তিরুপতি বিতর্ক নিয়ে তোলপাড় দক্ষিণ ভারতের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ। শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা। লাড্ডু বিতর্ক গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টেও। শুক্রবার এক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন। তাঁর অভিযোগ, প্রসাদী লাড্ডুতে পশুর চর্বি মিশিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের ভাবাবেগে আঘাত করা হয়েছে।
আবেদনে দাবি করা হয়েছে, অগণিত ভক্ত যাঁরা এই প্রসাদকে পবিত্র আশীর্বাদ হিসাবে মনে করেন, তাঁরা মানসিক ভাবে আহত হয়েছেন। আবেদনকারী জানিয়েছেন, লাড্ডু বিতর্ক মন্দির প্রশাসনের গাফিলতি।
তিরুপতি মন্দিরের প্রসাদী লাড্ডু নিয়ে বিতর্ক বাড়তেই অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুর কাছে সবিস্তার রিপোর্টও চেয়ে পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নড্ডা।
লাড্ডু বিতর্কের সূত্রপাত অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুর একটি দাবিকে কেন্দ্র করে। তিনি গুজরাতের এক সরকারি ল্যাবের একটি রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনেন। রিপোর্টটি জুলাই মাসের।
সেই রিপোর্টকে সামনে রেখে চন্দ্রবাবু দাবি করেন, তিরুপতির প্রসাদী লাড্ডুতে ব্যবহৃত ঘিয়ের সঙ্গে মেশানো হয়েছে পশুর চর্বি। এই ঘটনার জন্য চন্দ্রবাবু এবং তাঁর ডেপুটি জনসেনা পার্টির প্রধান পবন কল্যাণ দায়ী করেছেন তাঁদের পূর্বতন জগন্মোহন রেড্ডির সরকারকে।
বুধবার চন্দ্রবাবুর এই অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরই শোরগোল পড়ে যায়। শুরু হয় রাজনৈতিক তরজা। তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) এবং জন সেনা পার্টি ছাড়া বিজেপিও বিষয়টি নিয়ে আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সঞ্জয় বান্দির দাবি, এ ভাবে মন্দিরের প্রসাদী লাড্ডুতে পশুর চর্বি মিশিয়ে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এর পরেই ওঠে আইনি পদক্ষেপের দাবি।
ভারতের জনপ্রিয় এই মন্দিরে সারা বছর লাখ লাখ ভক্তের সমাগম হয়। ভক্তদের মধ্যে রয়েছেন নামী তারকা থেকে তাবড় শিল্পপতিরা। তিরুপতি মন্দিরের আরাধ্য দেবতা ভেঙ্কটেশ্বর। যিনি বিষ্ণুর অবতার। বালাজি, গোবিন্দ, শ্রীনিবাস একাধিক নামে ডাকা হয় এই দেবতাকে।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক তিরুপতি মন্দিরের নানা অজানা কথা। তিরুপতির তিরুমালা পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই মন্দিরে দিনে প্রায় ৫০ হাজার দর্শনার্থী আসেন। দশম শতকে নির্মিত মন্দিরটি ১৬.২ একর জুড়ে রয়েছে।
তিরুপতি মন্দির বিশ্বের অন্যতম ধনী মন্দির। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিরুপতি মন্দিরের মোট সম্পত্তির পরিমাণ নাকি তিন লক্ষ কোটি টাকা, যা বহু নামীদামি সংস্থার মূলধনের চেয়েও বেশি।
বছর দুয়েক আগে তিরুপতি মন্দিরের পরিচালন পর্ষদ ‘তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানম’ (টিটিডি) মন্দিরের মোট সম্পত্তির পরিমাণ নিয়ে তথ্য পেশ করে। টিটিডির শ্বেতপত্র অনুযায়ী, তিরুমালা মন্দিরের বার্ষিক আয় ১,৪০০ কোটি টাকা।
ভক্তদের অনুদান ছাড়াও মূল্যবান ধাতু, ভক্তদের চুল এবং স্থায়ী আমানতের সুদের পরিমাণই কয়েকশো কোটি টাকার।
তিরুপতি মন্দিরের সম্পত্তির খতিয়ান দেওয়ার পর তৎকালীন টিটিডি চেয়ারম্যান ওয়াইভি সুব্বা রেড্ডি জানিয়েছিলেন দেশ জুড়ে মন্দিরের অছি পরিষদের মোট ৯৬০টি সম্পত্তি রয়েছে। যার মোট মূল্য ৮৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। ১৯৭৪ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন সরকারের আমলে টিটিডির বিভিন্ন অছি পরিষদ ১১৩টি সম্পত্তি বিক্রি করেছে।
জানা গিয়েছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ১৪ হাজার কোটিরও বেশি ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ (স্থায়ী আমানত) রয়েছে। টাকার পাশাপাশি মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে সোনা সংরক্ষিত রাখা রয়েছে ১৪ টনেরও বেশি।
