একের পর এক পেজার বিস্ফোরণে বিপর্যস্ত লেবানন। একই সঙ্গে সিরিয়াতেও পেজার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, এই হামলায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ন’জনের। আহতের সংখ্যা চার হাজার ছুঁইছুঁই। চারপাশে শুধুই স্বজনহারাদের হাহাকার। হাসপাতালগুলোতে তিলধারণের জায়গা নেই।
পেজার হামলার নেপথ্যে ইজ়রায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদকেই কাঠগড়ায় তুলেছে ইরানের মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজ়বুল্লা। সরকারি সূত্রে খবর, এই হামলায় হিজ়বুল্লার একাধিক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের তালিকায় রয়েছে এক কিশোরীও।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের রাষ্ট্রদূতও এই হামলায় আহত হয়েছেন। পেজার হামলার দায় ইজ়রায়েলের উপর চাপিয়ে পাল্টা হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে হিজ়বুল্লা। তবে এই হামলা সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত ইজ়রায়েলের তরফে কোনও বিবৃতি আসেনি।
কী এই পেজার? কী ভাবেই বা সেগুলি লেবানন এবং সিরিয়ায় আনা হল? কী ভাবেই বা প্রাণঘাতী বোমার রূপ দেওয়া হল যন্ত্রগুলিকে?
পেজার হল যোগাযোগ মাধ্যমের একটি যন্ত্র। ২০ শতকের শেষের দিকে যখন সকলের হাতে হাতে মোবাইলের রমরমা ছিল না, সেই সময় যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই পেজার।
পেজারের যান্ত্রিক গঠন মোবাইলের মতো অত জটিল না। এটি একটি সরল বেতার যন্ত্র যা মেসেজ আদান-প্রদান করতে সক্ষম। ফোনের মতো এই যন্ত্রে কথা বলা যায় না। ইন্টারনেটের ব্যবহারও এই যন্ত্রে করা যায় না। পেজার খুব উচ্চ কম্পাঙ্ক বা অতি-উচ্চ কম্পাঙ্কের রেডিয়ো তরঙ্গে কাজ করে।
পেজারের চারটি মূল উপাদান। একটি অ্যান্টেনা যা রেডিয়ো সঙ্কেত গ্রহণ করে, একটি রিসিভার যা আগত বার্তাগুলিকে ডিকোড করে, একটি স্ক্রিন যেখানে সেই বার্তা দেখা যায় এবং একটি ব্যাটারি৷ হাতে বা পকেটে রেখে ঘোরা যায় এই যন্ত্র।
পেজার একমুখী যোগাযোগের যন্ত্র, যার অর্থ এই যন্ত্রে এক সময়ে হয় মেসেজ গ্রহণ করা যায় বা পাঠানো যায়। দুটো কাজ একসঙ্গে চলতে পারে না। তবে পরবর্তীতে দ্বিমুখী পেজারও বাজারে আসে, যা একসঙ্গে বার্তা আদান-প্রদান করতে পারত।
মোবাইল ফোনের রকেট গতিতে উত্থানের কারণে কালের নিয়মে গুরুত্ব হারায় পেজার। ব্যবহার কমে। এই যন্ত্র এখন বিলুপ্তপ্রায়।
তবে খুব কম হলেও বিশেষ কারণে কিছু জায়গায় পেজার এখনও ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে সেই সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে নেটওয়ার্কের হাল খারাপ।
পাশাপাশি, পেজারের মাধ্যমে যোগাযোগ অনেক বেশি নিরাপদ এবং ব্যক্তিগত হিসাবে বিবেচিত হয়। ট্র্যাক করাও সহজ নয়। আর সেই কারণেই বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন বা জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছে এখনও এই যন্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। একই কারণে হিজ়বুল্লাও সেই যন্ত্র এখনও ব্যবহার করে।
সেই পেজারের মধ্যেই বিস্ফোরক রেখে লেবানন এবং সিরিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বলে খবর।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে পেজারগুলিতে বিস্ফোরণ হয়েছে সেগুলি তাইওয়ান থেকে আনানো। তাইওয়ান থেকে মোট পাঁচ হাজার পেজার আনিয়েছিল হিজ়বুল্লা।
তাইওয়ান থেকে পাঁচ মাস আগে আনা ওই পেজারগুলিতেই বিস্ফোরক পুরে দেওয়া হয়েছিল। হিজ়বুল্লার দাবি, এই নজিরবিহীন হামলার নেপথ্যে রয়েছে মোসাদ। ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থার তরফেই কোনও ভাবে বিস্ফোরক পেজারের মধ্যে ভরা হয়েছিল।
