চোয়াল ভাঙা। চোখের তলায় কালি। শীর্ণকায়া, কঙ্কালসার চেহারার সুনীতা উইলিয়ামসের ছবি দেখে চমকে উঠেছিল সারা বিশ্ব। মহাকাশে আটকে থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূত নভোচরের স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে জল্পনা তৈরি হয়েছিল, তা হলে কি ভাল নেই সুনীতা?
তবে সেই সব জল্পনার অবসান ঘটেছে। মহাকাশ থেকেই সুনীতা বার্তা দিয়েছেন, তিনি ভাল আছেন, সুস্থ এবং স্বাভাবিক আছেন। চিন্তার কোনও কারণ নেই।
এর পরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সুনীতা যদি সুস্থই থাকেন, তা হলে তাঁর শরীরের এই অবস্থা কেন? কেন এমন রুগ্ন দেখাচ্ছে নভোচরকে?
৫ জুন ফ্লরিডা থেকে সুনীতাদের নিয়ে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল বোয়িং স্টারলাইনার। গন্তব্য ছিল মহাকাশে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন। সেই সময় সুনীতার ওজন ছিল ৬৩ কেজি। তবে কয়েক দিন আগে তাঁর শীর্ণকায় ছবি প্রকাশ্যে আসার পর উদ্বেগ বাড়ে।
সকলের দুশ্চিন্তা কাটিয়ে নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে মুখ খোলেন সুনীতাই। জানান, মহাকাশে প্রায় ১৫০ দিন পার করে ফেলেছেন। দীর্ঘ দিন মহাকাশে থাকার ফলে শরীরে তরল পদার্থ সংক্রান্ত বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আর এই কারণে চেহারার এমন বদল ঘটেছে।
মঙ্গলবার নিউ ইংল্যান্ড স্পোর্টস নেটওয়ার্ক ক্লাবহাউস কিডস শোয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় সুনীতা এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
সুনীতা আরও জানিয়েছেন, তিনি একদম সুস্থ এবং স্বাভাবিক রয়েছেন। চিন্তার কোনও কারণ নেই। প্রকাশ্যে আসা ছবি প্রসঙ্গে বলেন, “মহাকাশে শরীরের তুলনায় আমাদের মাথা অনেক বড় দেখতে লাগে। কারণ, আমাদের শরীরের মধ্যে যে সব তরল পদার্থ থাকে তা সমান ভাবে বইতে পারে না। মস্তিষ্কে জমা হয়। তরল সংক্রান্ত কিছু পরিবর্তনের কারণেই ছবিতে অন্য রকম দেখতে লাগছিল আমায়।”
ভেঙে যাওয়া চোয়াল এবং শীর্ণকায় চেহারার ছবি প্রকাশ্যে এলেও সুনীতা তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে নিশ্চিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন বলেই মনে করছেন অনেকে।
তত্ত্ব বলছে, মহাকাশে থাককালীন অনেক শারীরিক পরিবর্তন হয়। ওজন কমতে থাকে। শরীরে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে তরল বয়ে যেতে পারে না। তরলের গতিবিধি বদলায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তরল মস্তিস্কে জমতে থাকে। এর ফলে শরীরে অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হয়। দৃষ্টি ক্ষীণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক দিন ধরেই এই বিষয়ে গবেষণা চালাচ্ছে নাসা।
২০২০ সালের এপ্রিলে একটি বিবৃতি অনুযায়ী, নাসার মহাকাশচারী অ্যান্ড্রু মরগান আমেরিকার একটি সংস্থার ‘ফ্লুইড শিফ্টস’ গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন।
সেই গবেষণাতেও উঠে আসে, ‘‘মহাকাশে শরীরের তরল ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে মাথার আয়তন এবং চাপ বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে লক্ষণীয় ভাবে রেটিনা ফুলে যায় যা চোখের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’’
সুনীতার বক্তব্যেও সেই কথাই বলা হয়েছে। পাশাপাশি সুনীতা জানিয়েছেন, তিনি আগের চেয়ে সুস্থ রয়েছেন। ওজন কমার দাবি উড়িয়ে জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন মহাকাশে থাকার কারণে বরং তাঁর ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুনীতার কথায়, ‘‘আমার ঊরু একটু বড় হয়েছে, আমার পশ্চাদ্দেশ একটু ভারী হয়েছে। আমরা অনেক স্কোয়াট (এক ধরনের শরীরচর্চা) করি।’’
নাসার মুখপাত্র জিমি রাসেলও জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে থাকা মহাকাশচারীদের নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করানো হয়। তাঁদের নিরীক্ষণের এক জন শল্যচিকিৎসকও রয়েছেন। সুনীতারা ভাল আছেন বলেও জানিয়েছেন রাসেল।
সুনীতা এবং নাসার তরফে ‘ভাল থাকা’র দাবি করা হলেও ওই অভিযানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নাসার এক কর্মচারীর দাবি, সুনীতার ওজন কমেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সূত্রকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, সুনীতার ওজন কমে গিয়েছে এবং তাঁর শরীরে হাড় এবং চামড়া ছাড়া কিছু নেই।’’ আর তার পরেই সুনীতার স্বাস্থ্য নিয়ে রহস্য আরও ঘনিয়েছে।
যদিও এই নিয়ে কোন দাবি সত্য আর কোন দাবি মিথ্যা, তা বোঝার জো নেই। তবে সুনীতা ভাল থাকুন, সকলে তেমনটাই চাইছেন ।
উল্লেখ্য, মূলত আট দিনের নির্ধারিত মহাকাশ সফরে গিয়েছিলেন সুনীতা। সেই পরিধি বেড়ে পাঁচ মাসে দাঁড়িয়েছে বোয়িং স্টারলাইনার মহাকাশযানের প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে।
এই অভিযানের সঙ্গে নাসার যে সব কর্তা ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত, তাঁরাও সুনীতার শারীরিক অবস্থার অবনতি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। আর সে কারণেই তাঁর স্বাস্থ্যের উপর কড়া নজর রাখছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
নাসা জানিয়েছে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সুনীতাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। নতুন করে একটি মহাকাশযান পাঠানো হবে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে (আইএসএস)। তত দিন সুনীতারা সেখানেই থাকবেন। ফেব্রুয়ারিতে ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেস এক্সের ‘ক্রু ড্রাগন’ মহাকাশযানের মাধ্যমে তাঁদের ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানা গিয়েছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।