টিটিডি-র প্রধান কার্যালয় তিরুপতিতে। যেখানে হাজার হাজার কর্মী কাজ করেন। ১৯৩২ সালে টিটিডির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
তিরুপতি মন্দিরে প্রসাদ হিসাবে বিশ্ববিখ্যাত ‘তিরুপতি লাড্ডু’ দেওয়া হয়। জিআই (জিয়োগ্র্যাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) ট্যাগের স্বীকৃতি পেয়েছে এই লাড্ডু। টিটিডিই একমাত্র এই লাড্ডু বানাতে ও বিক্রি করতে পারবে। সেই লাড্ডু নিয়েই এত বিতর্ক।
প্রতি দিন হাজার হাজার পুণ্যার্থী ভিড় জমান তিরুপতি মন্দিরে। পুজো দেন। ইচ্ছাপূরণ হলে চুল কাটিয়ে দান করেন ভক্তেরা। এই চুল বিক্রি করে বছরে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেন মন্দির কর্তৃপক্ষ।
দেশে তিরুপতি মন্দিরে ভক্তেরা সব থেকে বেশি চুল দান করেন। তার কারণও রয়েছে। বলা হয়, এই মন্দিরে ভক্তেরা যত চুল দেন, ঈশ্বর তার ১০ গুণ বেশি সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন। কথিত রয়েছে, তিরুপতি মন্দিরে চুল দিলে সন্তুষ্ট হন মা লক্ষ্মী। তাই এখানে শুধু পুরুষ নন, মহিলারাও ইচ্ছাপূরণ হলে চুল দান করেন।
চুল দান নিয়ে অন্য একটি গল্পও প্রচলিত রয়েছে। বলা হয়, অতীতে বালাজির মূর্তির উপর পিঁপড়ের পাহাড় তৈরি হয়েছিল। একটি গরু রোজ এসে ওই পিঁপড়ের পাহাড়ে দুধ দিত। এক দিন দেখতে পেয়ে খুব রেগে যান গরুর মালিক। কুঠার দিয়ে গরুর মাথায় আঘাত করেন।
সেই আঘাত লাগে বালাজির মাথায়। রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আঘাতে বালাজির মাথার চুল ঝরে পড়ে। তা দেখে নীলাদেবী নিজের চুল কেটে সেই ক্ষতের উপর জড়িয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে বালাজির আঘাত সেরে যায়। দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন মন্দিরে রয়েছে নীলাদেবীর মূর্তি।
নীলাদেবীর এই পদক্ষেপে নারায়ণ খুশি হন। জানান, মহিলাদের সৌন্দর্যে চুলের গুরুত্ব রয়েছে। সেই চুলই তাঁর জন্য কেটে ফেলেছিলেন নীলাদেবী। মনে করা হয়, সেই কারণেই তিরুপতি মন্দিরে চুল দিলে ইচ্ছাপূরণ হয়। প্রতি বছর লক্ষ টন চুল দেওয়া হয় তিরুপতি মন্দিরে। পরিসংখ্যান বলছে, বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ টন চুল দেন ভক্তেরা।
মন্দির সূত্রে জানা গিয়েছে, কেটে ফেলা চুল প্রথমে গরম জলে ফোটানো হয়। তার পর তা সাবান দিয়ে ধুয়ে শুকানো হয়। তার পর একটি গুদামে ভরে রাখা হয়। সেই গুদামের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে।
বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে চুল সংরক্ষণ করা হয়। প্রথম ভাগে পড়ে ২৭ ইঞ্চির বেশি দৈর্ঘ্যের চুল। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ১৯ থেকে ২৬ ইঞ্চি দীর্ঘ চুল। তৃতীয় ভাগে রয়েছে ১০ থেকে ১৮ ইঞ্চি লম্বা চুল। চতুর্থ ভাগে রাখা হয় পাঁচ থেকে ন’ইঞ্চি লম্বা চুল। পাঁচ ইঞ্চির কম দৈর্ঘ্যের চুল রাখা হয় পঞ্চম ভাগে।
একটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, প্রথম ভাগের চুল প্রতি কেজিতে প্রায় ২,৯০০ থেকে ৩০০০ টাকায় বিক্রি হয়। দ্বিতীয় ভাগের চুল বিক্রি হয় ২,৬০০ টাকা কেজি দরে।
সেই চুল অনলাইনে নিলাম করা হয়। নিলাম করে তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানম। আর তা করে কোটি কোটি টাকা আয় করেন কর্তৃপক্ষ। বিক্রি হয় চিন, আমেরিকা-সহ ইউরোপ, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। এই চুল দিয়ে তৈরি হয় ‘উইগ’ বা পরচুল।
একটি সংবাদমাধ্যম দাবি করেছিল, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে তিরুপতি মন্দির কর্তৃপক্ষ ১ লক্ষ ৪৩ হাজার ৯০০ কেজি চুল বিক্রি করেছিলেন। অনলাইনে সেই চুল নিলাম করে পেয়েছিলেন ১১ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা। প্রতি বছর প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আয় করেন তিরুপতি মন্দির কর্তৃপক্ষ।
সব ছবি: সংগৃহীত।