
প্রথমে জাফর এক্সপ্রেস অপহরণ। তার পর আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে সৈন্যবোঝাই বাস ওড়ানো। বালোচ বিদ্রোহীদের তাণ্ডবে বেসামাল পাকিস্তান। সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতিতে চিনা নাগরিকদের সুরক্ষায় পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করছে চিন। বিষয়টিকে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের গালে ‘বিরাশি শিক্কা’র থাপ্পড় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।

গত ১২ বছর ধরে চলা ‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর’কে (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর বা সিপিইসি) কেন্দ্র করে পাকিস্তানের বালোচিস্তানে তীব্র হয়েছে ক্ষোভ। সেখানকার সশস্ত্র বিদ্রোহীরা বার বার এই প্রকল্পে কর্মরত চিনা নাগরিকদের নিশানা করেছেন। ফলে প্রাণ গিয়েছে বেজিঙের একগুচ্ছ ইঞ্জিনিয়ার এবং কর্মীর।

শুধু তা-ই নয়, জাফর এক্সপ্রেস অপহরণকাণ্ডের পর রীতিমতো ভিডিয়ো প্রকাশ করে চিনা প্রেসিডেন্ট তথা চেয়ারম্যান শি জিনপিংকে হুমকি দেয় ‘বালোচ লিবারেশন আর্মি’ (বিএলএ)। সিপিইসি বন্ধ করে বেজিঙের সংস্থাগুলিকে বালোচিস্তান থেকে পাত্তারি গোটাতে বলেন এই সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কমান্ডাররা।

এর পর আর সময় নষ্ট না করে চিনা নাগরিকদের নিরাপত্তায় তৎপর হয় বেজিং। এ ব্যাপারে পাক ফৌজের উপর ভরসা রাখতে পারেনি জিনপিং সরকার। সূত্রের খবর, সিপিইসি প্রকল্পে কর্মরত নাগরিকদের নিরাপত্তায় দায়িত্ব তিনটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার কাঁধে তুলে দিয়েছে ড্রাগন।

পাকভূমিতে নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত বেজিঙের সংস্থাগুলি হল, ডিউ সিকিউরিটি ফ্রন্টিয়ার সার্ভিস গ্রুপ, চায়না ওভারসিজ় সিকিউরিটি গ্রুপ এবং হুয়াক্সিন ঝংশান সিকিউরিটি সার্ভিস। প্রথম পর্যায়ে সিপিইসির সিন্ধু প্রদেশের দু’টি বিদ্যুৎ প্রকল্পে তাদের রক্ষীদের মোতায়েন করা হয়েছে। পাক সৈনিকদের সঙ্গে কাজ করবেন তাঁরা।

সিন্ধু প্রদেশের থার কয়লা ব্লকের দু’টি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বর্তমানে প্রায় ৬,৫০০ চিনা নাগরিক কর্মরত রয়েছেন। তাঁদের সুরক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি বলয় তৈরি করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র খবর, বেজিঙের সংস্থাগুলিকে প্রথম বলয়ের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

প্রকল্প এলাকার বাইরে চিনা নাগরিকদের যাতে কোনও রকমের যোগাযোগ না থাকে, সে কথা মাথায় রেখে সুরক্ষা ব্যবস্থাকে সাজিয়েছে ওই তিনটি নিরাপত্তা সংস্থা। চিনা নাগরিকদের যাতায়াতের রাস্তাও ঠিক করার দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে অবশ্য পাক সেনার সাহায্য নিচ্ছে বেজিঙের সুরক্ষা সংস্থাগুলি।

প্রসঙ্গত, এর আগে সিপিইসিতে কর্মরত নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএর একটি ইউনিটকে পাকভূমিতে মোতায়েনের জন্য ইসলামাবাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল জিনপিং সরকার। কিন্তু, ড্রাগনের এই দাবি তৎক্ষণাৎ খারিজ করে দেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।

পরবর্তী সময়ে এই ইস্যুতে শাহবাজ় শরিফ সরকারের উপর চাপ বাড়াতে থাকে ড্রাগন। ফলে বাধ্য হয়ে বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাকে সুরক্ষার দায়িত্ব প্রদানের ব্যাপারটি মেনে নেয় পাকিস্তান। সেই সমঝোতার পর সিপিইসির প্রকল্পে রক্ষী মোতায়েন করে তিনটি চিনা সংস্থা। তাদের সঙ্গে পিএলএর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলেও খবর ছড়িয়েছে।

