মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়।
আবার একটি নারীদিবস। ‘আটকৌড়ে বাটকৌড়ে ছেলে আছে ভাল’। আঁতুড় ঘর থেকে এই শব্দ শুনে সদ্য জননী হওয়া মায়েরা এক সময় আহ্লাদিত হতেন। পুত্রের জন্ম দেওয়াটা ছিল লটারি জেতার আনন্দ। ‘মেয়ে’ এবং ‘ঝি’ সমার্থক। ঠাকুরঝি-বোনঝি-ভাইঝি আর ‘মোক্ষদা ঝি’ কোথাও আলাদা নয়। যৌনকর্মীর গণতান্ত্রিকতা লাভের মতো ‘মোক্ষদা ঝি’-রা এখন ‘কাজের মাসি’। নারীদিবস আসে, নারীদিবস যায়— ‘চালের মাসি, চালের পিসি, চাল তোলো গো লালগোলা বনগাঁয়’। এখন অঙ্গনওয়াড়ি থেকে মিডডে মিলের রাঁধুনি মেয়েদের কর্মপরিসর বেড়েছে। হয়তো রাঁধুনিকে ‘অন্নপূর্ণা’ ডেকে গ্লানিমোচনের পৌরুষময় ষড়যন্ত্র আবডালে থেকে হেসেছে। অন্তরীক্ষে নারী নারীকে শিখিয়েছে, ‘একসঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাক। আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি’। সেল্ফহেল্প গ্রুপ নারীর অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
এ বছরের ২৬ জানুয়ারি বম্বে হাইকোর্ট আমাদের অক্সিজেন কম করিয়ে হাই তুলিয়ে ছেড়েছিল একটি রায়দানে। পোশাকের আবরণের উপর দিয়ে নারীশরীর ছুঁলে পুরুষের নাকি অপরাধ নেই। রে-রে করে উঠেছিলাম আমরা। নারীশরীর নাকি মননশীল শরীর নয়, শুধুই চামড়া। ত্বক উজ্জ্বলের যত ক্রিম সব নারীদের জন্য। বিউটি পার্লার পর্যন্ত তাই। এখনও হ্যান্ডসম পার্লার খোলার প্রয়োজন পড়েনি। পুরুষ প্রসাধন নির্ভর নয়, যেহেতু একটি শক্ত হাত লোহার মতো একটি নরম মেয়েকে আগলে রাখে। আগলে থাকায় একটি মেয়ে যে গলে যায়, তার খবর কেউ রাখে? হ্যাঁ, প্রথমে অবশ্যই এই আগলে রাখায়, একটি মেয়ে আনন্দে গলে যায়, আহ্লাদে গলে যায়। তার পরে যত দিন যায়, ওই আগলে রাখাটা হয়ে ওঠে কণ্ঠরোধী অর্গল। তখন ওই আগলে রাখায় মেয়েটি গলে যায়। পচে গলে যায়।
আমরা ৮ মার্চের অপেক্ষায় হাঁটু গেড়ে বসে থাকি বছর ভর। ৮ মার্চ কি ‘লকডাউন’ থেকে ‘আনলক’-এ পৌঁছনোর একটি দিন? আমায় কত গৃহবধূ ফোন করেন, নিজেদের দুঃখের কথা জানান সারা বছর। আমি শুনি, ‘হয়ে ওঠা নারী’ আসলে নারী আর পুরুষের মাঝে ছোট এক হাইফেনের মতো। এই যে ‘অর্ধেক আকাশ’-এর মিথ্যে বুলি— এটা সম্ভব হয়েছে, আকাশ নিছক শূন্য বলেই। মেয়েদের জন্য অদৃশ্য খাঁচা আজও ভীষণ ভাবে বিদ্যমান। এত নারীশিক্ষা, সচেতনতার অনুষ্ঠান— তবু বাংলা ধারাবাহিকে ‘রাসমণি’ থেকে ‘নয়নমণি’, সর্বত্রই অসংখ্য নারীর জটিল মনস্তত্ত্ব সাংসারিক বাস্তবতায় জনপ্রিয়। কেন না, সিরিয়াল শুধু মেয়েরাই দেখে। পুরুষের সিরিয়াল দেখা মানে পাপ! ঘরকুনো মেনিমুখোরাই সিরিয়াল দেখতে পারে। ‘মাচো’রা নয়।
এখনও যখন হু-হু বাইপাসে দেখি একটি মেয়ে পুরুষের বাইকে তার পিঠে লেপ্টে আছে পরম সমর্পণে, মনে হয়, এটাই তো আদি এবং আদিম চরিত্র।
অনেক আগের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী তখন অশীতিপর। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, নারীদিবস নিয়ে তিনি কী ভাবেন? আশাপূর্ণা আক্ষেপ করে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন একটা পুরুষবর্ষ হয় না? আশাপূর্ণা জানতেন, ৩৬৫ দিনই পুরুষের। তার থেকে একটি দিন ধার নিয়ে নারীদিবস করা মানে, নারীর একাকিত্বকে আরও বেশি একা করে দেখানো। সংসারে সমাজে নারীকে অজস্র বাধার সম্মুখীন হয়ে আত্মপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। তাতেও শুনতে হয়, মেয়েমানুষের অত বাড় ভাল নয়। কোথাও কোথাও ‘মেয়েমানুষ’ শব্দটি আবার ‘মেয়েছেলে’ হয়ে যায়। অর্থাৎ ছেলের মতোই আলগা উদার মেয়ে অর্থাৎ কি না ‘পাবলিক মেয়ে’, যাকে বলে ‘দুশ্চরিত্রা’। একমাত্র একটি মেয়েই উপলব্ধি করতে পারে, জন্মগত সূত্রে সামাজিক পারিবারিক ভাবে একটি মেয়ে কত একা।
