ফিলিপিন্সের পর এ বার ইন্দোনেশিয়া। অস্ত্রের বাজারে বাড়ছে ভারতের ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের চাহিদা। অত্যাধুনিক এই হাতিয়ারটি কেনার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই আগ্রহ দেখিয়েছে ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও একাধিক দেশ। এর জন্য চিনের প্রতি নয়াদিল্লির ‘কৃতজ্ঞ’ থাকা উচিত বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) এপ্রিল মাসে ‘ব্রহ্মস’-এর প্রথম ব্যাচ হাতে পায় ফিলিপিন্সের সামরিক বাহিনী। তার কিছু দিনের মধ্যে এই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ হস্তগত করতে নয়াদিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্দোনেশিয়ার সরকার। সূত্রের খবর, এই ইস্যুতে ৪৫ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চলেছে জাকার্তা। প্রসঙ্গত, এর আগে কখনও এত বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি করেনি ভারত।
রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি নয়াদিল্লির ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের তিনটি মূল শ্রেণি রয়েছে। যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান এবং স্থল বাহিনীর লঞ্চার থেকে একে শত্রুর উপর ছুড়তে পারে সেনা। এর নির্মাণকারী সংস্থার নাম ‘ব্রহ্মস অ্যারোস্পেস লিমিটেড’। শব্দের প্রায় তিন গুণ বেশি গতিতে ছুটে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র।
২০০৫ সালের নভেম্বর থেকে এই ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করা শুরু করে ভারতীয় সেনার তিন বাহিনী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে এর চাহিদা হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ার নেপথ্যে চিনের আগ্রাসী মনোভাব এবং সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাভাবনাকেই দায়ী করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, দক্ষিণ চিন সাগর, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শুরু করে গোটা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দিন দিন বেড়ে চলেছে ড্রাগনের ‘পিপলস্ লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌসেনার দাদাগিরি। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপিন্স বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলিকে সমুদ্রে টহলদারিতে পর্যন্ত বাধা দিচ্ছে বেজিং। ফলে রক্ষণাত্মক পদক্ষেপ হিসাবে দূরপাল্লার অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র আমদানিতে জোর দিচ্ছে এই সমস্ত রাষ্ট্র।
দক্ষিণ চিন সাগরে একটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করেছে পিএলএ নৌসেনা। সামুদ্রিক ‘নাইন-ড্যাশ লাইন’-এর উপর ভিত্তি করে গত কয়েক বছর ধরেই গোটা এলাকাটি মূল চিনা ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি জানিয়ে আসছেন ড্রাগনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, কৃত্রিম দ্বীপ থেকে বড়সড় অভিযানের জন্য সেনাকে প্রস্তুত করছেন তিনি। ফলে ফিলিপিন্স বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
দক্ষিণ চিন সাগরের একটি কাল্পনিক সামুদ্রিক রেখা হল বেজিংয়ের ‘নাইন-ড্যাশ লাইন’। এই রেখার মধ্যে পড়ছে একাধিক দ্বীপ এবং দেশ। কাল্পনিক রেখাটির উপরে থাকা সমস্ত এলাকাকেই নিজেদের বলে দাবি করে ড্রাগন। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে চিন সীমান্ত সংঘাত বেড়েই চলেছে।
গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ়’-এর (আইআইএসএস) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ফিলিপিন্সের ‘বিশেষ আর্থিক অঞ্চলে’ (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জ়োন বা ইইজেড) প্রায়ই ঢুকেছে চিনা যুদ্ধজাহাজ। এই সময়সীমার মধ্যে অন্তত ১২ বার ড্রাগন নৌসেনার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার জন্য ভারতের ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্র কার্যকর হবে বলে মনে করছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সেনাকর্তারা। এই অস্ত্র হাতে পেলে চোখের নিমেষে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে অনায়াসেই হামলা চালাতে পারবেন তাঁরা। ডোবানো যাবে চিনা রণতরী। পাশাপাশি ব্রহ্মসের নিশানায় চলে আসবে ড্রাগনের কৃত্রিম দ্বীপের সেনাছাউনিও।