অন্য দিকে সিন্ধু প্রদেশে চিনা বাহিনী মোতায়েনের খবরকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছে ইসলামাবাদ। বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন পাক বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র শাফকাত আলি। তাঁর কথায়, ‘‘পুরোপুরি মিথ্যা কথা রটানো হচ্ছে। পাকিস্তানের মাটিতে কোনও চিনা বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে না। তবে আমরা মান্দারিনভাষীদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’’

উল্লেখ্য, পাকভূমিতে চিনা নাগরিকদের উপর সর্বশেষ হামলার ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ৬ অক্টোবর। ওই দিন বিএলএর আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ হারান মান্দারিনভাষী দু’জন। গত দু’বছরের সিপিইসিতে কর্মরত ৬০-এর বেশি চিনা নাগরিকের একই কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। নিহতদের তালিকায় চিনা ইঞ্জিনিয়ারও রয়েছেন।

ইসলামাবাদের অবশ্য দাবি, সিপিইসি এবং সেখানে কর্মরত চিনা নাগরিকদের নিরাপত্তায় প্রতিরক্ষা খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত বছর বালোচ বিদ্রোহীদের দমন করতে ‘অপারেশন আজ়ম-ই-ইস্তেখাম’ চালায় পাক ফৌজ। এর জন্য ছ’হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে শাহবাজ় সরকার।

এ ছাড়া বেজিঙের নির্দেশে সিপিইসি দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পগুলির সঙ্গে যুক্ত সম্পদের নিরাপত্তার অতিরিক্ত ন’হাজার কোটি খরচ করবে পাকিস্তান। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার মান্দারিনভাষী এতে কাজ করছেন। বালোচিস্তানের গ্বদরের মতো সংবেদনশীল এলাকায় রয়েছেন তাঁরা।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, সিপিইসির নিরাপত্তার নামে পাকভূমিতে চিনের বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার পা পড়ায় আরও রক্তাক্ত হতে পারে বালোচিস্তান। কারণ, এ বার পাক ফৌজের পাশাপাশি বেজিঙের বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষীদেরও টার্গেট করতে পারে বিএলএ। সে ক্ষেত্রে আরও জটিল হবে ওই এলাকার পরিস্থিতি।

চলতি বছরের ১১ মার্চ বালোচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা থেকে খাইবার-পাখতুনখোয়ার পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেসকে অপহরণ করে বিএলএ। এর পর প্রায় ৩০ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে ট্রেনটিকে বিদ্রোহীদের দখল মুক্ত করে পাক সেনা। এই অভিযানে ৪ জওয়ান-সহ মোট ২১ জন যাত্রী প্রাণ হারান বলে জানিয়ে দেয় ইসলামাবাদ।

পাক সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান অবশ্য মানেনি বিএলএ। জাফর এক্সপ্রেস অপহরণকাণ্ডে ২৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় ওই সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। গত ১৬ মার্চ পাক সেনার কনভয়ে ফের ‘ফিদায়েঁ’ হামলা চালায় তাঁরা। তাতে ৯০ জন সৈনিকের মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসে।

বিশ্লেষকদের দাবি, সিপিইসি প্রকল্পের জন্যেই আরও বেশি অশান্ত হয়েছে বালোচিস্তান। সেখানকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিনিয়োগের নামে পাক সেনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে খনি সমৃদ্ধ প্রদেশটির সম্পদ লুট করছে ড্রাগন। ফলে চরম আর্থিক দুরবস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।

পাকভূমিতে ড্রাগনের নিরাপত্তা রক্ষীদের পা পড়াকে মোটেই ভাল চোখে দেখছে না আমেরিকা। এর মাধ্যমে ইসলামাবাদকে একরকম তালুবন্দি করে ফেলার সুযোগ পাবে বেজিং। তা ছাড়া সিপিইসিতে গ্বদর বন্দর তৈরি করার কথা রয়েছে ড্রাগনের। এতে আরব সাগর, পারস্য উপসাগর এবং এডেন উপসাগরে সরাসরি প্রবেশের দরজা খুলে যাবে পিএলএ নৌসেনার কাছে।

গোটা বিষয়টির উপর কড়া নজর রাখছে ভারতও। কারণ, সিপিইসি প্রকল্পটি নিয়ে প্রথম থেকেই আপত্তি করে আসছে নয়াদিল্লি। এর মাধ্যমে পাক অধিকৃত কাশ্মীর দিয়ে রাস্তা তৈরি করছে চিন। এ বার পাকিস্তানে বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনে সেখানে ড্রাগনের পা আরও মজবুত হল বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।