সময়কাল ১৯৮৯থেকে ১৯৯০-এর মাঝামাঝি। কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয় একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান। কিন্তু জন্মের খবর পেয়েই পরিবারের লোক সেই সন্তানকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মেয়ে হয়ে জন্মানোই নাকি তার দোষ। এ কোনও সিনেমার গল্প নয়, বরং বাস্তবে এই ঘটনা ঘটে বলি অভিনেত্রী পূজা চোপড়ার সঙ্গে।
২০১৩ সালে ‘কম্যান্ডো: আ ওয়ান ম্যান আর্মি’ ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। বিদ্যুৎ জামওয়ালের বিপরীতে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল পূজা চোপড়াকে। বড় পর্দায় এর আগেও তাঁকে দেখা গেলে মুখ্যচরিত্রে এই প্রথম বার অভিনয় করে দর্শকের মন জিতে নিয়েছিলেন অভিনেত্রী।
এর আগে মধুর ভান্ডারকর পরিচালিত ‘ফ্যাশন’ এবং ‘হিরোইন’ ছবিতে পূজা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেও অভিনয়ের পরিসর ছিল স্বল্প। তবে, বড় পর্দায় তাঁর আবির্ভাব হিন্দি ছবির মাধ্যমে নয়। ‘পোন্নার শঙ্কর’ নামের তামিল ছবির মাধ্যমে পূজা অভিনয়জগতে পা রাখেন।
তবে তাঁর এই যাত্রা খুব একটা সহজ ছিল না। জন্মের পর থেকেই তাঁর জীবনে একের পর এক বাধা এসেছে। কলকাতার এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে বিয়ে করেন পূজার মা নীরা। বিয়ের পর প্রথম কন্যা সন্তানের (শুভ্রা) জন্ম দেওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে তাঁকে একঘরে করে দেওয়া হয়।
অসুস্থ শাশুড়ির সেবা এবং একা হাতে মেয়েকে মানুষ করে স্বামীর মন জিতবেন বলে ভেবেছিলেন নীরা। কিন্তু এর ফলে হিতে বিপরীত হয়। অভিযোগ, তাঁর স্বামী দিনের পর দিন বাড়িতে অন্য মহিলাদের নিয়ে আসতেন।
এই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বারের জন্য অন্তঃসত্ত্বা হলেন নীরা। সেই সময়েই তাঁর স্বামী বাড়িতে এক মহিলাকে নিয়ে এসে পরিবারের সকলকে জানান, ওই মহিলাকে বিয়ে করবেন তিনি। নীরা ভাবেন, পুত্রসন্তানের জন্ম দিলে বুঝি এই বিয়ে আটকাতে পারবেন।
ঠিক তখনই জন্ম হয় পূজার। কন্যাসন্তান জন্মের খবর পেয়ে পরিবারের কেউ-ই নীরাকে হাসপাতালে দেখতে যাননি। হাসপাতালে নীরার পাশের বেডে আরও এক মহিলা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে নতুন পোশাক ধার করে পূজাকে পরান তিনি।
শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর নীরাকে নির্দেশ দেওয়া হয় পূজাকে অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দিতে। তা না করলে দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। পূজাকে কোনও মতোই নিজের কোলছাড়া করতেন না নীরা। তাই কলকাতার বাড়ি ছেড়ে দুই মেয়েকে নিয়ে মুম্বই চলে যান তিনি।
অন্য দিকে নীরার স্বামীও আর একটি বিয়ে করেন এবং দুই পুত্রসন্তানের বাবা হন। মুম্বইয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করবেন বলে চাকরির খোঁজ করতে শুরু করেন নীরা। এক মাস বয়স থেকেই পূজাকে একা বাড়িতে থাকতে হত।
এক সাক্ষাৎকারে পূজা জানান, তাঁর মা যখন বাইরে কাজ করতেন, তখন তিনি খুবই ছোট। খিদে পেলে প্রতিবেশীই তাঁকে স্তন্যপান করাতেন।
মাকে এ ভাবে কষ্ট করতে দেখে ছোট থেকেই পূজা জীবনের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে পড়েন। স্কুলে সবসময় প্রথম স্থান অধিকার করতেন তিনি। ধীরে ধীরে মডেলিংয়ের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন পূজা।
কিন্তু মডেলিং করতে হলে ঠিক মতো শরীরচর্চা করা প্রয়োজন। তাই চাকরি করে টাকা জমিয়ে জিমে ভর্তি হন। সেই জমানো টাকা দিয়ে মডেলিংয়ের জন্য পোশাক, জুতো কেনেন। কোনও রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই মডেলিং শুরু করেন পূজা।
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে খ্যাতিলাভ করার পর তিনি বিভিন্ন নামী ব্র্যান্ডের মুখ হিসাবেও সামনে আসেন।
বহু সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় তিনি বিজয়ী হন। কিন্তু ২০০৯ সালে এক সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার অন্তিম পর্বে অংশগ্রহণ করার আগে পূজার পা মচকে যায়। চিকিৎসক তাঁকে তিন সপ্তাহ বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন।
কিন্তু পূজা ওই অবস্থাতেও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং বিজয়ী হন। জেতার পর তিনি তাঁর শৈশবের অভিজ্ঞতা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার পর পরিচিতিও বাড়তে থাকে পূজার। তার পরেই বড় পর্দায় অভিনয় করার সুযোগ পান তিনি।
বর্তমানে মডেলিং জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকার পাশাপাশি তিনি সমাজসেবাও করেন। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন পূজা। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য তাদের আর্থিক সহায়তা করেন অভিনেত্রী।