Parenting Tips

অভিভাবকের কড়া শাসনে আদৌ কি ভাল হয় শিশুর, না কি এতে ক্ষতি হয় মানসিক স্বাস্থ্যের?

শিশু দুষ্টুমি করলে, কথা না শুনলে ধমক দিয়ে থাকেন অভিভাবকেরা। কখনও আবার ছোট থেকেই পরীক্ষায় ভাল ফলের জন্য চাপও থাকে। কড়া শাসনে কি আদৌ ভাল হয় শিশুর?

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৪ ১৬:৪০
অভিভাবকের কড়া  শাসনে আদৌ কি ভাল হয় শিশুর?

অভিভাবকের কড়া শাসনে আদৌ কি ভাল হয় শিশুর? —প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সন্তানকে বড় করতে গিয়ে অনেক সময় কঠিন হন বাবা-মা। থাকে কড়া শাসন, নিয়মবিধি। অনেক সময় শিশু কথা না শুনলে, পড়াশোনা না করলে, কিংবা পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না করলেই শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে। কখনও ধমক, কখনও আবার হাতও উঠে যায় খুদের উপর। কিন্তু এতে কি আদৌ খুদের কোনও ভাল হয়? বদলায় কি পরিস্থিতি?

Advertisement

মনোসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ বলছেন, সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের প্রত্যাশা থাকে। তার আচরণ, পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা সমস্ত ক্ষেত্রেই। সেই প্রত্যাশা পূরণ না হলে, হতাশা থেকেই অভিভাবক সন্তানকে বকাঝকা করেন বা কখনও মারধরও করে ফেলেন। কিন্তু ভাবতে হবে, এতে লাভটা কী হল? শিশুকে বকলে বা শাসন করলেই কি তার পরিবর্তন হবে? যত ক্ষণ না সেই শিশু নিজের ঠিক-ভুল, উপলব্ধি করতে পারছে, তত ক্ষণ কিন্তু তার আচরণ বদলাবে না।

পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের কথায়, শাস্তি দিয়ে কিন্তু শিশুকে শোধরানো সম্ভব নয়। সে যদি ভুল করে, কোথায় ভুল, কেন ভুল, সেটা খুদের বোঝা দরকার। বোঝার আগেই ধমক খেলে সে কিন্তু শোধরাবে না। বরং তার মনে ভয় তৈরি হবে। সে ধীরে ধীরে বিভিন্ন কথা লুকোতে শুরু করবে।

শাসনে শিশুর উপর কী প্রভাব পড়তে পারে?

পড়াশোনা হোক বা অন্য কারণ, ক্রমাগত বকাবকি বা মারধরে শিশুর মনে প্রভাব পড়তে পারে বলেই জানাচ্ছেন মোহিত রণদীপ। তাঁর কথায় শিশু এ ক্ষেত্রে হয় নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে, না হলে তার মধ্যে রাগ, ক্ষোভ, হতাশার জন্ম হতে পারে। এর প্রভাব শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনেও পড়তে পারে। তার ব্যক্তিত্ব গঠনে সমস্যা হতে পারে। রাগ, ক্ষোভ ক্রমাগত জমতে থাকলে, একসময় সে ধ্বংসাত্মক পথে হাঁটতে পারে। নিজের ক্ষতি করে ফেলার সম্ভাবনাও সে ক্ষেত্রে উড়িয়ে দেওয়া যাওয়া না। আবার কোনও কোনও শিশু আত্মবিশ্বাসের অভাবে নিজেকে গুটিয়েও নিতে পারে। বিষণ্ণতা, হতাশা গ্রাস করতে পারে।

পায়েল বললেন, ‘‘ক্রমাগত ধমক, মার খেতে খেতে শিশুরা অনেক সময় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, সে বড়দের সামনে কিছু করতে পারছে না। সেই রাগ, ক্ষোভ মনে জমছে। সেই রাগ সে অপেক্ষাকৃত দুর্বলের উপর দেখাতে পারে।’’

