নদী, পাহাড় ও সবুজ উপত্যকায় ঘেরা ভুটানের পারোর প্রেমে পড়তে বেশি সময় লাগে না
Paro

পারো যদি যেতে পারো

পারো যেতে পারেন ফুন্টসিলিং, থিম্পু বা পুনাখা যে দিক থেকে আপনার মর্জি। সব রাস্তাতেই কমবেশি ঘণ্টা চারেক লাগার কথা। ভুটানের সমস্যা একটাই। পারমিট ছাড়া হবে না।

Advertisement
গৌরী শংকর গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:৫১
ভুটানের যদি কোনও বিউটি স্পট  থাকে, তবে সেটি পারো।

ভুটানের যদি কোনও বিউটি স্পট  থাকে, তবে সেটি পারো। ছবি: গৌরী শংকর গঙ্গোপাধ্যায়।

সুন্দরীদের যদি বিউটি স্পট থাকে, তা হলে সেই সুন্দরী পরমাসুন্দরী হয়ে ওঠেন। ভুটানের যদি কোনও বিউটি স্পট থাকে, তবে সেটি পারো। অনেকে থিম্পুর কথা বলবেন। রাজধানী, প্রাসাদ, সেচু উৎসবের জাঁকজমক, পাহাড়ের মাথায় বিশাল বুদ্ধমূর্তি। অনেকে বলবেন পুনাখার কথা। সুন্দর নদী, বিশাল জং আর ঝুলন্ত সেতু। কেন তবে পারো?

পারো আমার প্রথম দর্শনের প্রেম। তার আগে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল হিমালয়ের অজস্র গগনচুম্বী তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ দেখে। তার পর চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল কিশোরী পারো ছুকে উপর থেকে দেখে। নদীকে এখানে ছু বলে। আর শহরের নাম হয় নদীর নামে। বেশ রোম্যান্টিক! পারোয় নদীর ধারের হোটেলে থাকাই ভাল, বিমানবন্দরের উল্টো দিকে। খরচ একটু বেশি হবে, তবে চোখ জুড়িয়ে যাবে। নদী, পাহাড় আর বিমানবন্দর। অতুলনীয় ল্যান্ডস্কেপ। খেয়াল করে ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জ আর স্টোরেজ দেখে রাখবেন। ফোটোসেশন শেষ হতে চাইবে না। প্রাতরাশ আরও সুস্বাদু হয়ে উঠবে পারোর রূপে। যদি আকাশপথে পারোয় যেতে পারেন, তা হলে হিমালয়ের অগুনতি নামী-অনামী তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ দেখতে পাবেন, এমনকি এভারেস্টও। দেখা পাবেন সুন্দরী পারো ছুর। সব মিলিয়ে পাহাড়, নদী আর রংচঙে বাড়ি দেখে ভাল হয়ে যাবে মন। তবে মহামারির পর থেকে ফ্লাইটের ভাড়া অত্যন্ত বেশি। তাই ট্রেনে হাসিমারা পৌঁছে, সেখান থেকে গাড়িতে ভুটান বর্ডারে পৌঁছানো সহজ উপায়।

Advertisement

পারো যেতে পারেন ফুন্টসিলিং, থিম্পু বা পুনাখা যে দিক থেকে আপনার মর্জি। সব রাস্তাতেই কমবেশি ঘণ্টা চারেক লাগার কথা। ভুটানের সমস্যা একটাই। পারমিট ছাড়া হবে না। পারমিট যদি ভারত থেকে করে আসেন ঠিক আছে। না হলে, সময় নষ্ট হবে।

পারো ছু (পারো নদী)।

পারো ছু (পারো নদী)। ছবি: গৌরী শংকর গঙ্গোপাধ্যায়।

পারো এসে টাইগার নেস্ট যাওয়া মিস করবেন না। এটি একটি মনাস্ট্রি, যাকে ভুটানের পবিত্র গন্তব্য হিসেবে ধরা হয়। এর অবস্থান পাহাড়ের অনেকটা উপরে। পুরো রাস্তা হাঁটতে হয়। হালকা ট্রেক। সব মিলিয়ে সারা দিন লেগে যায়। যদিও শেষে হাজারখানেক সিঁড়ি নামা-ওঠার চাপ আছে। সিঁড়ি ভাঙার আগে একটি কাঠের তৈরি কাফে আছে। কফিও বানায় ভাল। ওখানে কফি বা নুডলস নিতে পারেন। মনাস্ট্রির ইতিহাস চমক লাগার মতো। ১৬৯২ সালে এটি তৈরি। গল্প অনুয়ায়ী, দেড় হাজার বছর আগে এখানকার একটি গুহায় গুরু রিনপচে তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে দানবদের শায়েস্তা করেন বাঘের পিঠে চড়ে। তিনি ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী।

