ভারত, আমেরিকা থেকে শুরু করে জাপান। ফের একবার একসঙ্গে একাধিক দেশকে লাল চোখ দেখাল চিন। হঠাৎই আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের (ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম) পরীক্ষা চালিয়েছে বেজিং। যা দেখে ভুরু কুঁচকেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আইসিবিএমের সফল পরীক্ষা চালায় শি জিনপিংয়ের দেশ। ক্ষেপণাস্ত্রটির নাম অবশ্য জানায়নি বেজিং। প্রায় চার দশক পর এই ধরনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করল চিন।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, সাধারণত পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বা তার চেয়ে দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত নিশানায় আঘাত হানতে পারে আইসিবিএম। সে দিক থেকে দেখতে গেলে এই ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে আমেরিকার বেশ কয়েকটি বড় শহরে হামলা চালাতে পারবে চিন। এর পাল্লায় চলে আসবে দক্ষিণ ভারতের এলাকাও।
আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটির পরীক্ষার পর একটি বিবৃতি জারি করে চিনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণের কার্যকারিতা দেখে নেওয়ার জন্য ওই পরীক্ষা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে বেজিং। যা সুচারু ভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
চিন আইসিবিএম পরীক্ষা করতেই তা নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে জাপান। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির অভিযোগ, ক্ষেপণাস্ত্রটি তাদের দেশের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। শুধু তাই নয়, ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার আগে প্রয়োজনীয় সতর্কতাও নাকি জারি করেনি চিন।
বেজিং অবশ্য টোকিয়োর এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছে। চিনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, তাঁদের পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ-র রকেট বাহিনীর তরফ থেকে ওই এলাকার সমস্ত দেশগুলিকে পরীক্ষা সংক্রান্ত সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোনও নিয়ম ভাঙা হয়নি।
চলতি মাসেই আমেরিকায় বসেছিল চতুর্দেশীয় জোট ‘কোয়াড’-এর বৈঠক। এতে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ ছাড়াও বৈঠকে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের দেখা গিয়েছিল।
সূত্রের খবর, ওই বৈঠকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার বিষয়ে ভারত, আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে হয়েছে বিস্তারিত আলোচনা। বৈঠকের মাঝে এই দেশগুলির রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন মোদী। ঠিক তার পরেই চিনের এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক বার অগ্নি ৪ ও অগ্নি ৫ আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে ভারত। যার পাল্লায় চলে আসবে বেজিং, সাংহাই-সহ চিনের একাধিক শহর। যা নিয়ে বার বার আপত্তি জানিয়ে এসেছে শি জিনপিংয়ের দেশ।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আইসিবিএম পরীক্ষা করে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছে চিন। প্রথমত, এর মাধ্যমে আমেরিকা-সহ কোয়াডের দেশগুলিকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছে পিএলএ। দ্বিতীয়ত, আলাদা করে নয়াদিল্লির উপর চাপ তৈরির চেষ্টা করেছে বেজিং।
তবে মুখে এ সবের কিছুই বলছে না লাল ফৌজের দেশ। চিনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘‘রুটিন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছে। কোনও দেশকে লক্ষ্যবস্তু করার অভিপ্রায় নেই আমাদের।’’
চিনের এই আগ্রাসী মনোভাবে প্রমাদ গুনেছে জাপান। দ্বীপরাষ্ট্রটির আশঙ্কা, আগামী দিনে প্রথমে তাইওয়ানে হামলা চালাবে পিএলএ। তার পর সেটা দখল করে লাল ফৌজ এগিয়ে আসবে টোকিয়োর দিকে। সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি জোরদার করছে বেজিং।
এই ইস্যুতে জাপান সরকারের মুখপাত্র ইয়োশিমাসা হায়াশি বলেন, ‘‘চিন লাগাতার প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে চলেছে। পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা বাড়ানোর দিকে বেজিংয়ের নজর রয়েছে। যা এই এলাকার ভৌগোলিক স্থিতাবস্থায় আঘাত হানতে পারে।’’
চিনের আইসিবিএম পরীক্ষা করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিউ জ়িল্যান্ডও। বেজিংয়ের এই পদক্ষেপকে অবাঞ্ছিত বলে উল্লেখ করেছে কিউয়ি প্রশাসন। ‘‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার নেতা-নেত্রীরা যখন স্থিতাবস্থা, শান্তি ও উন্নতির দিকে নজর দিয়েছে, তখনই এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা সব হিসাব উল্টে দিতে পারে। এটা আমাদের আশাহত করেছে’’, বলেছেন নিউ জ়িল্যান্ডের বিদেশমন্ত্রী উইনস্টোন পিটার্স।
১৯৮০ সালের মে মাসে প্রথম বার আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে চিন। যার নাম ছিল ডিএফ-৫। ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ন’হাজার কিলোমিটার বলে দাবি করেছিল বেজিংয়ের সরকারি সংবাদমাধ্যম।
বর্তমানে চিনের হাতে এই ধরনের একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। সেগুলির মধ্যে ডিএফ-৩১এজি, ডিএফ-৫বি ও ডিএফ-৪১ উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম।
আজকের দুনিয়ায় মোট ন’টি দেশের হাতে রয়েছে পরমাণু অস্ত্র। সেই তালিকায় রয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইজ়রায়েলের নাম। এর মধ্যে আটটি দেশের কাছেই রয়েছে আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।
পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে একমাত্র পাকিস্তানের কাছেই নেই আইসিবিএম। ইসলামাবাদ যত বার এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা করেছে, তত বারই তাঁদের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে আমেরিকা। ফলে আপাতত ওই প্রকল্প থেকে সরে এসেছে পশ্চিমের পড়শি দেশ।
অন্য দিকে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও আরও একটি আইসিবিএম তৈরিতে মন দিয়েছে। ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেডের সহযোগিতায় অগ্নি ৬ তৈরি করছে এই সংস্থা। পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ১২ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সব ছবি: সংগৃহীত