Kartik Puja 2024

দক্ষিণ ভারতে জনপ্রিয় দেবতা, কিন্তু বাংলায় কার্তিক কেন খানিক কম জনপ্রিয়?

আজ কার্তিক পুজো। বাংলায় এই পুরুষ দেবতার পুজো এখন আর জনপ্রিয় নয়। কিন্তু, দক্ষিণ ভারতে ষড়ানন কার্তিক অত্যন্ত জনপ্রিয় দেবতা। কেন বাংলায় কার্তিকের এই ‘অবনমন’?

Advertisement
অতীন্দ্র দাণিয়াড়ি
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:২৪
The history and social significance of Kartik Puja in Bengal

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ। গ্রাফিক সহায়তা: এআই।

রাত তখন দুটো। হেমন্তের কুয়াশা আর নাবালক শীতের পরিকল্পিত যুগলবন্দিতে পাড়ার চারপাশ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেও জনা পাঁচ-ছয়েক ছেলের চোখে ঘুম নেই। বাড়ি থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে, ফুট তিনেকের একটা মূর্তি মাথায় নিয়ে তারা চলল এক পড়শির বাড়িতে। প্রায় ছয় ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটায় পোষা কুকুর, খান তিনেক বিড়াল আর একটা টিয়াপাখি থাকলেও কোনও শিশু নেই। অর্থাৎ, মালিক দম্পতির কোনও সন্তান হয়নি। দামাল ছেলেরা ওই পাঁচিল ডিঙিয়ে ভিতরের দরজার সামনে মূর্তিটিকে রেখে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে এল। পরের দিন সকালে দরজা খুলেই দম্পতি দেখলেন, সামনে একটি সুন্দর দেবমূর্তি। এক ঝলক দেখেই তাঁরা চিনতে পারলেন, ইনিই সেই যুদ্ধের দেবতা, দেবসেনাপতি কার্তিক। প্রণাম করে, মনের মধ্যে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আদর-যত্নে কার্তিক মূর্তিটিকে ঘরে তুলতে গিয়ে তাঁরা আবিষ্কার করলেন কার্তিকের হাতে ধনুকের সঙ্গে ধরা রয়েছে একটি চিঠি। তাতে লেখা, “বাবা-মা, আমি তোমাদের কাছে আসছি। আমাকে কোলে নাও। তোমাদের আদর খেয়ে আমি বড় হব, মানুষ হব। আমাকে স্বর্গ থেকে কাকারা নিয়ে এসেছে। ওদের অনেকটাই খরচ হয়ে গিয়েছে। সেই খরচটা অবশ্যই দিয়ে দিয়ো আর ওদের পেট ভরে খাইয়ে দিয়ো। ওদের জন্যই তো আমি তোমাদের কাছে আসতে পারছি। ওরা যা যা খেতে ভালোবাসে, তার একটা তালিকা দিলাম। ওরা খুব লাজুক মা, নিজের মুখে ওরা কিচ্ছু বলবে না।” দেবতার লেখা এমন একটা চিঠি পাওয়ার পর কোনও ধর্মপ্রাণ বাঙালি কি কখনও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন? সন্ধ্যায় দল বেঁধে কার্তিকের কাকারা এসে পেটভরে পছন্দের খাবার খেয়ে, দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বাড়ি ফিরে গেল। শুধুমাত্র এই দম্পতিই নন আপামর বাঙালি বিশ্বাস করেন, কার্তিকের কৃপাতেই নিঃসন্তানের সন্তানলাভ হবে। আর কার্তিকই সেই সন্তানকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবেন।

