Painting review

অতুলনীয় শিল্পের অনন্ত আবেদন

আর্ট কলেজে পড়ার সময় থেকেই গণেশ পাইন অবনঠাকুরের ভক্ত। রবি ঠাকুরের আঁকার কাব্যিক ভাবও তাঁর খুব পছন্দের ছিল। ডাচ শিল্পী রেমব্রান্তের দ্বারাও বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি।

Advertisement
শমিতা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:২০
ছবি: সিমা গ্যালারি, কলকাতা।

ছবি: সিমা গ্যালারি, কলকাতা।

সেন্টার অব ইন্টারন্যাশনাল মডার্ন আর্ট (সিমা) ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শিল্প জগতে নতুন কিছু করার জন্য এবং শৈল্পিক সীমানাকে আরও প্রসারিত করার জন্য। প্রতিষ্ঠানের ৩০ বছরের জন্মদিনের এই অবিস্মরণীয় যাত্রা উদ্‌যাপন করা হবে আগামী ছ’মাস ধরে। সিমা-র ৩০তম অ্যানিভার্সারি শোয়ে দেখা যাবে নানা ধরনের প্রদর্শনী। ১২ জন শিল্পীর (‘টুয়েলভ মাস্টার্স’) প্রদর্শনীকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আগামী এপ্রিল পর্যন্ত চলবে প্রদর্শনীগুলি।

Advertisement

প্রথম পর্ব ‘ফ্যান্টাসি টু সাবলাইমিনাল’-এ যে চারজন শিল্পীর কাজ দেখা গেল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন গণেশ পাইন, সুষেণ ঘোষ, অর্পিতা সিংহ এবং শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়।

আর্ট কলেজে পড়ার সময় থেকেই গণেশ পাইন অবনঠাকুরের ভক্ত। রবি ঠাকুরের আঁকার কাব্যিক ভাবও তাঁর খুব পছন্দের ছিল। ডাচ শিল্পী রেমব্রান্তের দ্বারাও বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। বিশেষ করে রেমব্রান্তের আলো এবং কালোর ব্যবহারের দিকটি। বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই গণেশ পাইন নিজস্ব একটি ভাষা সৃষ্টি করেছিলেন, যাতে ধারালো অ্যাঙ্গুলার লাইন ছিল এবং কিছুটা স্কেলিটাল ফর্মও ছিল। চারকোল এবং কালো পেন্সিলের মিশ্রণ ছাড়াও ক্রস হ্যাচিং এবং সরু সরু লাইন দিয়ে টেক্সচার সৃষ্টি করতে শুরু করেন শিল্পী। টেম্পেরায় কাজ করতে ভালবাসতেন তিনি, কিন্তু সে টেম্পেরা একান্ত ভাবেই তাঁর নিজস্ব।

প্রদর্শনীতে গণেশ পাইনের একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে সারথি কৃষ্ণকে। আর অর্জুন রথে মাথা নিচু করে বসে আছেন। টেম্পেরার কাজ, যথেষ্ট টেক্সচার-সমৃদ্ধ। কৃষ্ণকে পুরো অন্ধকারে রেখে দিয়েছেন। টোনের ব্যবহার অনবদ্য। অপর একটি কাজ মিশ্র মাধ্যমে করা, কাগজের উপরে। এখানে তিনি দেখিয়েছেন যুধিষ্ঠিরের নরকদর্শন। চারকোল কালো পেন্সিল এবং ক্রেয়নে করা কাজ। টোনাল তারতম্যই এই ছবির বিশেষত্ব। শিল্পীর মনোজগতে মৃত্যু নিয়ে একটা বিশেষ ভাবনা চিরকালই ছিল। তারই প্রকাশ ঘটেছে এ ছবিতে। নিদারুণ গঠন এবং বিন্যাসবহুল ছবি।

এ বারে বলা যায় আরও একটি ছবির কথা। নাম, ‘ম্যান উইথ করপ্স’। এটি ক্যানভাসে টেম্পেরার কাজ। নানা বর্ণের মাঝে হলুদ রঙের প্রাধান্য। একটু বার্নট সিয়েনা, সামান্য বার্নট অ্যাম্বার, তার সঙ্গে আলট্রামেরিন নীলের ছিটেফোঁটা। অনবদ্য ছবি। ছবিতে শবদেহ নিয়ে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে, তার যেন কোনও অনুভূতি নেই, শুধু ক্ষুরধার চোখ দু’টি ছাড়া।

এখানে দর্শকের বিশেষ পাওনা হল, মিশ্র মাধ্যমে করা ‘জটিংস’। দুঃখের বিষয়, এগুলির কোনও সন-তারিখ উল্লেখ করা নেই। এই সমস্ত জটিংস বা স্কেচ গ্রাফ পেপারের উপরে প্রধানত পেন অ্যান্ড ইঙ্কে করা। এগুলি থেকে গণেশ পাইনের গভীর চিন্তাভাবনার একটা সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়।

এর পরে ভাস্কর সুষেণ ঘোষের কাজ। কলাভবনের এই প্রাক্তনী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এবং রামকিঙ্কর বেজ ছাড়াও নন্দলাল বসুর কাছ থেকেও শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। ‘সব সঙ্গীত যখন শেষ হয়, তখনকার সেই স্তব্ধতাই হচ্ছে আমার ভাস্কর্য’— বলেছেন সুষেণ ঘোষ। এখানে আমরা শিল্পী রামকিঙ্কর বেজের মাথার একটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য দেখতে পাই। বাস্তুবানুগ প্রতিকৃতি এটি নয়। মানুষটির অন্তরের শান্ত, সমাহিত রূপ এখানে ধরা পড়েছে।

