বিদেশের মাটিতে বসে ফোন করে টাকা চাওয়া হচ্ছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে। বার বার আসছে হুমকি। টাকা না দিলে ক্ষতি করে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হচ্ছে। ভেসে আসছে বড় বড় গ্যাংস্টারদের নাম। এ দিকে পুলিশে অভিযোগ জানিয়েও বিশেষ লাভ হচ্ছে না। কোথা থেকে সেই ফোন আসছে? কোন নম্বর থেকে? সহজে কূলকিনারা পাচ্ছেন না তদন্তকারীরাও।
হুমকি ফোন বা তোলাবাজির তদন্তের কিনারা করতে গিয়ে এক প্রকার হিমশিম খেতে হচ্ছে তদন্তকারীদের। আর সেই আবহেই ভেসে আসছে নতুন এক অপরাধ পদ্ধতির নাম। ‘ডাব্বা কলিং’।
গত কয়েক মাস ধরে দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের মতো রাজ্যের পুলিশ এই ‘ডাব্বা কলিং’ অপরাধের সমাধানের চেষ্টা করে চলেছে।
সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ডাব্বা কলিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা তোলে মূলত বিদেশে বসবাসকারী গ্যাংস্টারেরা।
এর মধ্যে রয়েছে গোল্ডি ব্রার (পঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালা হত্যাকাণ্ডের মূলচক্রী মনে করা হয় যাঁকে), রোহিত গোদারা এবং আনমোল বিষ্ণোইয়ের মতো কুখ্যাত গ্যাংস্টারদের নাম।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাঁদের থেকে টাকা চেয়ে হুমকি দেওয়া হয়, তাঁদের বেশির ভাগই নির্মাতা, ঠিকাদার, বড় ব্যবসায়ী, গাড়ি ব্যবসায়ী, ক্লাব বা হোটেলের মালিক, অবৈধ কল সেন্টারের মালিক এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদ। কখনও কখনও হাওয়ালার সঙ্গে যুক্তদেরও হুমকি ফোন করে টাকা চাওয়া হয়।
কিন্তু কী এই ডাব্বা কলিং? প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্যাংস্টারেরা প্রথমে ঠিক করে যে কোন বিত্তশালীর থেকে টাকা চাওয়া হবে। এর পর টাকা তুলতে দেশে থাকা তাদের দালালদের কাজে লাগায় ওই অপরাধীরা।
গ্যাংস্টারের স্থানীয় সহযোগীরা প্রথমে মোবাইলের ইন্টারনেট ব্যবহার করে ‘টার্গেট’কে ফোন করেন। এর পর অন্য একটি মোবাইল থেকে ফোন করা হয় বিদেশে বসে থাকা বস্কে।
দু’টি ফোনই স্পিকারে দিয়ে পাশাপাশি রেখে দেওয়া হয়। এর পর বিদেশে বসে থাকা গ্যাংস্টার বিত্তশালী টার্গেটকে ‘প্রোটেকশন মানি’ বা অন্য কোনও সাঙ্কেতিক শব্দ ব্যবহার করে টাকা দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু দু’জনের মধ্যে সরাসরি কথা হয় না।
তদন্তকারীরা যখন অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নামেন তখনই পুরো বিষয়টি নিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাঁদের। যে হেতু গ্যাংস্টারের মোবাইল থেকে সরাসরি ফোন আসে না, তাই তদন্তকারীদের হাতেও প্রমাণ থাকে না।
তদন্তকারীদের এ ভাবে সমস্যায় ফেলে ঘটিয়ে ফেলা অপরাধের নামই ‘ডাব্বা কলিং’। দু’টি আলাদা মোবাইল ব্যবহার করে বিশেষ পদ্ধতিতে এই হুমকি ফোনগুলি করা হয় বলেই এ রকম নাম।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যখন এই হুমকি ফোনগুলি করা হয় তখন গ্যাংস্টার এবং তার সহযোগীরা আলাদা আলাদা জায়গায় থাকে। ‘টার্গেট’ এবং বিদেশে থাকা গ্যাংস্টারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করেন সহযোগীরা।
বিভিন্ন দেশ থেকে ‘ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল (ভিওআইপি)’, অর্থাৎ ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওই ফোন করে টাকা চায় কুখ্যাত অপরাধীরা।
এই ধরনের ফোনগুলি বেশির ভাগই ‘ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন)’ ব্যবহার করে করা হয়। ভিপিএন এমন একটি ইন্টারনেট ব্যবস্থা যা এক জন ব্যক্তির অনলাইন পরিচয় গোপন রাখে৷
ফলে কোথা থেকে সেই সব ফোন আসে এবং কারা ফোন করে, তা খুঁজে পাওয়া তদন্তকারীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
যদি তদন্তকারীরা কখনও ফোন নম্বর ট্র্যাক করতে সক্ষমও হন, তা হলেও গ্যাংস্টারের সহযোগীদের কাছে পৌঁছন তাঁরা। মূল অপরাধী থেকে যান অধরাই।
পাশাপাশি, ডাব্বা কলিংয়ের এই চক্র এমন সব অ্যাপ ব্যবহার করে যা ‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’ বা অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদান করে। এতে অপরাধীদের সমস্ত তথ্য সুরক্ষিত থাকে।
তদন্তকারীরা যখন গ্যাংস্টারের অবস্থান জানতে সংশ্লিষ্ট অ্যাপ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাপের তরফে গ্রাহকের নিরাপত্তার কারণে সেই তথ্য দেওয়া হয় না।
আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে কখনও পুলিশ যদি অভিযুক্ত গ্যাংস্টারের ডেরার খোঁজ পেয়েও যায়, তা হলেও তত দিনে ওই গ্যাংস্টার অন্য কোথাও পালিয়ে গিয়েছেন।
যদি কোনও ভারতীয় আইপি ব্যবহার করে ফোন করাও হয়, তা হলে পরে জানা যায় যে, সিমটি জাল নথি দিয়ে কেনা হয়েছে।
সম্প্রতি দিল্লি পুলিশের সদর দফতরে একটি বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ আধিকারিকেরা। বৈঠকে ‘ডাব্বা কলিং’ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে সূত্রের খবর।
সব ছবি: সংগৃহীত।