এক অনন্য প্রেমের কাহিনি! ছবি: সংগৃহীত
সব রূপকথা বাস্তব না হলেও, কিছু কিছু ঘটনা রূপকথার মতোই হয়। যে গল্পে এক জন নায়ক থাকেন। এক নায়িকা থাকেন। তাঁদের একসঙ্গে পথচলা থাকে। রাগ, অভিমান, ঝগড়া, খুনসুটি থাকে। কষ্ট থাকে। যন্ত্রণা থাকে। অন্তর্লীন মায়া থাকে। অস্ফুট কিছু আফসোস থাকে। আজন্ম হাত ধরে থাকার অঙ্গীকার থাকে। আর থাকে এক সমুদ্র ভালবাসা। ওহ্ হ্যাঁ, আর সেই গল্পে ঠিক এক জন (এই অধমের মতো) সূত্রধার থাকে।
বাকি রূপকথার থেকে এ গল্প আলাদা। রক্ত, বিচ্ছেদ আর বায়োস্কোপের মতো জ্বলন্ত প্রদীপের দপ করে হাওয়ায় নিভে যাওয়া দিয়ে শুরু এই কাহিনির। গল্পের নায়ক বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার অভীক চৌধুরী। যে গল্পের মুখবন্ধে দুর্ঘটনার গ্রাসে অভীকের তলিয়ে যাওয়া আছে, প্রতিবন্ধকতার যন্ত্রণায় রক্তাক্ত হওয়া আছে, আর একদম শেষে আছে ভালবাসার আঙুল ধরে ফিরে আসার কাহিনি।
এক অনন্য প্রেমের কাহিনি!
নায়কোচিত চেহারা ছিল অভীকের। এক কালে বাংলা স্বপ্ন দেখত অভীককে নিয়ে। রঞ্জি খেলেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গোটা সাতেক ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে তত দিনে। লিস্ট এ ক্রিকেটে ১৩-টা ম্যাচ। তত দিনে বাংলা ক্রিকেট নিশ্চিন্ত অভীককে নিয়ে। ধরেই নিয়েছে, তিনিই বহন করবেন ভবিষ্যতে বাংলা ক্রিকেটের গুরুভার। কাগজের শিরোনামেও তখন জ্বলজ্বল করত অভীকের নাম। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, নিয়তি আর এক। ১৮ অক্টোবর, ২০০৯ দিনটা কি কখনও ভুলতে পারবেন অভীক? সম্ভব?
কাগজের শিরোনামে সে দিনও অভীকই ছিলেন, তবে ভিন্ন কারণে। সে দিন সকালে ইডেনে বাংলার ট্রেনিং ছিল। যা শেষ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন অভীক। নিজেই চালাচ্ছিলেন। গন্ডগোলটা হল, বাইপাসের কাছে এসে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা মারেন অভীক। দুর্ঘটনার অভিঘাতে সংজ্ঞা হারান। দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে দিল্লিতে। কলকাতার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন কেউ কিছু বলেননি তাঁকে। দিল্লিতে যাওয়ার পর নিষ্ঠুর সত্যিটা জানতে পারেন অভীক। দুর্ঘটনায় অকেজো হয়ে গিয়েছে দু’টো পা। আর কোনও দিন ক্রিকেট খেলতে পারবেন না তিনি। ব্যাট-বল নয়, বাকি জীবনে তাঁর সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী থাকবে হুইলচেয়ার!
মৃত্যু হয় বহু স্বপ্নের। মৃত্যু হয় এক সম্পর্কেরও। দুর্ঘটনার সময়ে অভীকের সঙ্গে ছিলেন তাঁর তৎকালীন প্রেমিকা। দুর্ঘটনার আঁচ তাঁর উপর পড়েনি। শারীরিক ভাবে সুস্থ ছিলেন তিনি। কিন্তু মানসিক ভাবে হয়তো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমন অবস্থায় পড়লে আর ঘর বাঁধেন ক’জন? ক’জন দেখাতে পারে, ভালবাসার জপমন্ত্রে অদৃষ্টকে হারানোর সাহস? প্রভূত মনের জোর না থাকলে এ এক প্রকার প্রায় অসম্ভব। তাই যৌথ সিদ্ধান্তেই সেই সম্পর্কে দাঁড়ি পড়ে যায় অভীকের জীবনে এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘোষণা করে।
কে জানত, অভীকের জীবনে পরবর্তীতে আবার আসবে প্রেম, রূপকথা, আবার আপনমনে আঁকতে বসবে রঙ্গোলি? ছকভাঙা পথে ধরে, বিস্ময়ের সঙ্গে একরাশ মুগ্ধতা সঙ্গে নিয়ে?