‘ফিগার’ নামের টেরাকোটার কাজটিও লক্ষণীয়। মাথা, হাত, পা-বিহীন এই শিল্পকর্মের ভিতরে একটি অন্তর্নিহিত গতি আর স্তব্ধতা একই সঙ্গে ধরা পড়ে।

সুষেণ ঘোষের আরও একটি কাজ ‘মনুমেন্ট অব লাইনস’। এটি ব্রোঞ্জের একটি ডিপটিক। পাশাপাশি রাখা দু’টি ব্রোঞ্জের কাজ, যেখানে কঠোরতা এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছে, যাকে তপস্যাই বলা চলে। তারই সঙ্গে একটি মজার খেলাও আছে।

সুষেণের বিভিন্ন মাধ্যমে করা নানা রকম কাজ দেখা গেল প্রদর্শনীতে। সঙ্গীতের তাল-লয়ের স্তব্ধতার সঙ্গে অঙ্কের খেলা প্রায় সব স্থাপত্যগুলিতেই অনুভব করা যায়। যে রকম আলো, অন্ধকার এবং তার মাঝামাঝি একটা টোন থাকে আর্টে, সেই রকম বৈপরীত্য নিজের কাজে অনায়াসে নিয়ে এসেছেন শিল্পী, চরম বিমূর্তকরণের মাধ্যমে।

তৃতীয় শিল্পী অর্পিতা সিংহ। ষাটের দশকে ছবি আঁকা শুরু করেন অর্পিতা। ক্রমশ নিজের একটি সম্পূর্ণ ভিসুয়াল মাধ্যম সৃষ্টি করেছেন। তাঁর ছবিতে অনেক রকম চিহ্ন, প্রতীক, রেখা, আকৃতি, রঙের প্রাচুর্য থাকে। চটপটে ব্রাশওয়ার্কে অনবদ্য সব সচিত্রকরণ! অর্পিতার জলরং ব্যবহারের কায়দাটিও সম্পূর্ণ নিজস্ব এবং খুবই আকর্ষক। তাঁর সাম্প্রতিক কালের ছবির পটভূমিতে বিমূর্ত রং বসিয়ে তার উপরে মানুষ আঁকেন শিল্পী। ওই মানুষেরা তাদের সাধারণ জীবনচর্যায় হয়তো কিছু একটা করছে। তার পটভূমিতে কিছু টেক্সটও লেখা থাকে অনেক সময়ে।

প্রদর্শনীতে অর্পিতার একটি কাজ চোখে পড়ে, ক্যানভাসের উপরে তেল রঙের ছবি। নাম, ‘স্মুদ রুট’। ছবিটিতে এক মানুষের হাতে একটি পিস্তল এবং অন্য হাতে একটি গোলাপ ফুল। প্রেক্ষাপটে অনেক টেক্সট রয়েছে। তাতে বিশেষ করে কলকাতার রাস্তার নাম দেখা যাচ্ছে। মানুষটির মুখের অভিব্যক্তিতে তাকে ঠিক সৎ বলে মনে হয় না।

অপর একটি অসাধারণ ছবি, নাম ‘উয়োম্যান চেঞ্জিং ক্লোদস’।‌ ক্যানভাসে করা রঙিন ছবি। অর্ধনগ্ন মাঝবয়সি নারী পোশাক পরিবর্তন করছেন। কোঁচকানো চামড়া, ভারী শরীর এবং অগোছালো বিছানা ছাড়া আর কিছুই নেই। নেপথ্যের পটভূমিতে উজ্জ্বল রং। মোটা তেলরঙে করা এই ছবিটি অসামান্য। প্রদর্শনীতে শিল্পী অর্পিতার কিছু পেন অ্যান্ড ইঙ্কের ড্রয়িং এবং কয়েকটি এচিংও দেখা গেল।

শিল্পী শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়ের কাজও ব্যতিক্রমী। শিল্প ইতিহাসে শিক্ষকতা করেন। তাঁর ছবিতে শিশুসুলভ এক সরলতা, সহজ টোনের ব্যবহারে সচিত্রকরণ দর্শককে অবাক করবে। কিন্তু চিনে বা জাপানি ছবিতে যে সরলতা পাওয়া যায়, তা কিন্তু শ্রেয়সীর ছবিতে নেই। অনেক কিছুর ব্যবহারে বিমূর্ত উপস্থাপনা থাকে। কিন্তু শ্রেয়সীর উপস্থাপনায় গভীর দর্শন না পাওয়া গেলেও বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে শিল্পী একটা প্রভাব সৃষ্টি করেন, যা বিস্ময়কর। তাঁর বিশেষত্ব হল, তিনি ক্যানভাসের উপরে অ্যাপ্লিক, সুচের কাজ, জলরং, পেন্সিলের কাজ, অ্যাক্রিলিক ইত্যাদি বহুবিধ টুকরো টুকরো উপাদান ব্যবহার করে অদ্ভুত এক জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন। সমস্ত শিল্পশিক্ষা মাথা থেকে বার করে দিয়ে শ্রেয়সী নিজস্ব এক অনাবিল মিডিয়াম এবং স্বাধীন ভাষা তৈরি করতে পারেন। তাঁর ছবির মধ্যে একটি ছবির নাম ‘গুড ডে’, আর একটি ‘কো-এগজ়িস্ট্যান্স, অপর একটি ছবি ‘সান ফ্লাওয়ার্স’। সব ক’টি মুগ্ধকর।

সিমা গ্যালারির তরফে এতজন গুণী শিল্পীর কাজ একত্র করে তুলে ধরার এই প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। গ্যালারির জন্মদিন উপলক্ষে এই আয়োজন শিল্পরসিকদের কাছে যেন এক বাড়তি পাওনা।



আরও পড়ুন
Advertisement