দেহের বেশির ভাগ অংশ বড় বড় লোমে ঢাকা। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে যেন মানুষ নয়, অবিকল এক নেকড়ে! মানুষের চেহারা যদি বাস্তবেই নেকড়ে বা বানরের মতো হয়, তা হলে তা হৃৎকম্প ধরাতে বাধ্য।
নেকড়ে-মানব নিয়ে অসংখ্য দেশি-বিদেশি লোককাহিনি প্রচলিত রয়েছে। লোককাহিনি মানেই বেশির ভাগ সময় তা কল্পনার বুননে তৈরি বলে ধরে নেওয়া হয়।
রুপোলি পর্দায় মানব-নেকড়ে বা ওয়্যারউল্ফের দেখা মিললেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক প্রচুর। সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশে এক কিশোরের সন্ধান মিলেছে, যার সারা দেহ নেকড়ের মতো লোম দিয়ে ঢাকা।
১৭ বছর বয়সি ললিত পাটীদার নামের ওই কিশোরের কোনও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও তার মুখ ও শরীর ছেয়ে গিয়েছে ঘন লোমে।
এই কিশোরের বাস ভারতের মধ্যপ্রদেশের নন্দলেতা গ্রামে। সমবয়সিদের অনেকেই তাকে উপহাস করে বানর বা নেকড়ে বলে ডাকে।
একাধিক সংবাদমাধ্যমে ললিতের বিষয়টি উঠে এলে তাকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় দেশ জুড়ে। সম্প্রতি সে তার যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছে সংবাদমাধ্যমে, যা শুনে মন ভারাক্রান্ত হতে বাধ্য।
সত্যিই কি এই কিশোর রূপান্তরিত হতে চলেছেন নেকড়েয়? না কি বিরল কোনও রোগে আক্রান্ত ওই কিশোর?
দ্বিতীয় আশঙ্কাই সত্যি। হাইপারট্রাইকোসিস নামের এক বিরল রোগে ভুগছে সে। ছয় বছর বয়সে প্রথম এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় ললিতের শরীরে। ধীরে ধীরে সারা শরীরে অস্বাভাবিক হারে লোম বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বিরল রোগের কারণে অদ্ভুত চেহারার ললিতকে স্কুলে, বাড়ির আশপাশে, পরিচিত মহলে সকলের কাছে ঠাট্টা ও উপহাসের পাত্র হতে হয়েছে।
ললিত সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছে, তার কিছু সহপাঠী বিশ্বাস করেছিল যে ললিত তাদের কামড় দিতে পারে। অনেক শিশুই তাকে দেখে পাথর ছোড়ে এবং তাকে দেখে বাঁদর বলে চিৎকার করে। ব্যাপারটি এখানেই থেমে থাকেনি। কয়েক জন দাবি করেছিল ললিত কোনও স্বাভাবিক মানুষ নয়। তার মধ্যে ‘ভৌতিক’ কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ললিত। তার বাবা একজন কৃষক। বর্তমানে, সে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। বহু অপমান ও উপহাস কাটিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে সে। শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি তাকে লড়তে হয় মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধেও।
ললিতের অবস্থা মেনে নিতে তার পরিবারের কিছু সময় লেগেছিল। কারণ এটি যে একটি রোগ, তা বুঝতেই অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছিল তাঁদের।
হাইপারট্রাইকোসিস এমন একটি বিরল অবস্থা, যেখানে পুরো মুখ এবং শরীরকে ঢেকে দিতে পারে চুল। শরীরের ছোট ছোট অংশে হঠাৎ করেই লোম গজিয়ে উঠতে পারে। এই রোগটি পুরুষ এবং মহিলা উভয়কেই প্রভাবিত করতে পারে।
গোটা বিশ্বে মাত্র ৫০ জন মানুষ এই বিরল রোগের শিকার। জন্মের পর অথবা বয়সের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হাইপারট্রাইকোসিস প্রকাশ পেতে পারে।
পেট্রাস গনজ়ালেস নামে স্পেনের এক বাসিন্দা হাইপারট্রাইকোসিস রোগে ভুগছিলেন, এবং তিনি সম্ভবত চিকিৎসাশাস্ত্রে নথিভুক্ত হওয়া হাইপারট্রাইকোসিসের প্রথম রোগী। ‘ক্যানারিয়ান ওয়্যারউল্ফ’ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে উত্তরাধিকার সূত্রে তার মেয়ে অ্যান্টোনিয়েটাও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
বিরল এই রোগে আক্রান্ত ফিলিপিন্সের এক শিশুও। ‘ওয়্যারউলফ সিনড্রোম’ বা হাইপারট্রিকোসিসে আক্রান্ত সে।
জিনগত ত্রুটির কারণে এই রোগটি হয়। এখনও কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই এই রোগের। তাই শুধুমাত্র ইলেক্ট্রোলাইসিস বা লেজ়ার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চুলের পরিমাণ কমিয়ে রাখা হয়।
নিয়মিত লোম ছেঁটে দেওয়া বা বৃদ্ধির আগেই নির্মূল করা ছাড়া উপায় নেই। এখনও পর্যন্ত কোনও নিরাময় নেই এই বিরল রোগটির।
সব ছবি: সংগৃহীত।