ষষ্ঠ দলাই দামার নামে অরুণাচলের তাওয়াং প্রদেশের পাহাড়চূড়ার নামকরণ করছে ভারতীয় পর্বতারোহীর দল। যা দেখে রেগে আগুন বেজিং। ‘চিনা ভূখণ্ডে অবৈধ অভিযান’ চালানো হয়েছে বলে কড়া প্রতিক্রিয়া দিল শি জিনপিংয়ের দেশ। যা ভারত-চিনের মধ্যে সম্পর্কে আরও অবনতি ঘটাতে পারে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
এই বিষয়ে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র লিন জিয়ান। ভারতীয় পর্বতারোহীদের সাফল্যের কথা মানতেই চাননি তিনি। জিয়ানের কথায়, ‘‘তাওয়াংয়ের যে পাহাড়চূড়া জয়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’’
এর পরই নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে হুমকির সুর শোনা যায় চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের গলায়। তিনি বলেন, ‘‘ভারতের তথাকথিত অরুণাচল প্রদেশ আসলে আমাদের জাংনান এলাকা। চিনা ভূখণ্ডে ভারতের যে কোনও কার্যকলাপ বেআইনি। বেজিং ধারাবাহিক ভাবে এই অবস্থান নিয়ে আসছে। এতে বদল হওয়ার কোনও জায়গা নেই।’’
সম্প্রতি অরুণাচলের তাওয়াং এলাকার একটি পাহাড়চূড়ায় অভিযান চালায় ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাডভান্স স্পোর্টস’ (এনআইএমএএস)। ২০ হাজার ৯৪২ ফুট উচ্চতার যে শৃঙ্গটি জয়ের জন্য ওই পর্বতারোহীর দল গিয়েছিল, তা এত দিন অনাবিষ্কৃতই ছিল। অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল রণবীর সিংহ।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণেই পাহাড়ি অভিযানের আয়োজন করে এনআইএমএএস। অভিযান শেষে কেন্দ্র জানিয়েছে, ওই শৃঙ্গে পৌঁছতে সময় লেগেছে ১৫ দিন। অভিযাত্রীদের খাড়াই পাহাড় ও দুর্গম গিরিখাতের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু সব চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে তাঁরা অনাবিষ্কৃত ওই শৃঙ্গে পৌঁছে যান।
অরুণাচলের গরিচেন রেঞ্জের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই পাহাড়চূড়া। অভিযাত্রীরা ষষ্ঠ দলাই লামাকে সম্মান জানিয়ে যার নাম রেখেছেন ‘সাংইয়াং গিয়াৎসো’। সেখানে পৌঁছতে পর্বতারোহীদের তিন কিলোমিটার লম্বা হিমবাহ পেরোতে হয়েছে। যা সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল বলে বিবৃতিতে জানিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
১৬৮২ সালে মোন তাওয়াং এলাকায় জন্ম হয় ষষ্ঠ দলাই লামার। স্থানীয় মনপা সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য প্রখর জ্ঞানের অধিকারী এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর অবদান অনস্বীকার্য। আর তাই ষষ্ঠ দলাই লামাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ওই শৃঙ্গের নামকরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র।
এই শৃঙ্গ জয়ের পর ভারতীয় পর্বতারোহণ সংগঠন বা ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশনকে (আইএমএফ) গোটা বিষয়টি জানিয়ে দেয় এনআইএমএএস। যার জেরে ‘সাংইয়াং গিয়াৎসো’ পাহাড়চূড়াকে আনুষ্ঠানিক ভাবে মানচিত্রে তুলে ধরার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যা মোটেই ভাল চোখে দেখছে না চিন।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) পেরিয়ে অরুণাচলের তাওয়াংয়ে জোর করে ঢোকার চেষ্টা করে বেজিংয়ের পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ। তাঁদের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে ভারতীয় সেনা। সীমান্তের কাছে লালফৌজকে ঘিরে ধরে বেধড়ক মারধর করে তাঁরা।
ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতে দ্রুত সেখান থেকে চম্পট দেয় পিএলএ। তবে ওই ঘটনায় ছ’জন জওয়ান সামান্য আহত হয়েছিলেন। তাঁদের গুয়াহাটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে সংসদে বিবৃতি দিয়েছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
