ভারতে লিথিয়ামের খনি আবিষ্কার হয়েছে। সম্প্রতি সে কথা ঘোষণা করেছে ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ বা জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (জিএসআই)। তাদের ঘোষণার পর থেকেই চর্চায় বহুমূল্য এই ধাতু।
মূলত ব্যাটারি তৈরিতে কাজে লাগে লিথিয়াম। ব্যাটারি শিল্পে এই ধাতুর গুরুত্ব অপরিসীম। ধাতুটি বেশ বিরল। ফলে, চাহিদা অনুযায়ী এর দামও আকাশছোঁয়া।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি মোবাইল থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, বৈদ্যুতিন গাড়ি— সবেতেই কাজে লাগে। লিথিয়াম ধাতুর খনি তাই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতকে অনেকাংশে এগিয়ে দেবে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।
যে কোনও বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতিতে লিথিয়াম কাজে লাগে। তবে এই ধাতুর তৈরি ব্যাটারি বৈদ্যুতিন গাড়িতে অপরিহার্য। ভারতে উৎপন্ন লিথিয়ামের ব্যাটারি গাড়িতে ব্যবহার করা হলে দেশের পরিবহণ ক্ষেত্রে জোয়ার আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভারতের নানা প্রান্তে বৈদ্যুতিন গাড়ি চলতে দেখা যায়। দিন দিন সেই গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। এই ধরনের গাড়িতে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর গ্যাসের উপস্থিতি কম।
জ্বালানি পুড়িয়ে এই সব গাড়ি থেকে ধোঁয়া বার হয় না। ফলে পরিবেশ দূষণ অনেক কম হয়। কিন্তু এই গাড়ি চালানো অপেক্ষাকৃত খরচসাপেক্ষ। কারণ জ্বালানি তেলের পরিবর্তে যে ব্যাটারির সাহায্যে এই গাড়ি চলে, তার অন্যতম মূল উপকরণ লিথিয়াম।
এত দিন ভারতে লিথিয়ামের অস্তিত্ব জানা ছিল না কারও। এই ধাতু অনেক টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত। ভারতেই লিথিয়ামের খনি মেলায় বৈদ্যুতিন গাড়ির খরচ কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। খরচ কমানো গেলে রাস্তায় বাড়বে পরিবেশবান্ধব এই ধরনের গাড়ির সংখ্যাও।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, লিথিয়াম আবিষ্কারের ফলে ভারতের রাস্তায় বৈদ্যুতিন গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ভারতকে কার্বনমুক্ত করে তোলা যাবে এই ধাতুর হাত ধরেই।
ভারতের ন্যানো প্রযুক্তি সংস্থা ‘লগ নাইন মেটিরিয়াল্স’-এর পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠাতা পঙ্কজ শর্মা বলেন, ‘‘ভারত সরকার যখন বৈদ্যুতিন গাড়ির ব্যাটারি তৈরি করে সবুজ গতিশীলতায় জোর দিচ্ছে, সে সময় লিথিয়াম নিয়ে জিএসআই-এর নতুন ঘোষণা আশার সঞ্চার করেছে। এতে দেশেই লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি প্রস্তুত করা যাবে। প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যও বাড়বে।’’
যে কোনও রিচার্জেবল ব্যাটারি তৈরির অন্যতম উপাদান লিথিয়াম। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহৃত হয় এমন মোবাইল, ল্যাপটপ বা অন্যান্য ডিভাইস ওজনে অপেক্ষাকৃত হালকা হয়। এই ধরনের ব্যাটারিতে চার্জও অনেক বেশি ক্ষণ থাকে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানেও লিথিয়ামের ব্যবহার রয়েছে। মানসিক অবসাদ কিংবা বাইপোলার ডিজ়অর্ডারের মতো মানসিক রোগের চিকিৎসায় এই ধাতু ব্যবহার করা হয়। মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে শান্তি আনে লিথিয়াম।
কাচের তৈরি জিনিসপত্র শক্তিশালী করতেও লিথিয়াম ব্যবহৃত হয়। এই ধাতুর ভূমিকা রয়েছে মৃৎশিল্পেও। লিথিয়াম প্রয়োগ করলে কাচ বা চিনামাটির দ্রব্যের গলন দ্রুত হয়। এগুলির গলনাঙ্ক কমাতে সাহায্য করে লিথিয়াম।
লিথিয়ামের খনি মূলত রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকায়। বিশ্বের সমগ্র লিথিয়াম ভান্ডারের ৫০ শতাংশ পাওয়া যায় ওই মহাদেশের তিনটি দেশ থেকে। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া এবং চিলিতে প্রচুর পরিমাণে লিথিয়াম রয়েছে।
লিথিয়ামের খনি রয়েছে চিনেও। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা বিশ্বের লিথিয়াম ভান্ডারের ৭.৯ শতাংশ রয়েছে চিনে। আকরিক থেকে লিথিয়াম উৎপাদনেও অনেক এগিয়ে চিন।
চিন থেকে লিথিয়াম আমদানি করে ভারত। সেই আমদানির পরিমাণ কমলে ভারতের পক্ষে তা লাভজনক হবে। চিনের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের নিরিখেও এই লিথিয়াম নির্ভরতা কমানো আবশ্যক।
তবে লিথিয়াম আবিষ্কার নিয়ে এখনই বেশি মাতামাতি করতে রাজি নন অনেকে। কারণ খনির সন্ধান মিললেও লিথিয়াম উৎপাদনে এখনও সময় লাগবে।
খনি থেকে তোলা লিথিয়াম পরিশোধনের প্রক্রিয়া খুব সহজ নয়। ভারতের হাতে সেই প্রযুক্তি এখনও নেই। যে হেতু ভারতে লিথিয়ামের অস্তিত্ব কারও জানা ছিল না, তাই এত দিন লিথিয়াম পরিশোধনের প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাননি।
নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে খনির লিথিয়াম পরিশোধন করে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারলে নানা ক্ষেত্রে ভারতের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে, মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
ছবি: সংগৃহীত।