Momo Chitte

চিত্ত জুড়ে মোমো! ঠেলাগাড়ি থেকে শুরু, দু’বছরে ১৮টি দোকান গড়েছেন অজয়নগরের তরুণী

বাঙালির ব্যবসা হয় না! এই ধারণা একেবারে ভেঙেচুরে দিয়েছেন ২৮ বছরের মৌমিতা মিস্ত্রি। শূন্য থেকে শুরু করে সেই তরুণীর সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার লড়াইয়ের গল্প শুনল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement
রিচা রায়
শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:১৫
Momo Chitte owner Moumita Mistry’s inspiring story of becoming an entrepreneur

মৌমিতা মিস্ত্রি। —নিজস্ব চিত্র।

প্রায় বছর চারেক আগের কথা। ২০২০ সাল।

Advertisement

গোটা পৃথিবীর মতোই শহর কলকাতা তখন অতিমারির কবলে। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যেত স্বজন হারানোর হাহাকার। লকডাউন তখন সবচেয়ে চর্চিত শব্দ। বেসরকারি সংস্থাগুলি কর্মিছাঁটাই করতে ব‍্যস্ত। রাস্তায় বেরোনোর আগে তাড়া করত ভয়। সেই ঘোর অমাবস‍্যায় পূর্ণিমার চাঁদ খুঁজতে ২৫ বছরের এক গোলগাল অকুতোভয় মেয়ে পা রেখেছিল রাস্তায়। সেই আকালেও দু’চোখে তাঁর সোনালি স্বপ্ন। আর মনে একটাই জেদ। পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে হবে। যতই তুফান আসুক, খড়কুটোর মতো ভেসে গেলে চলবে না। মৌমিতা মিস্ত্রি। এ গল্পের নায়িকা। মহানগর এবং হাওড়া মিলিয়ে ফিউশন মোমোর অন‍্যতম ঠিকানা ‘মোমো চিত্তে’র ১৮টি শাখা-বিপণির মালকিন।

এই লড়াই শূন‍্য থেকে শুরু করে আকাশ ছোঁয়ার গল্প বলে। স্বপ্ন সত্যি হওয়ার গল্প বলে। দক্ষিণ কলকাতার অজয়নগরের যৌথ পরিবারের মেয়ে মৌমিতা। বাবার মুদিখানার দোকান। মা গৃহবধূ। বাড়ির বাকি সদস‍্যেরা সকলেই চাকুরিজীবী। ভূগোল অনার্সের ছাত্রী মৌমিতাও প্রথমে ভেবেছিলেন স্কুলে পড়াবেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর নিয়তিতে লেখা থাকে অন‍্য কিছু। চাকরির বাজার ভাল নয়। একটি ম‍্যাট্রিমনিয়াল সংস্থায় ৭ হাজার টাকা বেতনের চাকরি জোগাড় করেন মৌমিতা। বোন ছোট। তাই বাবার পাশে তাঁকেই দাঁড়াতে হত। কাজ শুরু করলেন। গয়ংগচ্ছ ভাবে সব চলছিল। হঠাৎই অতিমারি আশীর্বাদ হয়ে নেমে এল মৌমিতার জীবনে। চাকরিটা চলে যায়।

কিন্তু এ মেয়ে ভাঙবে, তবু মচকাবে না

চাকরি গিয়েছে যাক। তাই বলে দু’হাত-পা ছড়িয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে ভাসালে চলবে না। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। নতুন কিছু করতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই জমানো ২৬ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে বাইপাসের ধারে এক অন্ধকার জায়গায় ঠেলাগাড়িতে মোমো বিক্রি শুরু। উদ্যোগ, পরিকল্পনা মৌমিতার হলেও পাশে থেকে সব সময় সাহায্য করেছিলেন তাঁর জীবনসঙ্গী বিদ্যুৎ হালদার। তখন অবশ্য বন্ধু ছিলেন। এখন আড়াই বছরের দাম্পত্য দু’জনের। মৌমিতা মনে করেন এই লড়াই তিনি জিততে পারতেন না, যদি পাশে এমন শক্ত কাঁধ না থাকত। মৌমিতা তাই জোর গলায় বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ আমার পাশে না থাকলে হয়তো এত কিছু করতে পারতাম না।’’

