Story of Idiom

জ্ঞান যে অনন্ত, সে কথা জানতেই বিশাল লাইন পড়ে ইউরোপের শহরে, হার মানে দুর্গাপুজোর ভিড়

প্রাগ কাসল কিংবা চার্লস ব্রিজের মতো ‘ইডিয়ম’ এখন প্রাগ-পর্যটকদের অবশ্য-দ্রষ্টব্যের তালিকায় ঢুকে পড়েছে। সেই কারণেই ‘মেস্তস্কা নিহোভনা প্রাজে’র সামনে লম্বা লাইন।

Advertisement
পীযূষ আশ
প্রাগ শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:০০

পুজো। প্যান্ডেলের সামনে লাইন। প্রতিমা, অন্দরসজ্জা দেখার অপেক্ষায় সকলে। ভাল কিছু দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তাই প্যান্ডেল-প্রবেশে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় আপত্তি নেই অনেকেরই। তা ছাড়া ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে, শুধু পুজো কেন, রেশন দোকান থেকে হাসপাতালের বহির্বিভাগ— ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’তে অভ্যস্ত আমরা।

Advertisement

কিন্তু যেখানে জনসংখ্যা কম? বাসে-ট্রেনে কনুয়ের গুঁতো নেই, কোথাও কিছু হলে নিমেষে গন্ডা-দশেক লোকের ভিড় জমে যায় না— সেখানে একটি বাড়ির সামনে খামোখা মানুষের লাইন দেখলে একটু অবাক হতে হয় বইকি। কেন না, শহরটির নাম প্রাগ। দেশ, চেক প্রজাতন্ত্র। আর বাড়িটি নেহাতই এক লাইব্রেরি। নাম, ‘মেস্তস্কা নিহোভনা প্রাজে’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘প্রাগের পুর-গ্রন্থাগার’।

এখানে বলে নেওয়া ভাল, চেক প্রজাতন্ত্র বা চেকিয়া ভারতের মতো জনবহুল নয়। ভারতের চেয়ে চেকদের দেশে জনঘনত্ব অনেক কম, প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও অসুবিধা নেই। অফিস টাইমে প্রাগের বাসে-ট্রামে বাদুড়ঝোলা ভিড় হয় না। প্রাগের ঐতিহাসিক চার্লস ব্রিজের উপর নানা দেশের পর্যটকের ভিড় থাকলেও, শহরে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা পার্কে, কাঠের বেঞ্চে নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায়। পাবলিক কিংবা পেয়াদা—কেউই ওঠার জন্য তাড়া দেবে না। সেই কারণে, প্রাগের পুর-গ্রন্থাগারের সামনে হঠাৎ লাইন পড়তে দেখলে কারও-কারও মনে সংশয় জাগতেই পারে। এ তো আর থিয়েটার হল নয়, যে মানুষ টিকিট কেনার জন্য ভিড় করবেন! তা হলে?

তা হলে আর কিছুই নয়, ওই ভিড় একটি ভাস্কর্য দেখার জন্য। ভাস্কর্যটি বই দিয়ে তৈরি। নাম ‘ইডিয়ম’। সমাজমাধ্যমের সুবাদে এই ‘বই-ভাস্কর্য’ বেশ বিখ্যাত। আজ নয়, অনেক দিন ধরেই। ২০১১-এর ১৪ জুন সংখ্যার ‘সায়েন্স’ পত্রিকার প্রচ্ছদে ছিল ‘ইডিয়ম’-এর ছবি। প্রাগ কাসল কিংবা চার্লস ব্রিজের মতো ‘ইডিয়ম’ এখন প্রাগ-পর্যটকদের অবশ্য-দ্রষ্টব্যের তালিকায় ঢুকে পড়েছে। সেই কারণেই ‘মেস্তস্কা নিহোভনা প্রাজে’র সামনে লম্বা লাইন।

