বাংলার নিজস্ব পদ ব্যান্ডেল চিজ়। ছবি: সংগৃহীত।
চেহারায় কেমন একটা বাঙালিয়ানা। অনেকটা ছানার ডালনার জন্য তৈরি বড়ার মতো। চেখে দেখতে গেলে ছানার আধিক্যই বেশি। কিন্তু ছানা তো শুধু ছানা নয়। প্রকৃত উপায়ে একে রসনাদুরস্ত করতে পারলেই মালুম হবে যেন মধ্যযুগের শেষ পর্বের ইউরোপ থেকে উড়ে এল এর স্বাদগন্ধ। ‘ব্যান্ডেল চিজ়’। নামে উল্লিখিত স্থানমাহাত্ম্যই বলে দেয়, এর পিছনে যেন থমকে রয়েছে হুগলি নদী দিয়ে উজান বেয়ে চলা পর্তুগিজ জাহাজ, গির্জার ঘণ্টার শব্দ, রবিবার সকালের প্রার্থনায় ‘আভে মারিয়া’ গান। স্বাদে একটু বেশিই নোনতা আর উপরি পাওনা খানিক ধোঁয়াগন্ধ। যে গন্ধ হয়তো মনে পড়িয়ে দিতে পারে ইতিহাসের বইয়ে পড়া ইউরোপের মধ্যযুগের গ্রামাঞ্চলের কমিউনিটি রান্নাঘরের কথা। যেখানে নুন মাখিয়ে ধোঁয়ায় জারিত করে রেখে দেওয়া হত মাংস। নোনতা স্বাদের তীব্রতা কমাতে এই চিজ় এক রাত্তির জলে ভিজিয়ে খাওয়াই দস্তুর। তেমন রেসিপির কথা আজকের ইউরোপ কি মনে রেখেছে? যদি না-ও রাখে, ক্ষতি নেই। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার এক গ্রামেই আজও তৈরি হয় ব্যান্ডেল চিজ়। কিনতে পাওয়া যায় কলকাতার নিউ মার্কেটের বাছাই দু’-একটি দোকানে।
সম্প্রতি সমাজমাধ্যমে ব্যান্ডেল চিজ় নিয়ে বেশ কিছু পোস্ট বেশ ভাইরাল। পোস্টগুলির মোদ্দা বক্তব্য এই চিজ়টি বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া না গেলেও, কলকাতাতেই একমাত্র পাওয়া যায় এবং সেটির প্রস্তুতকর্তা বাঁকুড়ার কোতুলপুরের একটি মাত্র পরিবার। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে তা নড়েচড়ে বসার মতো ব্যাপার! সুলুকসন্ধান থেকে জানা যাচ্ছে, পর্তুগিজদের উপনিবেশ হুগলি জেলার ব্যান্ডেলেই এর জন্ম এবং ওলন্দাজদের হাতফেরতা হতে হতে তা একান্ত ভাবেই বাংলার নিজস্ব সম্পদ।
পলাশ ঘোষ ও তাঁর নিজস্ব উৎপাদন ব্যান্ডেল চিজ়। ছবি: সংগৃহীত।
কথা হচ্ছিল সেই পরিবারের সদস্য পলাশ ঘোষের সঙ্গে। পলাশ জানালেন, কী ভাবে যে ব্যান্ডেল চিজ় তৈরির পদ্ধতি তাঁদের পরিবারের হাতে এসেছিল, তা আজ আর কারও মনে নেই। তিনি তাঁর ঠাকুরদাকে এই চিজ় তৈরি করতে দেখেছেন, বাবাকেও দেখেছেন। আর সেই উত্তরাধিকার আজ তাঁর হাতে। চিজ় তৈরির পদ্ধতি তাঁর পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ হলেও পলাশের কথা থেকে যা জানা গেল, তা খানিক এ রকম— দুধ কাটিয়ে ছানাকে নুন মাখিয়ে রাখা হয় আর তার পর তাতে ধোঁয়া যুক্ত করেই তৈরি হয় ব্যান্ডেল চিজ়। স্বাদ নিলেই অবশ্য মালুম হয়, এ ততটা সরল ‘চিজ়’ নয়। তবে