ছবি: সর্বজিৎ সেন।
এ শহরে, এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় অনেক বয়স্ক মানুষই একা থাকেন। হয়তো স্বামী-স্ত্রী বা একা ষাটোর্ধ্ব পুরুষ বা মহিলা। কর্মসূত্রে ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকেন বা কাছে থাকলেও হয়তো মা-বাবার জন্য নিয়মিত সময় বার করতে পারেন না। কিন্তু এই প্রবীণ নাগরিকদের ডাক্তার দেখানো, বাড়ির বাজারটা এনে দেওয়া, জল বা ইলেকট্রিক লাইন খারাপ হয়ে গেলে সারানো... সবচেয়ে বড় কথা তাঁদের সঙ্গ দেওয়ার মতো মানুষও তো দরকার। বাড়িতে হঠাৎ শরীর খারাপ করলে কে তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? ইদানীং শহরে ও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বয়স্কদের যত্ন নেওয়ার মতো কিছু পরিষেবা চালু হয়েছে। সে সম্পর্কে জেনে রাখলে বা সে সব নম্বর হাতের কাছে রাখলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।
বাড়িতে বসে যে সুবিধেগুলো পেতে পারেন
জেরেন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী বলছেন, “২০০০ সাল থেকেই ভারত সরকার ন্যাশনাল পলিসি ফর ওল্ডার পার্সন শুরু করে। সেই স্কিমে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে ক্যাডার তৈরি করা হয়। বয়স্কদের রুটিন চেকআপ করানো, আপৎকালীন পরিষেবা, কোথাও নিয়ে যেতে হলে সঙ্গে যাওয়া, দৈনন্দিন কাজে সহযোগিতা করার মতো সব বিষয়ই তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এখন এই রাজ্য জুড়ে এমন অনেক সংস্থা আছে, যাদের মাধ্যমে এমন জেরিয়াট্রিক কেয়ারগিভারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। অনেক প্রাইভেট সংস্থাও এসে গিয়েছে, যারা এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত।”
জেরিয়াট্রিক পরিষেবা দেওয়ার এমনই একটি সংস্থা পরশ। এখানে যেমন রুটিন চেকআপ থেকে শুরু করে হাসপাতালে ভর্তি করানো, সেখানে নিয়মিত ভিজ়িট করা, মেডিক্লেমের পেপার দেখিয়ে ডিসচার্জ করানো পর্যন্ত হয়। আবার ব্যাঙ্কের কাজেও সহযোগিতা করা হয়ে থাকে। লোকাল গার্ডিয়ানের যা যা দায়িত্ব, সবই পালন করা হয়। পরশের ডিরেক্টর পৌষালী চক্রবর্তী বললেন, “শুধু তালিকাভুক্ত পরিষেবাই যে দেওয়া হয়, এমনটা নয়। অনেক সময়ে মানবিকতার খাতিরে কারও প্রয়োজন অনুযায়ীও আমরা কাজ করি। যেমন একজন প্রবীণা যোগাযোগ করেছিলেন, তাঁর একমাত্র ছেলে সাইকায়াট্রিক পেশেন্ট। সে বাড়িতে এমন চেঁচামেচি করছিল যে তিনি সামলাতে পারছিলেন না। তখন তাকে রাতারাতি শিফট করিয়ে সেই ভদ্রমহিলার পাশে দাঁড়িয়েছি। এটা হয়তো আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তখন সেটা দরকার ছিল বলে করেছি।” এ ছাড়াও একটা ইমার্জেন্সি বাটন দেওয়া হয় বয়স্কদের। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে যদি ফোন নাম্বার খুঁজে কল করার মতো অবস্থায় না থাকেন, তা হলে ওই বাটন প্রেস করলেই খবর চলে যাবে তাদের কাছে। সেই মতো তারা পদক্ষেপ করবে। হালিশহর থেকে চন্দননগর, মধ্য কলকাতা হয়ে দক্ষিণে বেহালা অবধি এরা পরিষেবা দেয়। এই সংস্থার একটি ওল্ড-এজ হোমও রয়েছে, তবে তা শুধু ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য।
বিনামূল্যে পরিষেবাও পেতে পারেন
