Durga Puja in Foreign countries

সংখ্যায় বাড়ছে বিদেশের পুজো, জুড়ছে জৌলুস, সঙ্গে থাকছে বাঙালি খুনসুটিও

এককালে পুজোর হাওয়া মিউনিখ তো দূর, মোরাদাবাদ পর্যন্তও পৌঁছত না। গত কয়েক বছরে বিদেশের পুজোসংখ্যা এবং জৌলুসে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।

Advertisement
সুচন্দ্রা ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ২০:২৫
Stories and experiences about Durga Puja festivities in foreign lands

স্টকহোম সর্বজনীনের পুজোপ্রাঙ্গণে এ বছরের প্রতিমা। ছবি: প্রতীতি বসুরায়।

বছর তিরিশ আগে একটিও পুজো হত না যে দেশে, সেখানে এখন ১২টি আলাদা আলাদা পুজো হয়!

Advertisement

এককালে পুজোর হাওয়া মিউনিখ তো দূর, মোরাদাবাদ পর্যন্তও পৌঁছত না। পুজোর সময়ে ঢাক বাজত না। তাই পরবাসে বসে থাকা শরৎ আনত একরাশ মনখারাপ। সময়ের সঙ্গে পরবাসের মানেও বদলে যায়। পরের উৎসবকে আপন করে নেওয়ার মাঝেই নিজের পুজোও জায়গা পায়। অল্প অল্প করে বেড়ে ওঠে ভিন্‌দেশে নতুন করে বাঙালি হয়ে ওঠার চেষ্টা। তিলে তিলে হওয়া পুজোর আয়োজন সময়ের সঙ্গে বড় হয়। সংখ্যায় বাড়ে। কয়েক বছরে বিদেশের পুজোসংখ্যা এবং জৌলুসে এমনই বড় আকার নিয়েছে যে, এত আয়োজনের ব্যস্ততার মধ্যেও আলাদা করে লন্ডন, সিডনি, মিউনিখ, স্টকহোমের মতো শহর নজর কাড়ছে কলকাতার। সেখানকার পুজোয় কী আয়োজন হচ্ছে, তা নিয়ে চর্চা করছে।

Stories and experiences about Durga Puja festivities in foreign lands

সম্প্রীতি মিউনিখ-এ এমন ভাবেই হল ভাড়া করে পুজো করেন রণজয়রা। ছবি: সংগৃহীত।

কয়েক বছর আগেই পরিস্থিতি কিন্তু এমন ছিল না। তখনও দূরের কোনও শহরে পুজো হত। তা-ও হয়তো সপ্তাহান্তে একটি দিন। সে দিন কোনও মতে সকাল সকাল উঠে ট্রেনে চেপে দূর থেকে সেই পুজোয় যেতেন কেউ কেউ। টানা সাত বছর পুজোয় নেদারল্যান্ডেসের একটি ছোট শহরে থেকেছেন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী সোহম কর। দশ বছর আগে দেশে ফিরেছেন। জানান, সে সময়ে ওই দেশে বেশি পুজো হত না। তাঁর শহর থেকে অনেক দূরে যেতে হত পুজোর গন্ধটুকু পেতে। কিন্তু এখন সে দেশে অনেকগুলি পুজো হয়। বলেন, ‘‘এখন যদি ওখানে থাকতাম, বাড়ির কাছেই পুজো দেখতে পেতাম। একেবারে কলকাতার মতো!’’ স্টকহোম সর্বজনীনের পুজোর এক উদ্যোক্তা অয়ন চক্রবর্তী এখনও সে সময়ের গল্প বলেন। বছর বারো হল সুইডেনে আছেন তিনি। এক সময়ে কয়েকটি বড় শহর মিলিয়ে তিন-চারটি পুজো হত। অয়ন বলেন, ‘‘আমেরিকায় অনেক পুজো হয় জানতাম। এখানে তো ছোট দেশ। বাঙালির সংখ্যাও তুলনায় অনেক কম। একটা পুজো হত স্টকহোমে, সেখানেই যেতেন সকলে।’’ তার পর ধীরে ধীরে বাড়ে পুজোর সংখ্যা। এখন শুধু স্টকহোম আর আশপাশের কয়েকটি শহর মিলিয়েই সাত-আটটি পুজো হয় বলে জানান অয়ন। তাঁদের পুজোয় এক এক দিন হাজার মানুষের ভিড়ও হয়।

