মাসের শেষ রবিবার বরাবরই বিশেষ। ছুটির দিন সকাল থেকেই রেডিয়ো চালিয়ে বসে পড়েন অনেকে। প্রতি মাসে শেষ রবিবার সেই রেডিয়োতেই নিজের মনের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
এপ্রিল মাসের শেষ রবিবার মোদীর ‘মন কি বাত’ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। ১০০তম পর্বে মনের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তা নিয়ে সকাল থেকেই আগ্রহের পারদ ছিল তুঙ্গে। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হল কি?
অনেকেই বলছেন, মোদীর শততম এই মনের কথায় ‘মন’ ভরেনি আদৌ। সকাল ১১টা থেকে প্রধানমন্ত্রী রেডিয়োতে বলতে শুরু করেন। সাড়ে ১১টার কিছু পরেই শ্রোতাদের কাছ থেকে বিদায় নেন। এই সময়ের মধ্যে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি শ্রোতাদের। তবে পাল্টা এক পক্ষের মতামত, আন্তর্জাতিক শ্রোতার কথা মাথায় রেখেই বক্তব্য দীর্ঘায়িত করেননি মোদী।
ঠিক কী কী বলেছেন মোদী? শততম পর্ব কোন কোন ‘মনের কথা’ দিয়ে তিনি সাজিয়েছিলেন? অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিলেন তিনিই। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে, আন্তর্জাতিক শ্রোতার কাছে রবিবার পৌঁছে গিয়েছে মোদীর ‘মন কি বাত’।
রবিবারের ‘মন কি বাত’-এ মোদী শততমের গণ্ডিতে দাঁড়িয়ে এই প্রায় ৯ বছরের যাত্রাকে পিছন ফিরে দেখেছেন। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কত নতুন প্রকল্প, আন্দোলনের জন্ম হয়েছে, দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও কত নতুন ভাবনা প্রকাশ্যে উঠে এসেছে, তার স্মৃতিচারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
মোদী জানান, ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ থেকে শুরু করে ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘আজ়াদি কা অমৃত মহোৎসব’ কিংবা ‘ক্যাচ দ্য রেইন’ (জলশক্তি অভিযান)— একের পর এক গণ আন্দোলন গড়ে উঠেছে তাঁর এই রেডিয়ো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ‘মন কি বাত’-এ বার বার স্বীকৃতি পেয়েছে দেশবাসীর গুণাগুণ।
‘মন কি বাত’ প্রধানমন্ত্রীর ‘মনের কথা’ থেকে আসলে হয়ে উঠেছে দেশবাসীর ‘মনের কথা’। ‘আমি থেকে আমরা’ হয়ে ওঠার এই যাত্রা প্রধানমন্ত্রীর আবেগ ছুঁয়েছে বার বার। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে জনতাই ঈশ্বর।’’
প্রধানমন্ত্রীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার স্বপ্নও ‘মন কি বাত’-এ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলে জানান তিনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে নিজেদের মনের কথা খুলে বলতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাবনাও ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে।
শততম ‘মন কি বাত’ উপলক্ষে এই বিশেষ অনুষ্ঠানটি বিদেশেও সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দফতরে বিশেষ ভাবে সম্প্রচারিত হয় ‘মন কি বাত’। এ ছাড়া, একাধিক বিদেশি ভাষায় তা সরাসরি শোনা গিয়েছে।
এত দিন ‘মন কি বাত’ ২২টি ভারতীয় ভাষায় সম্প্রচারিত হত। আকাশবাণীর ৫০০টিরও বেশি কেন্দ্র থেকে তা শোনানো হয়। তবে রবিবার ছিল সেই চেনা রেডিয়োবার্তায় ‘শততম’ চমক।
ফরাসি, চিনা, ইন্দোনেশিয়ান, টিবেটান, বার্মিজ, বালুচি, আরবি, পশতু, পারসিয়ান, দারি এবং সোয়াহিলি— মোট ১১টি বিদেশি ভাষায় রবিবার সম্প্রচারিত হয়েছে মোদীর ‘মনের কথা’। দুনিয়া জুড়ে কোটি কোটি মানুষ এই অনুষ্ঠান শুনেছেন।
‘মন কি বাত’-এর এই ১০০তম পর্ব নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই প্রচার চালিয়েছিল বিজেপি। রবিবার দেশের নানা প্রান্তে গেরুয়া শিবিরের শীর্ষ নেতারা এই রেডিয়ো অনুষ্ঠান শুনেছেন। অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ থেকে শুরু করে জেপি নড্ডা, একনাথ শিন্ডে— রেডিয়োতে কান পেতেছিলেন অনেকেই।
ভারতের প্রতিটি রাজ্যের রাজ্যপাল রাজভবন থেকে দূরদর্শনের মাধ্যমে শুনেছেন প্রধানমন্ত্রীর মাসিক অনুষ্ঠান। এ ছাড়াও, বিজেপি দেশ জুড়ে ‘মন কি বাত’ শোনানোর ব্যবস্থা রেখেছিল। টিভি, রেডিয়োয় কান পাততে দেখা গিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদেরও।
দেশবাসীকে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু অনেকের বক্তব্য, ‘মন কি বাত’-এর মেঘ যতটা গর্জাল, ঠিক ততটা বর্ষাল না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ মতামত শুনবেন বলে বসেছিলেন শ্রোতারা। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
এই মতের নেপথ্যে যুক্তিও অবশ্য আছে। সমর্থকদের একাংশের পাল্টা দাবি, শততম এই পর্বকে ‘লোকাল’ থেকে ‘গ্লোবাল’ রূপ দেওয়া হয়েছিল। বিদেশ থেকেও অনেকে অনুষ্ঠান শুনছিলেন। সেই কারণেই এই ‘মন তি বাত’-এ দেশের অভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। আন্তর্জাতিক শ্রোতার প্রেক্ষিতেই বার্তা সাজিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
২০১৪ সালের ৩ অক্টোবর ‘মন কি বাত’-এর যাত্রা শুরু করেছিলেন মোদী। ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর সেই অনুষ্ঠানের একটি পর্বেই তিনি শুনিয়েছিলেন এই অনুষ্ঠানের জন্মকথা। কেন দেশবাসীর কাছে নিজের মনের কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য রেডিয়োকেই বেছে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী?
মোদী জানান, ১৯৯৮ সালে হিমাচল প্রদেশে বিজেপি নেতা হিসাবে বিশেষ কাজে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে রাস্তার ধারের এক দোকান থেকে চা খেতে গিয়েছিলেন। চা চাইলে আগে তাঁর দিকে মিষ্টি এগিয়ে দেন দোকানি।
প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী রেডিয়োতে ভারতের পরমাণু শক্তির পরীক্ষা নিয়ে কিছু বলেছিলেন। তা শুনেই উচ্ছ্বসিত দোকানি সেই দিন চায়ের আগে সকলকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছিলেন। এই গল্প শুনে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় রেডিয়োর জনপ্রিয়তার কথা প্রথম মনে হয়েছিল মোদীর।
টিভি বর্তমানে সহজলভ্য। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামে টিভি সকলের নাগালে নেই। মোবাইল ফোনের বাহুল্যও তেমন চোখে পড়ে না সর্বত্র। কিন্তু দেশের প্রায় প্রতি কোনায় পৌঁছে যেতে পারে বেতার সংযোগ।
সেই থেকেই ‘মন কি বাত’-এর জন্ম হয়। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণের পর এই অনুষ্ঠানের সূচনা করেন তিনি। দেশবাসীর সঙ্গে যোগাযোগের এই মাধ্যম গত ৯ বছরে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
ছবি: সংগৃহীত।