মধ্য ইউরোপের দৃষ্টিনন্দন শহর প্রাগের আর একটি পরিচয়, এটি ‘সিটি অব লিটারেচার’। এই শহরেরই বাসিন্দা ছিলেন ফ্রান্‌জ় কাফকা। শহরে অলিতে-গলিতে পুরোনো বইয়ের দোকান। পুর-গ্রন্থাগার, জাতীয় গ্রন্থাগার ছাড়াও রয়েছে একাধিক লাইব্রেরি। বই নিয়ে মাতামাতি এমনই যে, বিশেষ-বিশেষ ক্ষেত্রে লাইব্রেরি থেকে বই পৌঁছে দেওয়া হয় পাঠকের বাড়িতে। বেশির ভাগ বইয়ের দোকানের ওয়েবসাইট আছে। সেখানে মিলবে বই এবং মূল্যের তালিকা। তালিকায় পছন্দের বই পেলে বুক করে রাখা যায়। অনেক সময় জলের দরে পাওয়া যায় পুরোনো বই। এটি প্রতিবেদকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা।

সব মিলিয়ে এমন একটি শহরে যে ‘বই-ভাস্কর্য’ থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? ভাস্কর্যটির স্রষ্টা মাতেই ক্রেন। তিনি চেক নন, স্লোভাক। যদিও এখন বেশির ভাগ সময় থাকেন প্রাগে। এঁর শিল্পকর্মের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে বই। ইউরোপের আরও কয়েকটি শহরে তাঁর ‘বই-ভাস্কর্য’ রয়েছে। যদিও প্রাগের ‘ইডিয়ম’ এইগুলির মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি চর্চিত এবং জনপ্রিয়। ১৯৯৮ সাল থেকে ‘মেস্তস্কা নিহোভনা প্রাজে’-তে এই ‘ইডিয়ম’ রয়েছে। তৈরি হয়েছে তারও আগে। ইউরোপ তো বটেই, লাতিন আমেরিকাতেও প্রদর্শিত হয়েছে মাতেইয়ের এই কাজ।

‘ইডিয়ম’ তৈরি আট হাজার বই দিয়ে। বই দিয়ে তৈরি একটি ফাঁকা স্তম্ভ। পাশে একফালি জায়গা। দর্শকরা ওই ফাঁকা জায়গা দিয়ে বই-স্তম্ভের ভিতর মুখ ঢুকিয়ে দিতে পারেন। আর মুখ ঢোকানোর পরে চমক। কেন না, শিল্পী এমন ভাবে স্তম্ভটি তৈরি করেছেন, মনে হবে, বইয়ের আর কোনও শেষ নেই। বই মানে জ্ঞান। শিল্পী নিজে এটিকে কখনও সখনও ‘টাওয়ার অফ নলেজ’ নামে অভিহিত করেন। ‘হীরক রাজার দেশে’র সংলাপ মনে পড়ে যেতে পারে অনেকের—‘জানার কোনও শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’। এ ভাস্কর্যের শেষ খোঁজার চেষ্টাও এক হিসেবে বৃথা। কেন না, শিল্পী এক বিশেষ কায়দায় দৃষ্টিবিভ্রম তৈরি করেছেন। স্তম্ভের উপরে আর নীচে রয়েছে আয়না। আর তাতে প্রতিফলনের সুবাদে মনে হয় জ্ঞান-স্তম্ভ অসীম। তার কোনও শেষ নেই।

অবশ্য ভাস্কর্যের ভিতর উঁকি দিয়ে এত কিছু ভাবার সময় পাবেন না। কারণ, পিছনে তখন লম্বা লাইন। যদি ভাবেন, ভাস্কর্যে মাথা গলিয়ে সাধ মিটিয়ে সত্যসন্ধান করবেন, সে গুড়ে বালি। নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দিতে পারেন। এই জিনিস কলকাতায় হলে, কয়েক সেকেন্ড পরে নির্ঘাত আওয়াজ উঠবে — “দাদা, তাড়াতাড়ি!”

