চিনের মোকাবিলায় আগামী দিনে কোয়াডকে আরও বেশি শক্তিশালী করার রাস্তায় হাঁটতে পারেন ট্রাম্প। চলতি বছরে (পড়ুন ২০২৫) এই সংগঠনের রাষ্ট্রনেতা পর্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এর আয়োজক দেশ হবে ভারত। সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ট্রাম্প।
সম্প্রতি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উপগ্রহ সিগন্যাল আটকানোর জন্য জ্যামার বসানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে আমেরিকা। এই ইস্যুতে বেজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বৈদ্যুতিন যুদ্ধ শুরু হতে পারে বলে দুনিয়া জুড়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ডিসেম্বরে এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ওই সময়ে আমেরিকার ‘স্পেস র্যাপিড ক্যাপাবিলিটিস’ অফিসের অধিকর্তা কেলি হ্যামেট জানান, ‘রিমোট মডুলার টার্মিনাল (আরএমটি)’ নামের জ্যামার সিস্টেমটি তৈরি করা হয়েছে। মূলত ‘কিল চেন’ ব্যাহত করার জন্য এটিকে প্রস্তুত করেছেন তাঁরা। ‘কিল চেন’ হল একটি সামরিক পদ্ধতি যা শত্রুদের আক্রমণের ছক চিহ্নিত করে।
হ্যামেট এ-ও জানিয়েছিলেন, জ্যামারের প্রাথমিক লক্ষ্য হল চিনের নজরদারি উপগ্রহের নেটওয়ার্ক, বিশেষ করে ‘ইয়াওগান’ সিরিজ়ের উপগ্রহগুলির সিগন্যাল আটকে দেওয়া। উপগ্রহের মাধ্যমে নজরদারির বিষয়ে চিনকে এক প্রকার ‘অন্ধ’ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
অন্য দিকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে বেজিঙের দাদাগিরির জেরে সেখানে বেড়েছে ভারতীয় অস্ত্রের চাহিদা। ইতিমধ্যেই ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে চুক্তি করেছে ফিলিপিন্স। এই ব্রহ্মাস্ত্রটি পাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) এপ্রিল মাসে ‘ব্রহ্মস’-এর প্রথম ব্যাচ হাতে পায় ফিলিপিন্সের সামরিক বাহিনী। তার কিছু দিনের মধ্যে এই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ হস্তগত করতে নয়াদিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্দোনেশিয়ার সরকার। সূত্রের খবর, এই ইস্যুতে ৪৫ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চলেছে জাকার্তা। প্রসঙ্গত, এর আগে কখনও এত বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি করেনি ভারত।
সব ছবি: সংগৃহীত।