বিয়ের আগের দিন প্রতারিত হয়েছিলেন হবু স্ত্রীর কাছ থেকে। তাঁকে ছেড়ে চলে যান তাঁর ‘সুইট সিক্সটিন’ (প্রেয়সীকে এই নামেই ডাকতেন তিনি)। সেই আঘাতে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে একা হাতে আশ্চর্য এক প্রাসাদই গড়ে ফেলেছিলেন।
কথা হচ্ছে লাটভিয়ার এডওয়ার্ড লেডস্কালনিনের। তাঁর হারিয়ে যাওয়া প্রেম ফিরে পেতে নিজে শেখা বিদ্যা দিয়ে তৈরি করেছিলেন চুনাপাথরের একটি প্রাসাদ, যা আজও রহস্যাবৃত।
প্রেমে আঘাত পাওয়ার পরে লাটভিয়া থেকে আমেরিকার ফ্লোরিডায় চলে গিয়েছিলেন এডওয়ার্ড। সেখানেই তিনি সেই প্রেমসৌধ তৈরি করেছিলেন তিল তিল করে। বলা হয়, বিশ্বের রহস্যাবৃত সব প্রাসাদের মধ্যে এডওয়ার্ডের নির্মাণ অন্যতম।
লাটভিয়ার স্ট্যামেরিয়েনা প্যারিসে ১৮৮৭ সালে এডওয়ার্ডের জন্ম। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল পাথরের প্রাসাদ তৈরির। সেই দক্ষতা তিনি নিজেও অর্জন করেছিলেন।
ফ্লোরিডায় এসে এডওয়ার্ড জমি কিনেছিলেন রুবেন মোসার নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। সেখানেই চুনাপাথরের রহস্যপ্রাসাদ তৈরি করেন তিনি। নাম দিয়েছিলেন ‘এডস প্লেস’।
শোনা যায়, ফ্লোরিডায় আসার সময় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন এডওয়ার্ড। সে সময় মোসারের স্ত্রী তাঁর সেবাযত্ন করেছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি মন দেন প্রাসাদ তৈরিতে।
হারানো প্রেমের জন্য এডওয়ার্ড তাঁর পরবর্তী জীবন কাটিয়েছিলেন শুধু পাথর কেটে এবং বহন করে! প্রাসাদ তৈরির খরচ জোগাড় করতে তিনি বিভিন্ন রকম পেশা গ্রহণ করেছিলেন।
এডওয়ার্ড যে প্রাসাদ ফ্লোরিডায় তৈরি করেছিলেন তাতে বিভিন্ন ধরনের এবং মাপের পাথর রয়েছে। রয়েছে জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া পাথরও, যেগুলির উচ্চতা ২৫ ফুট। ওজনে ৩০ হাজার কিলোগ্রামেরও বেশি।
ফলে সেই প্রাসাদে কিছু পাথর রহস্যময় স্টোনহেঞ্জের থেকেও বড়। কিছুর ওজন গিজার গ্রেট পিরামিডে ব্যবহৃত এক একটি পাথরের থেকেও নাকি বেশি।
এ ছাড়াও প্রাসাদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বহু বিস্ময়। সূর্যঘড়ি, পাথরের রকিং চেয়ারের পাশাপাশি প্রায় ২৩০ কেজির হৃদয়াকৃতি টেবিলও রয়েছে। হারিয়ে যাওয়া প্রেমের প্রতীক হিসাবেই নাকি সেই টেবিল তৈরি করেছিলেন তিনি।
এডওয়ার্ডের প্রাসাদের বিস্ময়কর বিভিন্ন জিনিসের তালিকায় রয়েছে ন’হাজার কিলো ওজনের একটি দরজা। একটি পালকের স্পর্শেই সেই দরজা নাকি ঘুরতে থাকে লাট্টুর মতো।
খুব গোপনে পাথরের প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন এডওয়ার্ড। বেশির ভাগ কাজ করেছিলেন গভীর রাতে, যাতে কেউ তাঁর নির্মাণকৌশল জানতে না-পারে। অনেকেই মনে করেন, একা হাতে ওই প্রাসাদ বানানো সম্ভব ছিল না। তাই জনশ্রুতি রয়েছে, প্রাচীন কোনও জাদুবিদ্যা ব্যবহার করে প্রাসাদটি তৈরি করিয়েছিলেন এডওয়ার্ড।
চিরাচরিত প্রাসাদের থেকে এডওয়ার্ডের তৈরি প্রাসাদ ছিল অনেকটাই আলাদা। সেখানে চুনাপাথরের দেওয়াল, ছাদ এবং আসবাবপত্র এমন ভাবেই ছিল, যা প্রয়োজনে স্থানান্তরও করা যায় এবং তা তিনি করেওছিলেন।
এডওয়ার্ডের নাকি ভয় ছিল, প্রাসাদের রহস্য এক দিন ফাঁস হয়ে যাবে। আর তাই নিজের সৃষ্টিকে ফ্লোরিডা শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে আরও ১৬ কিমি উত্তরে নিয়ে যান তিনি। ৩ বছর ধরে চলেছিল সেই স্থানান্তর পর্ব।
১৯৫১ সালে ৬৪ বছর বয়সে মারা যান এডওয়ার্ড। তাঁর কোনও উইল ছিল না। ফলে পাথরের প্রাসাদ-সহ বাকি সম্পত্তির মালিক হন তাঁর এক দূর সম্পর্কের ভাইপো হ্যারি। হ্যারি আমেরিকার মিশিগানের বাসিন্দা ছিলেন।
শোনা যায়, হ্যারির শারীরিক এবং আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তাই তিনি ওই প্রাসাদ বিক্রি করে দেন। তবে শিকাগোর এক গয়না ব্যবসায়ী জুলিয়ান লেভিনের দাবি ছিল, তিনি ওই জমি কিনেছিলেন ফ্লোরিডার প্রশাসনের কাছ থেকে। এবং তিনি জানতেনও না যে ওখানে একটি প্রাসাদ আছে।
১৯৮১ সালে সেই প্রাসাদ একটি বেসরকারি সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেন লেভিন। এখনও সেই সংস্থার অধীনেই আছে প্রাসাদটি। মালিকানার মতো বদলেছে নামও।
‘এডস প্যালেস’ থেকে ‘রক গেট’, ‘রক গেট পার্ক’ হয়ে স্থাপত্যটির বর্তমান নাম এখন ‘কোরাল ক্যাসল’। এডওয়ার্ডের তৈরি তাঁর ষোড়শী প্রেমিকা তথা হবু স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার স্মৃতিসৌধ আজ পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য।
সব ছবি: সংগৃহীত।