ওই ঘটনায় প্রথমে সীমান্তের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেছিল চিন। কিন্তু পরে ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে মত বদলায় বেজিং। জানিয়ে দেয়, ভারতের তরফেই এলএসি পেরিয়ে তাঁদের জমির ভিতরে ঢোকার চেষ্টা হয়েছিল। যা পত্রপাঠ খারিজ করে নয়াদিল্লি।
উল্লেখ্য, ২০২০ সাল থেকেই সীমান্তে আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছে চিন। যার প্রভাব দুই দেশের সম্পর্কে পড়েছে। বেজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ না হলেও পরিস্থিতি যে ভাল নয়, তা বহু বার খোলাখুলি ভাবেই বলেছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
২০২০ সালের জুন মাসে পূর্ব লাদাখের বিস্তীর্ণ এলাকায় এলএসি পেরিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা চালায় পিএলএ। শুধু তা-ই নয়, লালফৌজের হামলায় গালওয়ান উপত্যকায় কর্নেল বি সন্তোষ বাবু-সহ ২০ জন জওয়ান প্রাণ হারান। পাল্টা ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতে প্রায় ৪০ জন চিনা সৈনিকের মৃত্যু হয়েছিল বলে সূত্র মারফত খবর এসেছিল। যদিও বেজিং ওই মৃত্যুর কথা স্বীকার করেনি।
ওই ঘটনার পর এলএসিতে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করে দুই দেশ। সীমান্তের উত্তেজনা কমাতে সেনা পর্যায়ে শুরু হয় আলোচনা। যার জেরে পরবর্তী সময়ে কিছু জায়গা থেকে পিছু হটে চিন। তবে বাকি এলাকাগুলিতে এখনও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় ফৌজ ও পিএলএ।
চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর এই ইস্যুতে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করে বেজিংয়ের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। চিন জানিয়েছে, ‘‘পূর্ব লাদাখে ভারতের সঙ্গে মতপার্থক্যগুলি আমরা অনেকাংশেই মিটিয়ে ফেলতে পেরেছি। এ ব্যাপারে একমত হওয়ার জন্য আলোচনা চালানো হচ্ছে। যা ওই এলাকার উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করবে।’’
সূত্রের খবর, সীমান্ত সমস্যা মেটাতে ভারতের সঙ্গে নিরন্তর আলোচনা চালিয়ে যেতে রাজি হয়েছে চিন। কিছু দিন আগেই বেজিংয়ের বিদেশ মন্ত্রকের এশিয়া বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল লি জিনসং ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রদীপকুমার রাওয়াতের সঙ্গে দেখা করেন।
২০১৭ সাল থেকেই ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে কব্জা করতে চাইছে চিন। আর তাই অরুণাচল প্রদেশের নাম জাংনান দিয়েছে বেজিং। একই ভাবে ওই এলাকার আরও কিছু জায়গার নাম পরিবর্তন করেছে শি জিনপিংয়ের দেশ। যা নিয়ে আপত্তি রয়েছে নয়াদিল্লির।
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে তিব্বত দখল করে চিন। ‘পৃথিবীর ছাদ’ বলে পরিচিত হিমালয়ের কোলের এই দেশটির শাসক চতুর্দশ দলাই লামা নিজের প্রাসাদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসেন। বর্তমানে হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় রয়েছেন তিনি। সেখান থেকে নির্বাসিত সরকার চালাচ্ছেন চতুর্দশ দলাই লামা।
দলাই লামার এই নির্বাসিত সরকারকে মানতে রাজি নয় বেজিং। এই ইস্যুতে বার বার ভারতের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছে চিন। এমনকি বৌদ্ধ ওই ধর্মগুরুকে হস্তান্তরের আবেদনও করেছে শি জিনপিংয়ের দেশ। কিন্তু শত চাপের কাছেও তা কখনই মানেনি নয়াদিল্লি।
এই পরিস্থিতিতে তাওয়াংয়ের কাছে অনাবিষ্কৃত পর্বতশৃঙ্গ জয় এবং ষষ্ঠ দলাই লামার স্মরণে তার নামকরণ নয়া সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। যা নতুন করে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষের জন্ম দিতে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।