ভীতি জন্মাবে

স্কুল যাওয়া, পড়াশোনা, পরীক্ষা, এগুলি ধীরে ধীরে খুদের জীবনে প্রবেশ করে। তবে যদি পড়া নিয়ে বেশি চাপ দেওয়া হয়, অঙ্ক ভুল করলে, নামতা ভুল বললে প্রচণ্ড বকবকি করা হয়, তবে কিন্তু খুদের মনে আগ্রহ তৈরি হওয়ার বদলে ভীতি জন্মাতে পারে।

উদ্বেগ

অতিরিক্ত শাসন শিশুর মনে আতঙ্ক তৈরি করতে পারে। যা থেকে একসময় উদ্বেগ তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শিশু ভুল করবে, শিখবে। তারও নিজস্ব জগৎ আছে। সেই জগতে সে যদি প্রতি মুহূর্তে শাস্তির ভয় পায় তা এক সময় মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। বাবা-মায়ের প্রত্যাশাপূরণের চাপ, বকাবকি, শাস্তির ভয় শিশুমনে গভীর রেখাপাত করতে পারে। যার ফলে উদ্বেগের সমস্যা হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। পায়েল বলছেন, “বার বার শিশুকে ধমকানো বা ক্ষেত্রবিশেষে হাত তোলায়, সে ভয় পেয়ে যাবে। বকুনির ভয়ে সে সত্যি কথা চেপে যাবে। আবার নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যে কথা বলতে শিখতে পারে।”

সিদ্ধান্ত ও মেলামেশায় সমস্যা

কোনও কোনও বাবা-মায়েরা কথায় কথায় শিশুর ভুল ধরেন। তাদের মতামতের তোয়াক্কা করেন না। অনেক সময় অন্য শিশুদের সঙ্গে তুলনা টানেন। এই ধরনের বিষয়গুলি শিশুর ভবিষ্যত জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। মোহিত রণদীপ বলছেন, “এতে শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিতে পারে।” পায়েলের কথায়, “অন্যের সঙ্গে তুলনা টানার প্রবণতায়, শিশুর মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। আর পাঁচ জনের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা করার বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলতে পারে সে। প্রতি মুহূর্তে কোনও কাজ করার আগে বার বার জিজ্ঞাসা করার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।”

অভিভাবকের করণীয়

মোহিত বললেন, ‘‘দুষ্টুমি করলে, কথা না শুনলে সন্তানকে বোঝাতে হবে। পড়াশোনায় যদি শিশু অমনোযোগী হয় বা খারাপ ফল করে, তা হলে তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। পড়াশোনা করতে গিয়ে সন্তানের কোথাও কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না, সেটা আগে জানতে হবে। যদি দেখা যায়, এমনিতে সমস্যা নেই কিন্তু সে অমনোযোগী, সে ক্ষেত্রে কেন মনোযোগের অভাব হচ্ছে তা জানার চেষ্টা করতে হবে। অনেক সময় শিশুরা খুব ছটফটে হয়। দুষ্টুমি করে। সে ক্ষেত্রে তাদের যদি মাঠে বা খোলা জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়, সে আনন্দে থাকবে।’’

পায়েল বলছেন, ‘‘বাবা-মায়েদের পড়ানোর সময় শিশুর অন্যমনস্কতার কারণ খুঁজতে হবে। পড়ার সময় একটা কিছু ভুল বললে, হয়তো সারা দিন কাজের পর পড়াতে বসে ধৈর্য হারিয়ে চড়-থাপ্পড় মেরে দিচ্ছেন মা। কিন্তু দেখতে হবে, সেই সময় আদৌ পড়াশোনার শক্তি খুদের মধ্যে আছে তো! কারণ, সে হয়তো সকালে স্কুলে যায়। এ দিকে দিনভর কাজের পর মা বা বাবা যখন তাকে পড়াতে বসাচ্ছেন, তখন রাত হয়ে যাচ্ছে। তার মন নেই পড়ায়। ঘুম পাচ্ছে। বাবা-মাকেও বুঝতে হবে, তাঁদের প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত কি না।’’

আরও পড়ুন
Advertisement