Momo Chitte owner Moumita Mistry’s inspiring story of becoming an entrepreneur

মৌমিতার লড়াইয়ের শুরু যেখান থেকে। —নিজস্ব চিত্র।

করোনার সময়ে মৌমিতা সমাজমাধ‍্যমে দোকানের প্রচার করতেন। বাড়ি বাড়ি অর্ডার পৌঁছেও দিতেন। প্রথমে স্টিম মোমো বিক্রি করতেন। কিন্তু আশপাশে আরও দু’-একটি মোমোর দোকান ছিল। বাকিদের প্রতিযোগিতায় পিছনে ফেলে দিতে ‘স্ট্র্যাটেজি’তে বদল আনলেন। মানুষের মনে জায়গা করে নিতে ভিন্ন স্বাদের মোমো বানাতে শুরু করেন। মাথা খাটিয়ে পিৎজ়া মোমো, মালাই মোমো বানাতেন। বুদ্ধি কাজে লেগেও গেল। কয়েক দিনেই দোকানের নাম লোকজনের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। তবে বাড়ির মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোমোর দোকান চালাচ্ছেন, অনেকেই তা ভাল ভাবে নেননি। তবে ছোট থেকেই মৌমিতার ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। অপ্রয়োজনীয় কথা কম শোনেন, কাজ বেশি করেন। নিজে সে কথা স্বীকারও করেন। তাই কারও কথার পরোয়া করতেন না। ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু বেশ কিছু কারণে দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়।

তবে হাল ছাড়ার পাত্রী নন মৌমিতা

সে বছরই হাইল‍্যান্ড পার্কে একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে মোমো বিক্রি করতে শুরু করেন। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তাই ফের দোকানে তালা পড়ে যায়। মৌমিতার জেদ আর ইচ্ছা হল সেই তালার চাবি। কয়েক মাস পরে ফের ‘মোমো চিত্তে’র দরজা খোলে। কথায় আছে, একটা দরজা বন্ধ হলে পাশাপাশি হাজারটা দরজা খুলে যায়। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আর ব‍্যবসায়িক বুদ্ধি খাটিয়ে দোকানটি দাঁড়িয়ে যায়। লড়াই সহজ ছিল না। কিন্তু মৌমিতার জেদের কাছে হার মেনেছে সব প্রতিবন্ধকতা।

Momo Chitte owner Moumita Mistry’s inspiring story of becoming an entrepreneur

নিজের হাতে গড়া মৌমিতার স্বপ্নের দোকান। —নিজস্ব চিত্র।

কাট টু

২০২২ সালের অগস্ট মাস থেকে একে একে দোকানের ডালপালা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বারুইপুরে প্রথম শাখা চালু হয়। তার পর সালকিয়া। তৃতীয়টি ঠাকুরপুকুরে। চতুর্থ হালতুতে...। ‘মোমো চিত্তে’-র সংখ্যা আপাতত ১৮। এ বছরই ৩০ ছুঁয়ে ফেলার ইচ্ছা রয়েছে মৌমিতার। ‘মোমো চিত্তে’-র প্রতিটি শাখাতেই অধিকাংশ কর্মীরা নারী। পুরুষ কর্মীও আছেন, তবে হাতেগোনা। তাঁরা শুধু দোকানের হেঁশেল সামলান। মোমো বিক্রি এবং টাকাপয়সার হিসাব রাখার দায়িত্ব সামলান মেয়েরা। হঠাৎ এমন ভাবনা কেন? মৌমিতা বলেন, ‘‘নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি মেয়েদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়া জরুরি। তাই আমি চাই আমার সংস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব মেয়েদের হাতেই থাক।’’

