২০১৫ সালের মে মাস। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সাংবাদিক ডেক্লান ওয়ালশের এক প্রতিবেদনে নড়ে গিয়েছিল সারা বিশ্ব। ওয়ালশের সেই প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, কী ভাবে একটি পাকিস্তানি সংস্থা সফ্টঅয়্যার বিক্রির নামে বিশ্ব জুড়ে শুধু ভুয়ো ডিগ্রি বিক্রি করছে এবং কোটি কোটি আয় করেছে।
সেই প্রতিবেদনে এ-ও উঠে আসে, ওই সংস্থা যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়ো ডিগ্রি বিক্রি করছিল, তার অস্তিত্ব ছিল শুধুমাত্র ইন্টারনেটে। বাস্তবে কোথাও সেই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। অধ্যাপকের নাম করে যাঁরা পড়ুয়াদের ভর্তির জন্য ফোন করতেন, তাঁরা ছিলেন বেতনভুক ছোটখাটো অভিনেতা।
এই বিশাল কেলেঙ্কারির নেপথ্যে যে সংস্থার হাত ছিল, তার নাম অ্যাক্স্যাক্ট। মালিক পাকিস্তানি ব্যবসায়ী শোয়েব আহমেদ শেখ।
শোয়েব ছিলেন পাকিস্তানের এমন এক ব্যবসায়ী, যিনি নিজেকে বিত্তশালী বলে দাবি করতেন। সর্বদাই দানধ্যানের বুলি আওড়াতেন। দাবি করতেন পাকিস্তানের এক কোটি শিশুকে পড়াশোনা করানোর।
অ্যাক্স্যাক্ট সংস্থা নিয়ে শোয়েব ব্যাবসা ফেঁদেছিলেন বন্দর শহর করাচিতে। তাঁর সংস্থায় কাজ করতেন দু’হাজারেরও বেশি কর্মী।
অ্যাক্স্যাক্টের কর্মীদের বেশির ভাগই এজেন্ট এবং সেল্সম্যান ছিলেন। ২৪ ঘন্টা কাজ চলত সেই সংস্থায়। এরই আড়ালে চলত ভুয়ো ডিগ্রি বিক্রির কাজও।
বেশ কিছু ছোটখাটো অভিনেতাও নাকি পুষে রেখেছিল অ্যাক্স্যাক্ট। সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে তাঁরা মূলত ভুয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পরামর্শদাতা সেজে পড়ুয়া এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতেন।
মূলত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির টোপ দিয়ে মোটা টাকা নেওয়া হত। এর পর বিভিন্ন সময়ে জাল ডিগ্রি পাঠিয়ে দেওয়া হত পড়ুয়াদের।
বেশি টাকা আদায়ের জন্য নাকি আমেরিকা এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক সেজেও পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলতেন সংস্থার কর্মীরা।
ওয়ালশ তিন মাস ধরে পুরো বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চালিয়েছিলেন। তার পরেই ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
যদিও ওয়ালশের আগে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সংবাদমাধ্যম গাল্ফ নিউজ়ের সাংবাদিক মাজহার ফারুকি বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছিলেন।
২০১৪ সালে গাল্ফ নিউজ়ের প্রতিবেদনে প্রথম উল্লেখ করা হয়েছিল, কী ভাবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির এমন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাল ডিগ্রি বিক্রি করা হচ্ছে, বাস্তবে যার কোনও অস্তিত্বই নেই। যদিও সেই প্রতিবেদনে অ্যাক্সাক্টের নাম করা হয়নি।
তবে হইচই শুরু হয় নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর। এর পরেই শোয়েবের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে পাকিস্তান। যদিও শোয়েবের দাবি ছিল, নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদন ‘মিথ্যা’ এবং তাঁকে বদনাম করার ‘ঘৃণ্য প্রচেষ্টা’।
দ্য প্রিন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে আলাদা করে এই নিয়ে তদন্ত শুরু করেছিলেন মাজহারও। কয়েক জন ভারতীয় সাংবাদিকের কাছে অ্যাক্স্যাক্টের নাম এবং বেশ কিছু নথি ইমেল করেন তিনি। এর পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে, অ্যাক্সাক্টের এই ভুয়ো ডিগ্রি বিক্রির ব্যবসায় মদত রয়েছে দাউদ ইব্রাহিম এবং তাঁর ডি কোম্পানির।
বেশ কিছু ভারতীয়ও নাকি বিদেশি ডিগ্রির আশায় পরোক্ষ ভাবে অ্যাক্সাক্টের দুর্নীতির কোষাগার ভরেছিলেন। ৫০০ থেকে চার হাজার ডলারে বিক্রি হত সেই সব ডিগ্রি। দু’হাজারেরও বেশি ভারতীয় নাকি অ্যাক্সাক্টের থেকে ভুয়ো ডিগ্রি কিনেছিলেন।
তদন্তে উঠে আসে, দেড়শোর বেশি দেশে ২ লক্ষ ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষের কাছে ভুয়ো ডিগ্রি বিক্রি করেছিল অ্যাক্সাক্ট।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিগ্রি বিক্রি করেই নাকি বার্ষিক ৫০ কোটি ডলার আয় ছিল অ্যাক্সাক্টের।
অন্য দিকে তদন্তে উঠে আসে, শোয়েব শুধু ভুয়ো ডিগ্রিই বেচতেন না। আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দেশগুলির বেশ কয়েকটি শেল কোম্পানির মালিক ছিলেন তিনি। এই সংস্থাগুলি ব্যবহৃত হত কালো টাকা সাদা করার জন্য। কয়েক দিন পরেই গ্রেফতার হন শোয়েব।
২০১৬ সালের অগস্টে শোয়েবকে অর্থ পাচারের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। শোয়েব প্রাথমিক ভাবে অন্যান্য ফৌজদারি অভিযোগ থেকেও খালাস পেয়ে যান। অভিযোগ ওঠে, বিচারককে ঘুষ দিয়েছিলেন তিনি।
পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি এই কেলেঙ্কারিকে ‘জাতীয় লজ্জা’ বলে অভিহিত করেন। ২০১৮ সালে শোয়েব এবং অন্য ২২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রত্যেক দোষীকে ১৩ লক্ষ টাকা করে জরিমানা দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
২০২৩ সালের মার্চে সিন্ধ হাই কোর্ট এবং ইসলামাবাদ হাই কোর্ট শোয়েবকে সব অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস করে।
সব ছবি: সংগৃহীত।