কলকাতা যখন কমিকবুক হিরোদের দখলে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
এক বার সমাজমাধ্যমে একটা ছবি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল— টিনটিন, ক্যাপ্টেন হ্যাডক, কুট্টুস কলকাতায়। টিনটিনের পরনে বাঙালি বাবুর কেতায় ধুতি-পাঞ্জাবি, ক্যাপ্টেনও তথৈবচ। বলাই বাহুল্য, এটা টিনটিনের বাঙালি ফ্যানেদের কীর্তি। তার দুনিয়ায় টিনটিন বার দুয়েক ভারতে এলেও কলকাতায় আসেনি। কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না। কলকাতা সহজেই আপন করে নিয়েছে বেলজিয়ান লেখক-চিত্রীর আঁকা সাংবাদিকটিকে। যেমন একদা বাংলার শহর, মফস্সল, গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল ডেনকালির জঙ্গল, মাউইটানের পথঘাট, খুলিগুহা বা ফিসফিসে কুঞ্জবন। ফ্যান্টমের বাংলা নাম যে ‘অরণ্যদেব’ হতে পারে তা সুদূরতম স্বপ্নে তার স্রষ্টা লি ফক না ভাবলেও, বাঙালি ভাবতে পেরেছিল অনায়াসেই। কলকাতার দেওয়ালে দৃশ্যদূষণ মুছতে আঁকা হুঁকোমুখো হ্যাংলা বা কুমড়োপটাশের পাশে বাঁটুল দি গ্রেট বা হাঁদা-ভোঁদার সঙ্গে অনায়াসে মুখ দেখাতে পারে টিনটিন বা হ্যাডক। স্নোয়ি দিব্বি ‘কুট্টুস’ হয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে ঢুকে পড়ে বাঙলির বেডরুমে। কলকাতার মানুষের কমিকস-প্রেমের এর থেকে বড় উদাহরণ আর কী-ই বা হতে পারে! সেই কলকাতার বুকে যখন আয়োজিত হয় শুধুমাত্র কমিকসের জন্য একটা কার্নিভাল, তখন বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে অনেকেই বলে উঠতে পারেন— “সে কী! অ্যাদ্দিন হয়নি কেন?”
‘অ্যাদ্দিন’ হয়নি কথাটা বলা ভুল। কলকাতা কমিকস কার্নিভাল শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে। শুরুতে এই উৎসবের আয়োজন নিয়ে খানিক দ্বিধায় ভুগলেও উদ্যোক্তারা সহজেই বুঝতে পারেন, এ শহরের অলিতে গলিতে কমিকস-খ্যাপাদের সংখ্যা কিছু কম নয়। আর তা ছাড়া, ‘কমিকস’ বললেই যে ভিন্দেশি অনুষঙ্গ ভাবতে হবে, তা-ই বা কে বলেছে! নারায়ণ দেবনাথের কথা থাক। তিনি তো বাঙালির আবাল্য সঙ্গী। ময়ূখ চৌধুরী বা গৌতম কর্মকারের মতো প্রাপ্তমনস্ক কমিকস লেখক কি বাংলা দেখেনি? আর সে কাল থেকে এই অ্যাভেঞ্জার্স বা জাস্টিস লিগের সময়কালে কলকাতার নগরালিতে স্পাইডারম্যান থেকে ব্যাটম্যান, কোনান দ্য বারবারিয়ান থেকে ক্যাপ্টেন আমেরিকা… কে যে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েনি, তার হিসাব কে নেবে!
কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল কলকাতা কমিকস কার্নিভালের অন্যতম আয়োজক শুভময় কুন্ডুর সঙ্গে আলাপ সারতে গিয়ে। শুভময় ‘কলকাতা কমিকস’ নামে এক প্রকাশনার কর্ণধার। তাঁর লক্ষ্য, বাংলা ভাষায় প্রাপ্তবয়স্ক তথা প্রাপ্তমনস্কদের জন্য কমিকস প্রকাশ। সোজা কথায়, কমিকস যে নেহাতই শিশুতোষ ব্যাপার নয়, এ কথা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে গেলেও বাংলার এক বড় অংশের মানুষ কমিকস, গ্রাফিক নভেল বা মাঙ্গাকে ‘সিরিয়াস’ সাহিত্যের চৌহদ্দির বাইরে রাখেন। সেই অভ্যাসটিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিশ্বমানের কমিকস প্রকাশই কলকাতা কমিকসের উদ্দেশ্য। এমন উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করতে সবার আগে যা দরকার পড়ে, তা সমমনস্ক মানুষের সঙ্গে এক রকম সংযোগ তৈরি। খানিকটা সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ২০২০-তে আইসিসিআর-এ আয়োজিত হয়েছিল কলকাতা কমিকস কার্নিভালের প্রথম অধিবেশন। প্রথমে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে শুভময়রা দেখতে চেয়েছিলেন, কেমন সাড়া পাওয়া যায়। সাড়া যে বেশ আশাব্যঞ্জকই ছিল, তা বুঝতে পারেন প্রথম আয়োজনেই। তার পর এক বার স্থানবদল করে নজরুল তীর্থে আয়োজিত হয় কার্নিভাল। গত বছর থেকে ধনধান্য অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে কলকাতা কমিকস কার্নিভাল। ২০২৫-এর কার্নিভালের আয়োজনও সেখানে। উৎসব শুরু হয়েছে ৩ জানুয়ারি এবং চলবে ৫ তারিখ পর্যন্ত।
পশ্চিমি বিশ্বে ‘কমিক কন’ বা কমিক বুক কনভেনশনের আয়োজন ষাটের দশক থেকেই হয়ে আসছে। কলকাতা কেন সেই স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকবে— এমন ভাবনাই কাজ করেছিল গোড়া থেকে আয়োজকদের মনে। কমিকস দুনিয়া মানে আজ শুধু ছাপা বই নয়। দুই মলাটের গণ্ডি অতিক্রম করে বড়-মেজো-ছোট পর্দায় কমিকস দুনিয়ার ছায়া প্রলম্বিত হয়েছে দীর্ঘ দিন। পর্দা টপকে তা আছড়ে পড়েছে মার্চেন্ডাইজ়ের জগতে। পোস্টার, কস্টিউম থেকে শুরু করে সুপারহিরোদের অস্ত্রশস্ত্র, মডেল, ভিডিয়ো গেম আজ যেন এক সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ডকেই তৈরি করে ফেলেছে। আজকের এই ব্রহ্মাণ্ডের পাশটিতেই বাস করে নস্ট্যালজিয়া। অরণ্যদেব, জাদুকর ম্যানড্রেক, ফ্ল্যাশ গর্ডন বা হি ম্যানের সঙ্গ করা প্রজন্মও শামিল হয়ে পড়েন এই দুনিয়ার। ফলে কলকাতা কমিকস কার্নিভাল এখন শুধু খুদে বা ইয়ং অ্যাডাল্ট সম্প্রদায়ের জন্য নয়, মাথায় রুপোলি চুলের ঝিলিক নিয়ে পঞ্চাশ কি ষাটোর্ধ্বরাও ঢুকে পড়ছেন অনায়াসে এই কার্নিভালে।