উপন্যাস কিংবা সিনেমা (ছোটগল্পেরও একই ধাঁচ) নায়িকার ‘এন্ট্রি’ সাধারণত কাহিনির শুরুর দিকেই হয়। এবং বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই তা হয়ে থাকে। কিন্তু এ গল্প যেহেতু প্রথম থেকেই সন্তর্পণে গড়পড়তা ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলছে, তাই এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী স্পর্শ রয়েছে। দুর্ঘটনায় চলাফেরার শক্তি হারানোর পর থেকেই নিজের মতো এক পৃথিবী গড়ে নিয়েছিলেন অভীক। আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকেছিল। সারাক্ষণ ব্যাট হাতে মাঠে দৌড়ে বেড়ানো ছেলেটা চার দেওয়ালে বন্দি হয়ে গেলে, মনের অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ হতে পারে, পুরোটা না হলেও বাইরে থেকে তা বোধহয় কিছুটা আন্দাজ করা যায়। ততদিনে অভীককে নিয়ে লেখালিখি এবং যাবতীয় চর্চায় ইতি পড়ছে। তিনি বেঁচে আছেন কি না, থাকলেও কী করছেন, কেউ আর তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। আর ঠিক এই সময়ে, অভীকের এই ঘুটঘুটে কালো পৃথিবীতে হঠাৎই ঢুকে পড়ে ২১ বছরের এক উচ্ছ্বল কিশোরী। অলকানন্দা দাস। দুর্ঘটনার প্রায় তিন বছর পর যাঁর সান্নিধ্যে এসে এক চিলতে আলোর খোঁজ পেয়েছিলেন অভীক।
২০১৩ সাল। ছোটবেলা থেকেই খেলার পরিবেশে বেড়ে ওঠা অলকানন্দা সেই সময়ে কলেজে পড়তেন। পাশাপাশি একটি ওয়েবসাইটে ফুটবল নিয়ে লিখতেনও। হঠাৎই এক দিন তাঁকে ক্রিকেট নিয়ে একটা লেখা লিখতে বলা হয়। অলকনন্দার বাবা এক জন ফুটবলার। বাড়িতে সব আলোচনাই ফুটবল নিয়েই হত। তাই ফুটবল নিয়ে লিখতে যতটা স্বচ্ছন্দ, ক্রিকেট নিয়ে ততটাও ছিলেন না অলকনন্দা। অগত্যা ঠিক হল, বাইরে থেকে লেখা আসবে। তবে যিনি লিখবেন, কলমচালনায় তিনি ততটাও পটু নন। তাই লেখা কাঁটাছেড়া করার দায়িত্ব পড়ল অলকানন্দার কাঁধে। কিন্তু যাঁর লেখা সাজিয়েগুছিয়ে নিতে হবে, সেই লেখকের সঙ্গে তো এক বার কথা বলা জরুরি। অর্থাৎ, অভীকের সঙ্গে। আর ঠিক এ ভাবেই শুরু অভীক-অলকনন্দার আলাপ-পরিচয়ের প্রথম পর্ব, ফেসবুকে।
প্রথম প্রথম লেখা সংক্রান্ত কথাবার্তা চলত শুধু। কিছু দিন মেসেঞ্জারে দু’জনেরই একই সময় জ্বলে থাকত সবুজ আলো। তার পর সেই গল্পের ঢল নামে হোয়াট্সঅ্যাপে। দিনভর চলতে থাকে। কাছাকাছি আসে দু’টো মন। আলাপ হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় অলকানন্দা প্রেমের প্রস্তাব দেন অভীককে। কিন্তু অভীক বোধ হয় এমন একটা হাত ধরতে চাইছিলেন, যা কোনও দিন ছাড়তে না হয়। তাই প্রেম নয়, অলকানন্দাকে ঘুরিয়ে বিয়ে করার কথা বলেন অভীক। যা শুনে রাজি হননি অলকনন্দা। আসলে তখনও পর্যন্ত কেউ কাউকে সামনে থেকে দেখেননি। তাই দেখাটা করতে হত। সেই বছর জুন মাসের ২ তারিখ প্রথম দেখা হয় দু’জনের। হুইলচেয়ারে বসা অভীকে দেখে আলাদা করে কোনও রকম কোনও শঙ্কা জন্ম নেয়নি অলকানন্দার মনে। হাঁটাচলার অক্ষমতা যে সম্পর্কের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা কখনও মাথাতেই আসেনি তাঁর।