Momo Chitte owner Moumita Mistry’s inspiring story of becoming an entrepreneur

দোকানের মহিলা কর্মীদের সঙ্গে মৌমিতা। —নিজস্ব চিত্র।

চিকেন আফগানি মোমো, চিকেন তন্দুরি মোমো, গন্ধরাজ চিকেন প‍্যান ফ্রায়েড মোমো, বাটার গার্লিক মোমো— হরেক স্বাদের প্রায় ৭০ রকমের মোমো রয়েছে দোকানে। মেনু কার্ড বাদ দিলে দোকানের নামটিও কম নজরকাড়া নয়। বাঙালির ভোজনরসিকতা থেকে বিরহচেতনা, সবেতেই জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিন দেশে রবীন্দ্রনাথের পা পড়েছে দু’বার। ১৯২৪ সালে এক বার গিয়েছিলেন। চার বছর পর ১৯২৮-এ ফের এক বার যান। কিন্তু চিনে খাবারে তাঁর মন মজেছিল কি না, তা নিয়ে নানা জনের নানা বক্তব্য আছে, থাকবে। তবু এই চিনে খাবারের দোকানের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন। আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না ‘মোমো চিত্তে’ শব্দবন্ধের অনুপ্রেরণা রবি ঠাকুরের বিচিত্র পর্যায়ের সেই গান। মৌমিতা রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে ভালবাসেন? মৌমিতা বলেন, ‘‘ভীষণ ভাবেই। ছোট থেকে গানবাজনা করতাম। এখন সুযোগ আর সময় কোনওটাই হয় না। তবে সারা দিনের ব্যস্ততার পর রাতে বাড়ি ফিরে রবি ঠাকুরের গান শুনলেই সব ক্লান্তি দূরে চলে যায়।’’

বাঙালি যেমন রবীন্দ্রনাথের চর্চা করে, তেমনই বাঙালির ঝুঁকিবিমুখতা নিয়েও চর্চার অন্ত নেই। অথচ বাঙালির এমন অনেক ঝুঁকি নেওয়ার উদাহরণ রয়েছে, যা ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আসলে বাঙালির এই দুর্নাম, ব্যবসা এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এগিয়ে না আসার কারণেই। ব্যবসা এবং বিনিয়োগের সাম্রাজ্যে বাঙালির আনাগোনা কম বলেই হয়তো ‘বাঙালির দ্বারা ব্যবসা হবে না’ বলে দেওয়া যায় সহজেই। মৌমিতা কিন্তু তা মানতে নারাজ একেবারেই। তিনি মনে করেন, বাঙালির সবচেয়ে বড় মূলধন হল তাঁর ইচ্ছাশক্তি আর অদম্য-জেদ। সঙ্গে অনুঘটকের মতো কাজ করে পরিশ্রম। বাঙালি চাইলে দুর্গম পর্বতশৃঙ্গ ছুঁতে পারে, আবার বাইশ গজে ব্যাটে-বলে খেল দেখাতেও পারে। তবে বাণিজ্য আর বসতের সঙ্গে লক্ষ্মী জুড়ে থাকলেও, ব্যবসা করতে চাই— বাড়ির মেয়ের মুখে এমন ইচ্ছার কথা শুনে এখনও আঁতকে ওঠেন অনেকেই। মৌমিতার ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছিল। তবে মৌমিতা হাল ছাড়েননি, চিৎকার-চেঁচামেচি করে কণ্ঠও ছাড়েননি। শুধু নিজের স্বপ্নে যাপন করে গিয়েছেন। এক পা, দু’পা করে এগিয়েছেন। পরিকল্পনা করেছেন। উদ্যোগী হয়েছেন, উদ্যোগপতি হতে চেয়েছেন। ‘মোমো চিত্তে’ সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী এখনও নিজেকে সফল ব্যবসায়ী বলতে চান না। সাফল্যের সংজ্ঞা তাঁর কাছে অন্য। সফল হয়ে গেলেই তো আর কিছু করার থাকবে না। এখনও যে অনেক দূর হাঁটা বাকি।

আরও পড়ুন
Advertisement