কলকাতা পুলিশের উদ্যোগে ‘প্রণাম’-এর মাধ্যমেও শহরের প্রবীণদের জন্য কিছু পরিষেবা দেওয়া হয়ে থাকে। তার জন্য কলকাতা পুলিশের জুরিসডিকশন অনুযায়ী মেম্বারশিপ নিতে হয়। যে কোনও লোকাল থানায় গেলে আবেদনপত্র পাওয়া যাবে। সেই ফর্ম ফিলআপ করে জমা দিতে হয়। তার পর পুলিশ থেকে ভেরিফিকেশনের জন্য বাড়িতে আসবে। আবেদনকর্তা যদি একা থাকেন তবেই এই পরিষেবা পাবেন। ছেলেমেয়ে বা সঙ্গে কেউ থাকলে সেই আবেদন গৃহীত হয় না। এ ক্ষেত্রে মেডিক্যাল, সিকিউরিটি ও লিগাল সাহায্য পাওয়া যায়।
মেডিক্যালের মধ্যে দরকারে পুলিশের তরফে বিনামূল্যে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। অন্য দিকে প্রতিবেশী বা ভাড়াটে কোনও ভাবে বিরক্ত করলে সেই প্রবীণ ব্যক্তির নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা হয়। আইনি সহায়তার ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে এর কোনও পরিষেবা পাওয়ার জন্যই সদস্যপদ পাওয়া জরুরি।
বৃদ্ধাশ্রমে থাকার বা রাখার দ্বিধাও কাটছে
একটা সময় ছিল, যখন মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা নিয়ে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতেন সন্তানরা। কিন্তু কাজ, সংসার সামলে বা ভিনরাজ্য, প্রবাস থেকে হয়তো মা-বাবার যথোপযুক্ত যত্নও নিতে পারতেন না। এতে সম্পর্কের সুতোও আলগা হত আর সমস্যায় পড়তেন সেই প্রবীণ মানুষটি। অনেকে বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রাখলেও সে কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করতেন না। এখন এই ধারণাও ভাঙছে। ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী বললেন, “ভারত সরকারের উদ্যোগে এখন এই রাজ্যের প্রত্যেক জেলায় এমন হোম তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থার হোমও রয়েছে। সেখানে যেমন একা থাকা যায়, কোনও দম্পতিও থাকতে পারেন। আবার রোগী হলে তাঁদের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে বরং অনেক যত্নে থাকেন তাঁরা। তাই বৃদ্ধাশ্রমে রাখার ট্যাবু এখন অনেক কম। অনেকে নিজেই যেতে চান এই ধরনের হোমে।”
সেখানেই ডাক্তার দেখানো, হাসপাতালে ভর্তি করানোর মতো দায়িত্বও পালন করা হয়। আবার সুস্থ প্রবীণদের জন্য ইনডোর গেমের রুম, টিভি দেখার সুযোগ, মাঝেমধ্যে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, পিকনিক করার মতো বিনোদনমূলক অ্যাক্টিভিটিও করা হয়ে থাকে। সার্বিক দিক থেকে একটা সুস্থ পরিবেশ দেওয়া হয়, যাতে প্রবীণরা ভাল থাকেন, একাকিত্বে না ভোগেন। প্রয়োজনে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিংও করানো হয়।
প্রবীণদের সুরক্ষার জন্য যেমন এই ধরনের পরিষেবা বাড়ছে, তার সঙ্গে নাগরিক সচেতনতাও জরুরি। কোনও পাড়ায় বা ফ্ল্যাটে একা যদি কোনও বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা থাকেন, তা হলে সুনাগরিক হিসেবে প্রতিবেশীরাও কিন্তু যোগাযোগ রাখতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরাও আর একা, নিরাপত্তার অভাব বোধ করবেন না। অনেক বাড়িতেই কমবয়সি ছেলেমেয়েরা থাকে, তাদেরও এমন কাজে ইনভলভ করুন। এতে ওদের মধ্যেও দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। সার্বিক ভাবে একটা সুস্থ সমাজও গঠিত হবে।
মডেল: সুস্মেলি দত্ত, নিকুঞ্জ বিহারী পাল, রেবা দত্ত