যে হেতু আট হাজার বই পর পর সাজিয়ে এই ‘ইডিয়ম’ তৈরি, তাই সেটি দেখার সময় কিছুটা সাবধানতা প্রয়োজন। ‘ইডিয়ম’-এ হাত দেওয়া যাবে না। নিজে দেখতে পারেন, উঁকি দিয়ে ছবিও তুলতে পারেন, কিন্তু ট্রাইপডে ক্যামেরা বা মোবাইল বসিয়ে ছবি তোলা যাবে না। তা ছাড়া পুর-গ্রন্থাগারের অভ্যন্তরে এই ‘বই-ভাস্কর্য’। ফলে কখন সেই লাইব্রেরি খোলা বা বন্ধ, তা ইন্টারনেটে দেখে বার হওয়া ভাল। বিভিন্ন ঋতুতে লাইব্রেরি খোলা ও বন্ধ হওয়ার সময় ভিন্ন। সেই কারণেই এই তথ্যটুকু জেনে রাখা দরকার।

সাহিত্য-শহর প্রাগের এই ‘ইডিয়ম’ প্রসঙ্গে একটু অন্য বিষয় বলে নেওয়া যাক। সম্প্রতি ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা। বাংলা সাহিত্য নিয়ে বাঙালির গর্বের শেষ নেই। তাই এই স্বীকৃতি নিশ্চয়ই বাঙালির কাছে যথেষ্ট শ্লাঘার। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে যে শহর, সেগুলিকে ‘সিটি অব লিটারেচার’ হিসেবে তকমা দেয় ইউনেস্কো। সাহিত্য-শহর হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি মাপকাঠি রয়েছে। সেগুলি পূরণ করলে, তবে এই আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে ‘সিটি অব লিটারেচার’ হওয়ার আবেদন জানানো যায়। বিশ্বের অন্যতম ‘সিটি অব লিটারেচার’ হলো প্রাগ। অবশ্য প্রথম এই শিরোপা লাভের সৌভাগ্য স্কটল্যান্ডের এডিনবরার। তার পর একে একে ঢুকে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান, ইরাকের বাগদাদ, পোল্যান্ডের ক্রাকো, পাকিস্তানের লাহোর ইত্যাদি।

ভারতের কোনও শহর এই তালিকায় আছে? আছে। কেরলের কোঝিকোড়। ঠিক এক বছর আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে কোঝিকোড় ইউনেস্কো থেকে ‘সিটি অব লিটারেচার’-এর স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। ‘আদায় করেছে’ স্রেফ কথার কথা নয়। সাহিত্য, প্রকাশনা, গ্রন্থাগারের সংখ্যা, অনুবাদের ব্যাপ্তি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রবণতা—এই রকম অনেকগুলো বিষয়ের মাপকাঠি রয়েছে। সেগুলির প্রেক্ষিতে আবেদনকারী শহরের অবস্থান জানিয়ে, তদ্বির করে এই স্বীকৃতি পেতে হয়।

বাংলা ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। তা হলে এ বার ‘সিটি অব লিটারেচার’ নয় কেন? আমাদের বইমেলা নিয়ে গর্বের শেষ নেই, কলকাতা ঐতিহ্যের অন্যতম মাইলফলক বইপাড়া নিয়ে আমরা কথা বলি অনেক। চর্চা চলে আমাদের অনুবাদ, পুরনো এবং নতুন প্রজন্মের লেখালেখি নিয়ে। তা হলে ‘সাহিত্য-শহর’ হতে বাধা কোথায়? না কি এমন এক পদক্ষেপ, উদ্যোগের জন্য আদৌ প্রস্তুত নন পাঠক, প্রকাশন, নগর কর্তৃপক্ষ? উত্তর জানা নেই। তবে এটুকু জানা আছে, কেরলের কোঝিকোড় (সেই শহরে প্রতি সম্মান জানিয়েও) যদি ইউনেস্কো থেকে স্বীকৃতি পেতে পারে, কলকাতার দাবি নেহাত ফেলনা নয়। না কি ধ্রুপদী ভাষার তকমা নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেই ক্ষান্তি দেব আমরা? উত্তর খুঁজে নিতে হবে আমাদেরই।

(সায়েন্স ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদটি ছাড়া সব ছবি প্রতিবেদকের তোলা)

আরও পড়ুন
Advertisement