শাঁখ সন্দেশ
এক বছর কয়েক মাস আগের কথা। পয়লা বৈশাখ আসতে তখনও দেরি আছে। একটা আইসক্রিম খেয়ে নতুন একটা সন্দেশের কথা মাথায় আসে পার্থ নন্দীর। পার্থবাবু বাঙালি মিষ্টির প্রবাদপ্রতিম নকুড়চন্দ্র নন্দীর পঞ্চম প্রজন্ম। উত্তর কলকাতার রামদুলাল স্ট্রিটে ৭ প্রজন্মের সন্দেশের দোকান তাঁদের। ১৮৪৪ সালে এই দোকান তৈরি করেন মহেশ দে। উত্তরাধিকার সূত্রে তা যায় ভাগ্নে গিরিশচন্দ্র দে-র হাতে। পরে মালিকানা পান গিরিশচন্দ্রের জামাই নকুড়চন্দ্র নন্দী। দেখতে দেখতে ১৭৭টি বসন্তের পার করেছে এই সন্দেশের দোকান। ‘গিরিশচন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড়চন্দ্র নন্দী’। প্রচলিত নাম ‘নকুড়’।
গত বছর পয়লা বৈশাখের আগে নতুন যে মিষ্টির কথা পার্থ নন্দীর মাথায় আসে, তার নাম রাখা হয়েছিল বাদামি। কাঠবাদামের আইসক্রিম খেয়ে সেই মিষ্টি বানানোর কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেই মিষ্টির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ এখনও হয়নি। কোভিডের কারণে দীর্ঘ দিন বন্ধ রাখতে হয়েছিল দোকান। এ বছর এখনও খোলা, কিন্তু করোনা সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে, তাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পার্থর।
বাঙালির পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের সঙ্গে কী ভাবে জুড়ে গিয়েছে নকুড়ের সন্দেশের নাম? পার্থ বলছেন, ‘‘পয়লা বৈশাখে নতুন মিষ্টি বানাতেই হবে, এমন কোনও পরিকল্পনা রাখি না। কিন্তু তার কয়েক মাস আগে একটা কিছু না কিছু এসেই যায়। তার পরে সেটা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলে। আমাদের মিষ্টিবোদ্ধা কিছু ক্রেতা রয়েছেন। তাঁদেরও খাওয়াই। সব মহল থেকে অনুমতি পেলে মিষ্টি চলে আসে দোকানের কাচের শোকেসে।’’
বাঙালি মিষ্টির দোকান। অথচ রসগোল্লা বানানো হয় না। এর কারণ কী? পার্থর কথায়, ‘‘রসগোল্লার অতটা রস নিয়ে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়, সেই কারণেই রসগোল্লা থেকে আমরা দূরে। তবে রসগোল্লা যে একেবারে বানানো হয় না, তা নয়। বছরে এক দিন বানানো হয়।’’ পয়লা বৈশাখেই কি? তাও নয়। বক্তব্য পার্থের। শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মদিনে। সেই রসগোল্লা বিক্রির জন্য নয়। সোজা যায় বেলুড় মঠে।
শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে ১৭৭ বছরের পুরনো এই দোকানের সম্পর্ক অবশ্য অনেক আগে থেকেই। শোনা যায়, স্বামী বিবেকানন্দ নাকি শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মদিনে সন্দেশ কিনতেন নকুড়ের দোকান থেকে। সত্যজিৎ রায় নিজে আসতেন। তাঁর পরিবারের সদস্যেরা আজও আসেন নকুড়ের সন্দেশের টানে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেও নিয়মিত যায় উত্তর কলকাতার এই দোকানের মিষ্টি।
মিষ্টিপ্রেমী বাঙালির মধ্যে বদল দেখেছেন কিছু? বাবার সঙ্গে ছোট থেকেই দোকানে বসতেন পার্থ। ‘‘বহু আগে যে সব মিষ্টিপ্রেমীরা দোকানে আসতেন, তাঁরা খুব বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা পছন্দ করতেন না। একটু অন্য রকম কিছু হলেই বলতেন, ‘ওরে, তোরা তো আর বাঙালি মিষ্টির দোকান রইলি না, অবাঙালি হয়ে গেলি’। কিন্তু নতুন প্রজন্মের মিষ্টিপ্রেমীরা তা নন। তাঁরা আধুনিক কিছু খেতে চান। নতুন চাকরি পাওয়া মেয়েটা বাড়ির জন্য তাই এখানকার সন্দেশই কিনতে আসেন। হাতখরচ বাঁচিয়ে স্কুলপড়ুয়াও চলে আসে নতুন কিছু সন্দেশ খেতে।’’
বাদামির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ এখনও হয়নি। কোভিডের কারণে পিছিয়ে গিয়েছে একটা বছর। সময় অবশ্য পিছিয়ে যায়নি। এক বছর এগিয়ে এসেছে। নকশাল আমলের তাণ্ডব থেকে দোকান বাঁচাতে যে লোহার গ্রিল বসেছিল, তার পিছনেই সাজছে ‘গিরিশচন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড়চন্দ্র নন্দী’-র সন্দেশের কাচের বাক্স। নববর্ষের জন্য। আবার সংক্রমণের আতঙ্কের মধ্যেই।