প্রায় সাড়ে আট মিটার লম্বা ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্র ৩০০ কেজি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম। এর সাহায্যে পরমাণু হামলাও চালানো যেতে পারে। এক একটি ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্রের ওজন তিন হাজার কেজি। বর্তমানে একে ‘হাইপারসোনিক ক্যাটেগরি’তে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন ভারত ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। সে ক্ষেত্রে শব্দের আট গুণ বেশি গতিতে ছুটতে পারবে ‘ব্রহ্মস’। এর পাল্লা বেড়ে দাঁড়াবে দেড় হাজার কিলোমিটার।
বর্তমানে ভারতীয় সেনা এবং নৌবাহিনী যে ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে, তার পাল্লা ৮০০ কিলোমিটার। অন্য দিকে এ দেশের বিমানবাহিনীর হাতে থাকা এই হাতিয়ার ৪৫০-৫০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। যদিও রফতারির ক্ষেত্রে ২৯০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার শ্রেণির ‘ব্রহ্মস’ সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি।
ফিলিপিন্সকে ‘ব্রহ্মস’ রফতানির বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন ভারতীয় নৌসেনার অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ক্যাপ্টেন ডি কে শর্মা। তাঁর কথায়, ‘‘ম্যানিলা আমাদের থেকে যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলি কিনেছে, সেগুলি ব্রহ্মসের উপকূলীয় ব্যাটারি ইউনিট বলা হয়। জাকার্তার সেনাকর্তারাও একই ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে চাইছেন বলে খবর পেয়েছি। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে চুক্তি ঐতিহাসিক হতে চলেছে। এর ফলে আগামী দিনে ড্রোন এবং অন্যান্য হাতিয়ার রফতানির বাজারের অন্যতম বড় দাবিদার হয়ে উঠতে পারবে ভারত।’’
চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) প্রজাতন্ত্র দিবসে (২৬ জানুয়ারি) প্রথামাফিক দিল্লির কর্তব্যপথে কুচকাওয়াজের আয়োজন করবে ভারতীয় ফৌজ। সূত্রের খবর, সেখানে প্রধান অতিথির আসনে থাকবেন ইন্দোনেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রবোও সুবিয়ান্তো। আসন্ন ভারত সফরে ‘ব্রহ্মস’ প্রতিরক্ষা চুক্তি তিনি সেরে ফেলবেন বলে জানা গিয়েছে। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও ঘোষণা করা হয়নি।
ভারতীয় নৌসেনার অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক কমডোর অনিল জয় সিংহ জানিয়েছেন, কৌশলগত দিক থেকে ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিকে ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবেশদ্বার বলা যেতে পারে। এর তিনটি চোকপয়েন্ট রয়েছে। সেগুলি হল, মলাক্কা, সুন্দা এবং লম্বক। তিন প্রণালীরই অবস্থান ইন্দোনেশিয়ায়।
নৌসেনা কর্তাদের দাবি, যুদ্ধের সময়ে এই তিন চোকপয়েন্ট বন্ধ হয়ে গেলে সমস্যায় পড়বে ড্রাগনের জলযোদ্ধারা। তখন চিনা রণতরী এবং মালবাহী জাহাজগুলি এক মহাসাগর থেকে অন্যত্র যেতে পারবে না। আর তাই ইন্দোনেশিয়ার উপর প্রভাব বাড়ানোর যাবতীয় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেজিং। দ্বীপরাষ্ট্রটির বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উপরেও নজর রয়েছে প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় নিজের অবস্থান ধরে রাখার ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, এতে নয়াদিল্লির ফৌজি শক্তির আন্দাজ পাবে গোটা দুনিয়া। দ্বিতীয়ত, এতে আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে হাতিয়ারের বাজারে আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, চিন বা তুরস্কের পাশাপাশি উঠে আসতে পারে ভারতের নাম।
‘ব্রহ্মস’-এর পাশাপাশি মধ্য এশিয়ার দেশ আর্মেনিয়াকে ‘পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার’ বিক্রি করেছে নয়াদিল্লি। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই হাতিয়ারটিরও বিশ্ববাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে। সূত্রের খবর, এটি কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে ফ্রান্সও।
পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার সিস্টেমের নকশা তৈরি করেছে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘ডিআরডিও’ (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন)। এই এমবিআরএল থেকে ৭৫ কিলোমিটার পাল্লার রকেট ছোড়া যায়। মাত্র ৪৪ সেকেন্ডে ১২টি রকেট ছুড়তে পারে পিনাকা।
সব ছবি: সংগৃহীত।