লেবাননের নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, পেজারগুলিতে একই সময়ে একটি বিশেষ সাঙ্কেতিক বার্তা পাঠানো হয়েছিল। আর সেই মেসেজ খুলতেই পেজারের ভিতরের বিস্ফোরক সক্রিয় হয়ে বিস্ফোরণ ঘটে।
সূত্রটি রয়টার্সকে বলেছে, ‘‘পেজারের ভিতরে যে যান্ত্রিক বোর্ড মেসেজ গ্রহণের কাজে ব্যবহৃত হয়, সেখানে বিস্ফোরক ভরেছিল মোসাদ। সেই বিস্ফোরক শনাক্ত করা খুব কঠিন। এমনকি, কোনও স্ক্যানারেও ওই বিস্ফোরক ধরা পড়ে না।’’
তাইওয়ানের পেজার প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘গোল্ড অ্যাপোলো’কে পেজারগুলি বানানোর বরাত দিয়েছিল ইরানের মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজ়বুল্লা। এপ্রিল-মে নাগাদ যন্ত্রগুলি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে আসে। যে পেজারগুলি পাঠানো হয়েছিল সেই মডেলটির নাম এপি৯২৪।
সূত্র অনুযায়ী, বেশ কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনা করে পেজার হামলার ছক কষা হয়েছিল। সুযোগ বুঝে পেজারের মধ্যে ভরে দেওয়া হয়েছিল বিস্ফোরক।
অন্য দিকে, সংবাদমাধ্যম ‘স্কাই নিউজ আরাবিয়া’র সঙ্গে কথা বলা হিজ়বুল্লা সূত্রের অভিযোগ, মোসাদ একটি উচ্চ বিস্ফোরক পদার্থ পেজারের ব্যাটারিতে ভরে দিয়েছিল এবং দূর থেকে ব্যাটারির তাপমাত্রা বাড়িয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
কাতারের সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা আবার সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, প্রতিটি পেজারে ২০ গ্রামেরও কম বিস্ফোরক ভরা হয়েছিল।
কী ভাবে এবং কখন পেজারের ভিতরে বিস্ফোরক ভরা হয়েছিল তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। ওই বিস্ফোরক কী ভাবে সক্রিয় করা হল, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সমাজমাধ্যমে এই হামলার পরের বেশ কিছু ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে (যদিও ভিডিয়োগুলির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)। দাবি করা হচ্ছে, লেবাননের রাজধানী এবং তার সংলগ্ন এলাকার রাস্তায় পড়ে শয়ে শয়ে মানুষ। কারও হাত উড়েছে, কারও আবার পা। কেউ আবার চোট পেয়েছেন মাথায়। পরিজনদের খোঁজে উদভ্রান্তের মতো দৌড়তেও দেখা গিয়েছে মানুষজনকে। সামান্য সময়ের পর পর বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত লেবানন এবং সিরিয়ার বিস্তীর্ণ জনজীবন।
পেজার হামলার নিন্দা করে লেবাননের তথ্যমন্ত্রী জিয়াদ মাকারি একে ‘ইজ়রায়েলি আগ্রাসন’ বলে মন্তব্য করেছেন। অন্য দিকে, হিজবুল্লার তরফে এই বিস্ফোরণের জন্য ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার নিয়েছে। একটি বিবৃতি জারি করে সশস্ত্র গোষ্ঠী জানিয়েছে, এই হামলার জন্য ‘ন্যায্য শাস্তি’ পাবে ইজ়রায়েল।
যদিও পেজার বিস্ফোরণ এবং সেই সংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগ নিয়ে এখনও মুখ খোলেনি ইজ়রায়েলের সরকার বা সেনাবাহিনী।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ইরানের মাটিতে হামাস শীর্ষনেতা ইসমাইল হানিয়া এবং ইজ়রায়েলি হানায় হিজবুল্লার সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার নামেহ নাসেরের মৃত্যুতে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি আরও তপ্ত হয়েছে। তার পর থেকে ইজ়রায়েল এবং হিজ়বুল্লার মধ্যে ছোট-বড় সংঘর্ষ লেগেই রয়েছে। কখনও রকেট হামলা, কখনও আবার ড্রোন দিয়ে আক্রমণ— দু’পক্ষের হামলায় উত্তপ্ত পশ্চিম এশিয়া। সেই সঙ্গে ইরানও বিভিন্ন ছক কষছে ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালানোর। সেই আবহেই ঘটল পেজার বিস্ফোরণ।
সব ছবি: সংগৃহীত।