২০১৪ সালে আইনত বিয়ে সারেন ওঁরা। ২০১৫ সালে সামাজিক বিয়ের পর পাকাপাকি ভাবে একসঙ্গে যাপন শুরু। বিয়ে নিয়ে অলকনন্দার বাড়িতে কোনও সমস্যা হয়নি। শুধু বাবা বলেছিলেন, ‘‘এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছ নাও। পরে কিন্তু কোনও আফসোস করতে পারবে না।’’ অলকানন্দা বাবাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘‘দেখাই যাক না কী হয়!’’ আর দেখতে দেখতে সেই সম্পর্কের বয়স হয়ে গেল দশ।
এই সম্পর্ক টিকবে না, এ ব্যাপারে অভীক আর অলকানন্দা বাদ দিয়ে প্রায় সকলেই নিশ্চিত ছিলেন। এক দশক একসঙ্গে পেরিয়ে এসে সে সব ফিরে দেখলে বেশ মজাই লাগে দম্পতির। দু’জনেই মনে করেন এ সম্পর্কের একমাত্র ভিত্তি হল বন্ধুত্ব আর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস। সম্পর্কের উদ্যাপন করতে মাঝেমাঝেই বেড়াতে চলে যান। পাহা়ড় দু’জনের অন্যতম পছন্দের জায়গা। হুইলচেয়ারে বসে পাহাড় ডিঙোনো সহজ নয়। অবশ্য এর পুরো কৃতিত্ব অভীক দিতে চান স্ত্রীকে। সহাস্যে বলেন, ‘‘টিকলি (অলকানন্দার ডাকনাম) না থাকলে নতুন জীবনে আমার অনেক কিছুই করা হত না। পাহাড় ঘোরাও তার মধ্যে একটা। ও আমার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। আগে আমি বাইরে বেরোতে অস্বস্তি বোধ করতাম। টিকলি জীবনে আসায় সেই অস্বস্তি কোথায় চলে গিয়েছে। সকালে কোচিং করানো থাকে। তার পর সারা দিন কেটে যায় অফিসে (আয়কর বিভাগে কাজ করেন)। ফিরেও আবার কোচিংয়ে যাই। হুইলচেয়ারে বসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার জোর দিয়েছে টিকলি।’’
অভীককে নিয়ে রাস্তাঘাটে বেরোলে অনেকেই কেমন বাঁকা চোখে দেখতেন। শপিংমলের লিফটে হুইলচেয়ার নিয়ে উঠলে লোকজন বিরক্ত হতেন। প্রথম দিকে অভীককে নিয়ে কেউ কিছু বললে মেজাজ হারাতেন অলকানন্দা। দু’চার কথা উল্টে শুনিয়ে দিতেন। এখন অবশ্য তিনি অনেক বেশি শান্ত। অলকানন্দার কথায়, ‘‘আমার তো অনেক ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছে। সেই সময়ে অভীককে নিয়ে একটাও বাজে কথা আমি সহ্য করতাম না। এখনও করি না। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষাটা একটু বদলে গিয়েছে। এখন বুঝিয়ে বলি। তা ছাড়া আমার মনে হয়, যে যা বলছে বলুক। পাত্তা দিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমরা আমাদের মতো করে দারুণ আছি।’’
চারদিকে যখন বিচ্ছেদ, অসহিষ্ণুতা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মিছিল, সেই সময় দাঁড়িয়ে প্রেমের এমন আখ্যান ভরসা জোগায় কিছুটা হলেও। জীবনের দাবি আর গতানুগতিকতায় ভেসে যায় কত প্রতিশ্রুতি। হাতের উপর হাত রাখা তো সহজ নয়। সারা জীবন বইতে পারা আরও কঠিন। আসলে ভালবাসার এমন উদ্যাপন সকলে পারেন না। কেউ কেউ পারেন। আর পারেন যাঁরা, তাঁরা অভীক-অলকানন্দা হন, ভালবাসার নোটবুকে চিরকাল থেকে যায় নীরব রূপকথার ভাষ্যকার হয়ে!