Advertisement
The history and social significance of Kartik Puja in Bengal

—ফাইল চিত্র।

এই মুহূর্তে বাংলার ঘরে ঘরে এ ভাবেই কার্তিক পুজো হয়। অতীতে এই বাংলাতেই কার্তিক পুজোর রমরমা থাকলেও আজ সেই জাঁকজমক বেশ ফিকে। শৌর্য-বীর্যের প্রতীক, দেবতাদের সেনাপতি, পৌরাণিক আখ্যানের নায়ক হয়েও কার্তিক আজ এক বিস্মৃতপ্রায় বীর দেবতা। হুগলি, নদিয়া, বর্ধমান এবং উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কিছু অঞ্চল ছাড়া আজ এই বাংলায় দেবসেনাপতিকে বেশ অবহেলিতই বলা যায়। আজকের বাঙালির ঘরে ঘরে কার্তিক ঠাকুর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান উৎপাদনের জন্য পালিত উপচার মাত্র। এই সংস্কার ও বিশ্বাস থেকেই ময়ূরবাহন বিক্ষিপ্ত ভাবে বাংলায় পুজো পেলেও, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে কার্তিক কিন্তু আজও খুবই জনপ্রিয় দেবতা । সেখানে তামিল, তেলুগু বা মালয়ালম ভাষাভাষী মানুষ কার্তিককে মর্যাদা সহকারেই পুজো করে থাকেন, তাই এমন এক গুরুত্বপূর্ণ দেবতার জন্ম ও প্রভাব নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসাটাই স্বাভাবিক। কে এই কার্তিক? কী ভাবে জন্ম হল তাঁর?

এই সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে পুরাণের কাহিনিতে। ‘স্কন্দপুরাণ’ মতে, ভয়ঙ্কর প্রতাপশালী তারকাসুরের দাপটে দেবতাদের আসন তখন টলমল করছে। সন্ত্রস্ত দেবতারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, এমন এক শক্তিশালী দেবতা তৈরি করতে হবে, যিনি তারকাসুরকে বধ করে স্বর্গকে রক্ষা করবেন। এই ভাবনা নিয়েই তাঁরা শিবের কাছে গেলেন। শিবের ধ্যান ভঙ্গ হল। সব কথা শুনে উত্তেজিত ভোলানাথ সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য ছুটলেন পার্বতীর কাছে। রাগে উন্মত্ত শিব আর পার্বতীর মিলন হল, কিন্তু চরম মুহূর্তের আগেই অন্য দেবতারা এসে হাজির হওয়ায় শিবের বীর্য গিয়ে পড়ল মর্তে। ধরিত্রী সেই তেজ সহ্য করতে না পেরে ছড়িয়ে দিলেন আগুনের শিখায়। অগ্নির মতো বলবান দেবতাও শিবের মহাতেজের সামনে দাঁড়াতে পারলেন না। অসহায় অগ্নি সেই তেজ শরবনের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন। সেখান থেকেই জন্ম হল কার্তিকের। ওই সময়ে শরবনের পাশ দিয়ে ছ’জন কৃত্তিকা যাচ্ছিলেন। তাঁরা ওই সুন্দর শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে স্তন্যপান করালেন। ছ’টি মাথা নিয়ে ছয় কৃত্তিকার কাছ থেকে একসঙ্গে স্তন্যপান করছিল সেই শিশুটি, যার জন্য কার্তিকের আর এক নাম ‘ষড়ানন’।

The history and social significance of Kartik Puja in Bengal

—ফাইল চিত্র।

অন্য মতে, মানুষের ষড়রিপুকে দমন করার জন্য ষড়ানন কার্তিকের জন্ম হয়। এই ছ’টি মাথা দিয়েই বীর যোদ্ধা কার্তিক ষড়রিপুকে (কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য) নিয়ন্ত্রণ করার বার্তা দেন। পুরাণের পাতায় পাতায় এমন অনেক কাহিনি ছড়িয়ে থাকলেও দেবতা হিসাবে কার্তিক বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। শুধুমাত্র স্বর্গের সেনাপতি নন, কোথাও তিনি বীর যোদ্ধা, কোথাও তিনি সন্তানধারণের প্রতীক, আবার কোথাও তিনি যৌনকর্মীদেরও দেবতা। শুনতে অবাক লাগলেও এটি সত্য যে, কার্তিক এক সময় যৌনকর্মীদের আরাধ্য দেবতা বলে পরিচিত ছিলেন। আজও বর্ধমানের কাটোয়ার যৌনপল্লিতে বেশ জাঁকজমক সহকারেই কার্তিকের আরাধনা করা হয়। সেখানে বেশ কিছু ঘরে দেবসেনাপতি কার্তিক উলঙ্গ। সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, সেখানকার উপাসিকাদের কাছে কার্তিকঠাকুর পৌরুষ ও বীরত্বের প্রতীক, তাই দেবসেনাপতির মধ্যেই তাঁরা বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন। অন্য মতে, বিবাহ-বঞ্চিতা এই নারীরা কার্তিকের মধ্যেই তাঁদের কল্পিত জীবনসঙ্গীকে দেখতে পান।