টিভিতে দেখছিলাম, শিল্পপতির মেয়ের বিয়ে হয়েছিল আর এক শিল্পপতির ছেলের সঙ্গে। বিয়ের পরে পরেই আত্মহত্যা সেই ধনী সুন্দরী মেয়েটির। শ্বশুরবাড়িতে চরম গঞ্জনা। এমনকি তার মৃত্যুর পর তার ফোন ল্যাপটপ, সব গায়েব। ধনী-নির্ধন সব বাড়িতেই পুত্রবধূরা আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার তত্ত্ব খাড়া করা হয়। পরে জাল যত গোটায়, এসে যায় খুনের সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাটের গপ্পো। মেয়েরা নির্যাতিত হবে, এটা ধ্রুবতারার মতো সত্য। অন্য রকম হলে সৌভাগিনী সে মেয়েটি আহ্লাদে ডগমগ। মেয়েদের জন্য কত ব্যবস্থা হয়েছে! তাদের পড়াশোনা, বিবাহ, নিরাপত্তা— তার পরেও মেয়েরা ভারতের মানচিত্রের বিভিন্ন ভাঁজে ধর্ষিতা, নিপীড়িতা এবং ধর্ষণের পর নৃশংস ভাবে খুন হওয়ার ভবিতব্যে আজও নারীদিবস পালন করছে। কবিগুরুর সুরে সুর মিলিয়ে ভাগ্যবিধাতাকে প্রশ্ন করছে— 'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার/ হে বিধাতা?'
প্রতি বার নারীদিবস আসে নারীদিবস যায়। একটা বছরে কত বিবাহবিচ্ছেদ মামলা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ মামলা আমাদের দেশের আদালতগুলোয় জমা পড়ে, মহিলা কমিশনগুলোতে জমা পড়ে— তার হিসাব কে রাখে! বনমালী পরজন্মে রাধা হলে বুঝবে, নারীরও কী বেদন? সে বেদন পদাবলির রাধার প্রেমলীলা তত্ত্ববেদন। কিন্তু যে মেয়েটি পুরুষ-নিরপেক্ষ স্বাধীন উপার্জনের জীবন কাটাতে চায়, তার বেদনা কে বোঝে ? তার অন্তরে অসহ্য যন্ত্রণা। তাকে প্রতি মুহূর্তে অত্যন্ত সুচারু কৌশলে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, নারী স্বাধীন জীবনযাপন করলে, পুরুষ ব্যতিত একক জীবনযাপন করলে— তার শাস্তি সমাজে অবশ্য নির্ধারিত। ‘চোখের বালি’র ‘বিনোদিনী’রা আজ শতবর্ষের অধিককাল পরেও শুকনো চোখে অন্তরে রক্ত-অশ্রু বিসর্জন করে। বঙ্কিমের ‘রোহিণী’ থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘বিনোদিনী’ পর্যন্ত সরলরেখা টানলে যেটি পাওয়া যায়— সেখানে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নারীশিক্ষা ‘রোহিণী’র মতো ‘বিনোদিনী’কে শারীরিক হত্যা না করলেও, মানসিক হত্যা করেছে। ‘বিনোদিনী’দের ১০০ বছর পরেও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় বাংলার প্রথম মহিলা চিকিৎসকের জীবনী-আলেখ্য গণমাধ্যমে বন্ধ হয়ে যায়।
‘মরবে নারী, উড়বে ছাই, তবে নারীর গুণ গাই’। বৈদ্যুতিক চুল্লিতে ছাই ওড়ার কোনও সুযোগ নেই। তাই গুণ গাওয়ারও আর কোনও প্রশ্ন নেই। নারীর বেদন বৈদ্যুতিক চুল্লিতে ফেটে বেরনোরও উপায় নেই। নারী হয়ে জন্মানোর বেদনা, নারী ছাড়া আর কে বুঝবে! আহ্লাদি সোহাগী নারী নেই, সে কথা বলছি না। অনেকে বলবেন, ‘আমার নারীজন্ম ভীষণ সুখের। বাবা মা আমায় ছেলের মতো পুত্রস্নেহে বড় করেছেন’। কিন্তু এই সোহাগী অবস্থা, সারা জীবন কোনও নারী বয়ে বেড়াতে পারেন না। জীবনের একটা সময়ে নিজের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হয়। গল্পে উপন্যাসে ঊনবিংশ-বিংশ শতকের প্রথম দিকেও নারীরা শেষ পর্যন্ত কাশীবাসী হতেন। এখন কাশীবাস নেই। সন্তান থাকলে বৃদ্ধাবাস বা একাবাস। ভরসা বিধবা-ভাতা, বৃদ্ধ-ভাতা যদি জোটে। না হলে কুক্করীর হাল। প্রাণীজগতেও রাস্তার পুরুষ কুকুরদের যে দাপট, মাদি কুক্কুরীদের জীবন অতিশয় দুর্বিষহ। খুব মনযোগে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গোটা প্রাণজগতে মেয়েরা প্রকৃতপক্ষে মেয়ে মাকড়সার মতো নিজের শরীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে খাইয়ে মৃতদেহ হয়ে ঝুলের সঙ্গে ঝুলে থাকে। তার পরে কখনও কালবৈশাখী ঝড় এলে, সে মৃতদেহ উড়ে যায় নিরুদ্দেশে।