এতে যে কোনও রকম প্রিজ়ারভেটিভ দেওয়া হয় না, তা বেশ জোরের সঙ্গেই জানালেন পলাশ। তাঁর মতে, ঘরের তাপমাত্রায় এই চিজ় দু’সপ্তাহ অবিকৃত থাকে। আর ফ্রিজে রাখলে তা এক বছর পর্যন্ত তরতাজা। তবে তীব্র নুনের ভাব কমানোর জন্য এক রাত জলে ভিজিয়ে রাখাই শ্রেয়। কিন্তু পলাশের বক্তব্য, ঘণ্টা দুয়েক জলে ভিজিয়ে রাখলেই তা খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
ব্যান্ডেল চিজ় ব্যবহৃত হয় কোন খাবার তৈরিতে? দূরদূরান্তের শেফকুল জানাচ্ছেন, প্রাতরাশের স্যান্ডউইচ থেকে বিভিন্ন রকমের স্যালাড, পাস্তা বা রিসোতোর স্বাদ বহু গুণে বাড়িয়ে দিতে পারে ব্যান্ডেল চিজ়। শুধু রান্নায় নয়, পানীয়ের সঙ্গে এক্কেবারে সোজাসুজিও এই চিজ় খাওয়া চলে। এর নোনতা স্বাদটিই সে ক্ষেত্রে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘অবদংশ’ (সাদা বাংলায় ‘চাট’)-এর মর্যাদায় একে তুলে দেয়। আবার এই চিজ়কেই বাঙালি কিসিমে রেঁধে যে ছানার পাতুরি বানানো যায়, তার রেসিপি নিয়েও ফুড ব্লগারেরা মতামত রেখেছেন।
ব্যান্ডেল চিজ় কি তার প্রাপ্য মর্যাদা পাবে? ছবি: সংগৃহীত।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কোতুলপুর থানার চকচাঁদ গ্রামের একটি মাত্র পরিবার কী ভাবে এমন একান্ত এক পদকে বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি করে চলেছে? ঠিক কী পরিমাণ চিজ় এক দিনে তৈরি করতে পারে ঘোষ পরিবার? পলাশ জানালেন, প্রতি দিন ৪০০ থেকে ৫০০ পিস তাঁরা তৈরি করতে পারেন। নিউ মার্কেটের জে জনসনের মতো বিপণি থেকে ব্যান্ডেল চিজ় যে নিয়মিত বিক্রি হয়, তা স্বীকার করেছেন সেই বিপণির মুখপাত্র পরিমল ঘাটা। তবে এই চিজ়ের চাহিদা যে সীমিত, সে কথাও মানলেন পরিমল। চাহিদা বাড়লে অবশ্য উৎপাদনও বাড়াতে হয়। শীতে এই চিজ়ের চাহিদা বেশ খানিকটা বেড়ে যায়। তবে লকডাউন পর্বে পলাশ বেশ আতান্তরেই পড়েছিলেন। বিক্রিবাটা একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সংসার চালাতে পলাশকে নাইট গার্ডের চাকরি করতে হয়েছিল।
বেশ দুঃসময়েই পলাশের পাশে এসে দাঁড়ান সৌরভ গুপ্ত নামের এক আইনজীবী। সৌরভ অনুভব করেন, এমন একটি খাদ্যের জিআই (জিয়োগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) প্রয়োজন। এর দ্বারা কোনও পণ্যের প্রকৃত উৎসস্থানটি সরকারি ভাবে নথিভুক্ত থাকে। এর ফলে সেই পণ্যের অনন্যতাও রক্ষিত হয়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ২০১৭ নাগাদ ব্যান্ডেল চিজ়ের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং তা নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গবেষণার অর্থ সহায়তা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ। এই সূত্র ধরে সৌরভ ব্যান্ডেল চিজ়ের জিআই প্রাপ্তি নিয়ে উদ্যোগী হন। ২০২৪-এ পলাশকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গবেষকদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। সেই বৈঠকে বিস্তর আলোচনা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এর পর সৌরভ ব্যান্ডেল চিজ়ের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটের জন্য ইউনিভার্সিটি অফ জুরিডিক্যাল সায়েন্সের কাছে আবেদন করেন। সেখানে এখন বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে। গভর্নমেন্ট ট্রেডমার্ক বিষয়ে রেজিস্ট্রেশন করাতে গিয়ে সৌরভ দেখেন ইতিমধ্যেই ‘ব্যান্ডেল চিজ়’ নামে কেউ সেখানে পণ্যের নাম নথিভুক্ত করে রেখেছেন। অথচ ব্যান্ডেল চিজ়ের কারিগরি সীমিত কিছু মানুষের হাতেই। সুলুকসন্ধান করে জানা যায়, রেজিস্ট্রিকৃত পণ্যটির সঙ্গে আদি ও আসল ব্যান্ডেল চিজ়ের আদপে কোনও যোগই নেই। সৌরভ লেগে থাকেন। লম্বা শুনানির পর সম্প্রতি সেই রেজিস্ট্রেশন খারিজ হয়েছে। কিন্তু ব্যান্ডেল চিজ়ের জিআই প্রাপ্তি এখনও ঘটেনি।
বাংলার রসগোল্লার জিআই প্রাপ্তি নিয়ে কী টালবাহানা চলেছিল, তা অনেকেরই স্মরণে আছে। কিন্তু রসগোল্লার সঙ্গে ব্যান্ডেল চিজ়ের তুলনা টানা অনুচিত। রসগোল্লার পরিচিতি আর ব্যান্ডেল চিজ়ের পরিচিতি এক নয়। তবে, এ কথাও মানতে হবে যে, এই খাদ্যবস্তুটি আজ সারা বিশ্বে একমাত্র বাংলারই উৎপাদন। চাহিদা এ দেশে কম থাকলেও সুদূর আমেরিকায় ব্যান্ডেল চিজ়ের কদর করছেন নামজাদা শেফেরা। সেই বিন্দু থেকে দেখলে, বাংলার এই উৎপাদনটির জিআই প্রাপ্তি ন্যায্য বলেই মনে করেন সৌরভ এবং পলাশ। দীর্ঘ লড়াইয়ে কিছুটা ক্লান্ত পলাশ। বললেন, “রাজ্য সরকারের কাছ থেকে যে সাহায্যের প্রত্যাশা করেছিলাম, তা পাইনি।”
আপাতত জিআই হাতে না এলেও ব্যান্ডেল চিজ় ফুড ব্লগারদের দৌলতে সমাজমাধ্যমে বেশ পরিচিত বস্তু। কন্টিনেন্টাল খানার রসিকেরা নিয়মিত ঢুঁ মারেন নিউ মার্কেটের সেই গোটাকয় দোকানে। পাস্তা, রিসোতো, স্যালাড না হোক, বাংলার কোয়ার্টার পাউন্ড পাউরুটিকে দু’ভাগে ভাগ করে মাঝে ব্যান্ডেল চিজ গ্রেট করে সাদামাঠা স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেলেও জিভে এসে লাগে ইউরোপের মধ্যযুগের স্বাদ। মস্তিষ্কের কোণে পাল তোলে ‘আভে মারিয়া’ জাহাজ। ভাগীরথীর ঢেউ কেটে সে জাহাজ পিছিয়ে নিয়ে যায় শ’আড়াইয়েক বছর পিছনে। সেটুকুই বা কম কিসে!