গোষ্ঠীবদ্ধ: দ্য ক্যানভাস আর্টিস্টস সার্কল গ্রুপের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
ষাটের দশকের শুরুতে আমহার্স্ট স্টিটের একটি বাড়িতে গড়ে উঠেছিল ‘দ্য ক্যানভাস আর্টিস্টস সার্কল’ গ্রুপ। সেই সময়ের আর্ট কলেজের কিছু তরুণের স্বপ্ন ছিল, শিল্পে ঐতিহাসিক ছাপ রাখবেন। ভারতীয় জাদুঘরের রেলিংয়ে প্রথম প্রদর্শনী করে দলটি শুরু করেছিল। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে এ বারের এই দল নিবেদন করল তাদের ৬২ বছরের বার্ষিক প্রদর্শনী।
প্রদর্শনীতে ছবি ও ভাস্কর্যের বিচারে প্রথমেই অবাক করে দেন দলের সদস্য হারীৎ বসু। তাঁর সাতটি ভাস্কর্য ছিল প্রদর্শনীতে। একটি ভাস্কর্যে সবজে ভাব আনার জন্য পাতিনার ব্যবহার না করে, নর্দমার পাশে মাটি খুঁড়ে ভাস্কর্যটি রেখে, তিনমাস পরে বার করে তাকে ধুয়ে, রোদে দিয়ে সুন্দর এফেক্ট এনেছেন শিল্পী। আর একটি ইন্টারেস্টিং কাজ নেট কেটে নিয়ে শেপ দেওয়ার চেষ্টায় তৈরি হয়েছে ‘শরশয্যা’। এখানে দু’টি বডি— পাণ্ডব ও কৌরব, দু’দিক রক্ষায় ভীষ্মের দু’টি মর্মভেদী ফিগার।
এক সময়ে আন্দামানে থাকায় বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়কে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বরিষ্ঠ চিত্রকর স্বপ্নেশ চৌধুরী। শিল্পীর সাম্প্রতিক কাজেও ছিল তারই প্রতিফলন। তাঁর ‘দ্য ম্যারেজ সংস’ ছবিতে ওয়ারলি উপজাতীয় ফর্ম এলেও, ফর্মগুলিতে শিশুর সারল্য ফুটে উঠেছে।
ব্যতিক্রমী কাজের নমুনায় শিল্পী তন্দ্রা চন্দ বিভিন্ন গ্লাসের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য। ফিউজ় গ্লাস, অরিজিনাল স্টেন গ্লাস ও স্লাম্পড গ্লাসের পরীক্ষিত সাপোর্টে বাংলার বিষয় উঠে এলেও, নির্মাণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিদেশি পদ্ধতির নিয়ম মেনে করেছেন শিল্পী। আর্কিটেকচার নিয়ে কাজের সুবাদে গৌরী ভৌমিকের ড্রয়িংয়ে স্ট্রাকচারাল ফর্ম দেখা যায়। মধ্যরাতের ক্যানভাসে, ক্রোম ইয়েলো ও ভারমিলিয়নের ঘনবসতি পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয় রঙের উষ্ণতায়।
প্রবীণ শিল্পী বলাই কর্মকারের ‘গ্রিন ফরেস্ট’-এর তিন ভাগে ছিল টোনাল ব্রাশিংয়ের চারটি লেয়ার। নীচের দু’টি লেয়ারে পার্সপেক্টিভ অনুযায়ী ছায়ার নরম আবেদন গোটা চিত্রপটের সৌন্দর্য ধরে রাখে। হলুদ ব্যাকগ্রাউন্ডে অজস্র টুকরো টুকরো শেপের অলঙ্কারে বর্ষীয়ান শিল্পী দেবাশিস ভট্টাচার্য প্রাণিজগতের আচরণ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। শিল্পী তপন চট্টোপাধ্যায়ের তিনটি অয়েল পেন্টিংয়ের ‘মিউজ়িক অব লাইফ’ ছবিটি অনাবৃত কামের একটি স্বপ্নিল অন্বেষণ। রঙের তীব্র বৈপরীত্যে ছবিটি বিশেষ ভাবে নজরে পড়ে।
বিশিষ্ট শিল্পী ও প্রাক্তন শিক্ষক সুবিমলেন্দু বিকাশ সিংহের তেলরঙের ‘অ্যাগনি’ কাজে মূল ফিগার ও তার চারপাশের মুহূর্ত প্রকাশে, তাৎক্ষণিক ইমোশনকে সূক্ষ্ম রেখায় এঁকেছেন। ছবিটির নিজস্ব গুণই টেনে আনে স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী জুয়ান গ্রিসের সমতল ভঙ্গের কিউবিজ়ম। শিল্পী দেবকুমার চক্রবর্তীর উপস্থাপনাটি বেশ মজার। বক্তব্যের সঙ্কেত থাকলেও, কোনও রূপক বা প্রতীকের সাহায্য নেননি। সরাসরি এনেছেন আইনস্টাইন এবং গাধা। চারপাশে যে ধরনের ‘বাঁদরামো’ চলছে, তার প্রতিক্রিয়ায় দু’জনেই লজ্জায় জিভ কাটছে।
অ্যাক্রিলিকে দু’টি বড় ক্যানভাসে দৃশ্যায়িত হয়েছে বিশিষ্ট শিল্পী ললিত মাইতির ‘বেনারস’। বাস্তব অনুষঙ্গ থাকলেও, চারকোলে ড্রয়িং করে, জিয়োমেট্রিক মোটিফে জড়ো করেছেন মন্দির, সোপান, ত্রিশূল, ধুনুচি এবং সাধুর আসল উদ্দেশ্য। টেক্সচার হোয়াইট এবং রঙের কড়া মেজাজে ছবির আকর্ষণ ছিল তীব্র। শিল্পী অশোক রায়ের কাজেও রঙের জোরালো ভূমিকা দেখা যায়, যেমন ‘দশমহাবিদ্যা’, ‘শ্রীকৃষ্ণ কাহিনি’। ছবির প্রাথমিক লেপনে গোল্ডেন ওয়াশের রাজকীয় প্রকাশ পুরাণের ধারক হয়ে ওঠে।
শিল্পী সুবীর কয়ালের ড্রাই ব্রাশিংয়ে বিমূর্ত রূপকল্পনার রং মন্দ লাগে না। অস্তিত্বের দাবিতে নারীর ক্ষোভ, বিস্ময় ফোটাতে মিহির কয়াল সাম্প্রতিক ঘটনার ছায়া ফেলেছেন। অভিব্যক্তি প্রকাশে আলো ফেলা হয়েছে মুখের কিছু অংশে। বাকিটা অতিরিক্ত ডার্কের প্রয়োগে যে ভলিউম, তা সুররিয়ালিজ়মের অনুসারী। মানিক কান্দারের কাজে যন্ত্রণার সঙ্কেতে স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ স্পেস ও পার্সপেক্টিভের ধারণায় কাজের পুনরাবৃত্তি থাকলেও ফর্মের নতুনত্ব ছবির আর এক দিক খুলে দেয়।
৬২ বছরের এই প্রতিষ্ঠানটিতে অগ্রজ গোষ্ঠীর বিচারে বেশ কিছু নতুন শিল্পী তালিকাভুক্ত হয়েছেন অবশ্যই যোগ্যতার বিশ্লেষণে। আগামীর কাজ সে কথাই বলে।