আকাশ পরিষ্কার থাকলে ভাল লাগবে চেলেলা পাস। ভুটানের উচ্চতম গাড়ি যাওয়ার রাস্তা। পাসের উপর থেকে শ্বাসরোধকারী দৃশ্য দেখতে পারবেন। এপ্রিল মাসে রাস্তায় আপনাকে সঙ্গ দেবে নানা রঙের অজস্র রডোডেনড্রন। ১৩ হাজার ফুট উপর থেকে ভুটানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জমোলহরি দেখার অভিজ্ঞতা অনেকদিন মনে থাকবে। ভুটানের সবচেয়ে সুন্দর উপত্যকা হা ভালি চোখ জুড়িয়ে দেয়।

ভুটান মানেই জং। জং আগে শুধুই মনাস্ট্রি ছিল, এখন মিউজ়িয়াম। কোনও কোনও জংয়ের কিছু অংশ এখন সরকারি অফিস। দেখতে অনেকটা দুর্গের মতো। বেশির ভাগ জংয়ের অবস্থান নদীর ধারে। বেশ কিছু সময় তিব্বত থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের কাছ থেকে লুঠতরাজ বাঁচিয়েছে এরা। প্রায় পাঁচশো বছর আগে তৈরি পারো জং একটি দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে অনেক লামার থাকেন শিক্ষালাভের জন্য। অনেক দূর থেকে চোখে পড়ে জংয়ের স্থাপত্য ও বাহারি কারুকাজ। ভিতরেও অনেক স্থাপত্য, চিত্রকলা দেখার আছে, যা থেকে ভুটানের ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা হয়ে যাবে।

পারো বিমানবন্দর।

পারো বিমানবন্দর। ছবি: গৌরী শংকর গঙ্গোপাধ্যায়।

জংয়ের বাইরে বড়সড় মাঠে ভুটানের বিখ্যাত সেচু উৎসব হয়। পরব শুরু হয় পুজোর সময়। ভুটানের নিজস্ব সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। লোকগীতি, নাচ হয় মাঠ জুড়ে। শুধু পারো নয়, সারা ভুটানে। পুজোর সময় এলে একটা বেলা পায়ে হেঁটে পারো ঘোরার জন্য রাখবেন। দেখবেন পাহাড়ের উপর থেকে ঝুম চাষের খেত ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে নদীর দিকে। খেতগুলি সোনালি হয়ে থাকে পাকা ধানে। সূর্যের আলোয় যেন ঝলমলিয়ে ওঠে সোনার খেত। ভুটান বেড়াতে গেলে বর্ষা বাদে যে কোনও সময়ে যেতে পারেন। এপ্রিলে দেখতে পাবেন ফুল। অক্টোবরে সেচু উৎসব আর পাকা ধানের খেত। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ দেখা যায় নভেম্বরে।

আর পাঁচটা পাহাড়ি জায়গার থেকে ভুটান একটু আলাদা। এখানে ভাল থাকার মাপকাঠিটাই আলাদা। জিডিপি নয়, এখানে আনন্দে থাকাটাই বড়। ভুটান পৃথিবীর একমাত্র দেশ যা কার্বন নেগেটিভ। হাজার হাজার গাছ কেটে উন্নয়নের বদলে, প্রতি বছর কয়েক লক্ষ গাছ বসানো হয়। ভুটানে এলে আবর্জনা যত্রতত্র ফেলবেন না।

পরিশেষে জানিয়ে রাখা ভাল, ভুটান সরকারের তরফে মহামারির পরে বেশ কিছু নিয়ম জারি করা হয়েছে। পর্যটকেরা যত দিন সে দেশে থাকবেন প্রত্যেক দিন মাথাপিছু ১২০০ টাকা দিতে হবে। ১৮ বছরের কমবয়সিদের জন্য ৬০০ টাকা। প্রতিটি জং এবং দর্শনীয় স্থানে ঢোকার জন্য মাথাপিছু প্রবেশমূল্য ১০০০ টাকা। ছোটদের ক্ষেত্রে তা অর্ধেক। তবে টাইগার মনাস্ট্রির ক্ষেত্রে প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ২০০০ টাকা। ভুটানে বেড়াতে হলে হোটেল এবং গাড়ি বুক করতে হবে সেখানকার টুর অপারেটর মারফত। তাই সব মিলিয়ে এখন ভুটান বেড়ানো খরচসাপেক্ষ।

সেচু উৎসব।

সেচু উৎসব। ছবি: গৌরী শংকর গঙ্গোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন
Advertisement