ইতিহাসবিদেরা এ সম্পর্কে অবশ্য অন্য কথা বলেন। অতীতে জলপথই ছিল যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। নদীর তীরেই হাট-বাজার বসত। ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎসব, অনুষ্ঠান, পূজার্চনাও হত। বিদেশি সওদাগরদের আনাগোনায় সেই সব জায়গা জমজমাট থাকত। খুব স্বাভাবিক ভাবেই, বিদেশি সওদাগরদের মনোরঞ্জনের জন্য নদীর ধারের বন্দর নগরীগুলিতে যৌনপল্লিও তৈরি হত। সেই বন্দরবাসিনী যৌনকর্মীরা বিভিন্ন দেবতার মধ্যে থেকে কার্তিককেই তাঁদের উপাস্য হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। কারণ, অন্য দেবতাদের পুজো করার অধিকার তাঁদের ছিল না। সমাজে দুর্গা, কালী, স্বরস্বতী, গণেশ, বিষ্ণু প্রমুখ দেবতারা সে সময়ে ‘এলিট’ ছিলেন। ঘরের মধ্যে নিজের মতো পুজো করলেও, যৌনকর্মীদের কাছে এই দেবতারা তখনও সর্বজনীন হয়ে ওঠেননি।

The history and social significance of Kartik Puja in Bengal

—ফাইল চিত্র।

বহু ইতিহাসবিদ, সমাজতাত্ত্বিকের গবেষণা থেকে জানা যায়, হিন্দু ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হলেও বৌদ্ধ ধর্মের মানুষদের মধ্যেও কার্তিক আরাধনার উল্লেখ রয়েছে। পণ্ডিতদের মতে, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এক সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের জোরালো প্রভাব ছিল। পরবর্তী কালে, মূলত সেন রাজাদের আমলে এবং বিদেশি শক্তির আনাগোনা ও লুটতরাজের সময় থেকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব দ্রুত কমতে থাকে। ওই সময়েই অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ অন্য ধর্ম গ্রহণ করেন, আবার অনেকেই এই অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। যাঁরা এখানে থেকে যান, তাঁদের বেশির ভাগের মধ্যেই হিন্দু সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেন দেবসেনাপতি কার্তিক। বৌদ্ধেরা শৌর্যের প্রতীক হিসাবে তাঁদের মতো করেই কার্তিক আরাধনা আরম্ভ করেন। আজও অনেক বৌদ্ধ ধর্মালম্বীই সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

এ ভাবেই বিভিন্ন দার্শনিক ও সামাজিক ভাবনায় কার্তিকের রূপ বিভিন্ন হলেও, সন্তান উৎপাদনের দেবতা হিসাবেই কার্তিক আধুনিক কালে তাঁর অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন, তাই লুকিয়ে কার্তিক ফেলে নিঃসন্তান দম্পতিকে পুজো করতে বাধ্য করার পিছনে তথাকথিত আধ্যাত্মিকতার তুলনায় সামাজিক অবস্থানের ভাবনাটাই যেন প্রকট হয়ে ওঠে।

ঋণ স্বীকার -

১) বাংলার লৌকিক দেবতা, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, দে’জ পাবলিশিং (২০১৫)।

২) মধ্যযুগের ধর্মভাবনা ও বাংলা সাহিত্য, শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, পুস্তক বিপণি(১৯৯৪)

৩) বাঙালির ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায় দে’জ পাবলিশিং (১৩৫৬)

আরও পড়ুন
Advertisement