জার্মানির মিউনিখের গল্পও প্রায় স্টহোমের মতো। শহর ছোট। কিন্তু বাঙালির সংখ্যা কম নয়। তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানচর্চা ঘিরে বহু বাঙালিই ইউরোপের নানা শহরে থাকেন। কাজের মাঝে ঘরের কথা মনে পড়ে না পুজোর সময়ে, এমন আর ক’জন হয়! সেখানেও তাই এক পুজো থেকে আর এক পুজো, এ ভাবে বাড়তে থাকে। সে শহরে কর্মরত কল্যাণীর ছেলে রণজয় মালাকার এখন ‘সম্প্রীতি মিউনিখ’ পুজোর উদ্যোক্তাদের এক জন। তিনি বলেন, ‘‘কয়েক বছর হল আমরা নিজেরাই পুজো করি। বেশ বাড়ির পুজোর মতো হয়।’’ পুজোয় বাড়ির কথা তো মনে পড়েই, তবে প্রবাসে নিজেদের মতো করে ঘরোয়া পরিবেশ তৈরি করে শরতের এই আয়োজন।

এক সময়ে অন্য দেশে থাকা বাঙালিরা আমেরিকাবাসী বাঙালিদের হিংসা করতেন। সে দেশেই নাকি সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় পুজো হত। লন্ডনেও পুজোর চল অনেক বছরের। কিন্তু বাকি বিশ্ব? দুর্গাপুজো তো বাঙালির কাছে শুধু কিছু আচার নয়, তার জৌলুস-হইচই অধিকাংশকেই টানে। সে সব বেশির ভাগ জায়গাতেই ছিল না। এখন ধীরে ধীরে হচ্ছে বলে বক্তব্য বহু বছর আমেরিকা, ইংল্যান্ড আর নরওয়েতে কাটানো বিজ্ঞানী সুমন্ত্র ঘোষের। তবে তাঁর একটি অন্য অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘রেষারেষি বেশি, তাই পুজো বাড়ছে সংখ্যায়। সে দিক থেকে দেখতে গেলেও বিদেশের পুজোয় পুরো কলকাতার আমেজ পাবেন। সকলেই নিজের মতো করে পুজো করতে চান। তাই ভাগাভাগি বাড়ছে।’’ রণজয় অবশ্য অন্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘অনেক দিন তো বাড়ির বাইরে আছি, নিজেদের মতো করে পুজো করতে পারলে একটু মনটা ভাল লাগে। মনে হয় ঘরের পুজো হচ্ছে। অনেকেই সেটা চান।’’

এমনই সুর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের আর এক পুজো উদ্যোক্তার কণ্ঠে। তুহিন ঘোষ নামে সেই তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী বলেন, ‘‘আমি হাওড়ার ছেলে। এ দেশে এসে প্রথমে খুব একা লাগত খুব। তার পর যোগাযোগ হয় উত্তরণের পুজোর উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। সেই পর থেকেই আমি এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত।’’ সে শহরে আরও অনেক পুজো হয়। তবে এটি নিজের বলে মনে হয় তুহিনের। সারা বছরই উদ্যোক্তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগে থাকেন। পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছেন।

Stories and experiences about Durga Puja festivities in foreign lands

সিডনি উত্তরণে এমন করেই পুজো হয়। ছবি: সংগৃহীত।

বিদেশের পুজোর এমন গল্প শুনে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক সুচরিতা সোম বেশ মুগ্ধ। তিনি বলেন, ‘‘সকলেই তো বেঁধে বেঁধে থাকতে চান। পুজো মানেই তো তা। তাই নিজের মতো করে পুজো করতেও উদ্যোগী হন।’’ আর এ সবের মাঝে পুজোর সংখ্যা যত বাড়ছে, ততই কলকাতার মতো বাড়ছে প্রতিযোগিতা। কারও মণ্ডপের পাশের স্টলে ফিশ ফ্রাই ভাল, তো কারও পুজো প্রাঙ্গণে পাওয়া যায় কলকাতার শাড়ি। এমনই সব খুটিনাটি রেষারেষি নিয়ে আকারে বেড়ে চলেছে বিদেশের নানা পাড়ার পুজো।

আরও পড়ুন
Advertisement