শুভময় জানালেন, কার্নিভালে যেমন সদ্য প্রকাশিত বিদেশি কমিকস থাকে, তেমনই স্টলের টেবিল আলো করে ফেলে আসা দিনের ইন্দ্রজাল কমিকস, ডিসি বা অমর চিত্র কথাও। পাশাপাশি কমিক বুক নায়কদের অ্যাকশন ফিগার, পোস্টার, টিশার্ট, ব্যাজ ইত্যাদি সামগ্রীর প্রলোভন তো রয়েইছে। ৫ টাকা থেকে ২০-২৫ হাজার টাকার মার্চেন্ডাইজ়ের বিকিকিনি চলে এখানে। সামুরাইয়ের লিকলিকে বাঁকা তরোয়াল থেকে স্পাইডারম্যানের মুখোশ, সবই এই তিন দিন এক ছাদের নীচে। নস্ট্যালজিয়াও এই কার্নিভালের অন্যতম পুঁজি। হারিয়ে যাওয়া, কিছু দিন প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া কমিকস এখানে পাওয়া যায়। স্মৃতিতে টান পড়ায় হঠাৎই ঝিলিক দিল এক অদ্ভুত ঘটনা। আশির দশকের শেষ দিকে রুস ম্যানিংয়ের টারজ়ান তখন ‘আনন্দমেলা’র কল্যাণে দারুণ জনপ্রিয়। এমন সময়ে বাজারে আসে ‘টারজ়ানের তরবারি’ নামে এক কমিকস। বাড়ির কুচোকাঁচাদের ঝুলোঝুলিতে সে বই কিনে ফেলে বেদম ফ্যাসাদে পড়েছিলেন অনেক অভিভাবকই। টারজ়ানের নাম দিয়ে প্রকাশিত সে কমিকস ছিল আসলে কোনান সিরিজের একটি কাহিনি। কে বা কাহারা যে বুঝে অথবা না-বুঝে একান্ত ‘বড়দের’ কোনান-কাহিনিকে ‘শিশুপাঠ্য’ টারজ়ান হিসেবে বঙ্গান্তর করে বাজারে ছেড়েছিলেন, তা জানার উপায় নেই। কিন্তু, শুভময় জানালেন, তাঁদের সংগ্রহে সেই বইও রয়েছে। কেনা না যাক, এক বার চাক্ষুষ করে ফেলতেই পারেন সে দিনের ছোটরা। এমন ভাবেই এক কালের জনপ্রিয় চাচা চৌধুরী বা বাহাদুরও লভ্য এই মেলায়।
আজকের প্রজন্ম অবশ্য বেশি আগ্রহী সিনেমায় দেখা চিত্রদের কমিকস কিনতে। অরণ্যদেব তথা বেতাল বা ম্যানড্রেকের জনপ্রিয়তা স্মৃতিতাড়িত প্রজন্মেই সীমিত। শুভময়ের মতে, বেতাল বা ম্যানড্রেককে সে ভাবে বাজারজাত করা হয়নি। তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য সিনেমাও তো বানানো হয়নি তাদের নিয়ে। অরণ্যদেব বা ফ্যান্টমকে নিয়ে একটি ছবির কথা মনে উঁকি দিতে পারে বুজ়ুর্গ প্রজন্মের। পাশাপাশি পোড়খাওয়া সিনেমাপোকারা মনে করতেই পারেন ফেদেরিকো ফেলিনির ১৯৮৭-এর ছবি ‘ইন্টারভিস্তা’র কথা। যে ছবিতে মার্চেল্লো মাস্ত্রোয়ানি আবির্ভূত হয়েছিলেন জাদুকর ম্যানড্রেক হিসাবে। সে ছবি দেখেননি যাঁরা তাঁরাও অন্দরে-অন্তরে জানেন ম্যানড্রেক, লোথার, জাদু কলেজ অথবা দুর্ধর্ষ দুশমন অক্টনকে ভোলা কিছুতেই সম্ভব নয়।
বিদেশে কমিক কন-এর অন্যতম আকর্ষণ ‘কসপ্লে’। কমিকসের চরিত্র সেজে বিভিন্ন রকমের ‘পারফরম্যান্স’। কার্নিভালে দেখা মিলতেই পারে সব রকমের স্পাইডারম্যানের, ছায়াপুরুষ ব্যাটম্যানের অথবা সবুজ বর্ণের হাল্কের। শুধু নায়কেরা কেন, খলনায়কেরাই বা কি কম জনপ্রিয় এই ব্রহ্মাণ্ডে! জোকার তো আজ আন্তর্জাতিক বিগ্রহ! বাংলা ভাষায় ক্যাপশন লেখা টিশার্টেও জোকারের বেদনাময় অথচ অম্লান হাসি জ্বলজ্বল করছে। কসপ্লের জন্য কার্নিভাল চত্বরের একপাশে মঞ্চ রয়েছে। তাতে বন বন করে কেউ মাশাটে ঘোরাতেই পারেন অথবা ব্যাটম্যানের কালো উত্তরীয় সরিয়ে উঁকি দিতেই পারেন টু ফেস বা পেঙ্গুইন সেজে।
কমিক্সের পাশে শোভা পাচ্ছে জুনজি ইতোর ‘উজ়ুমাকি’ বা ‘টোমি’র মতো গ্রাফিক নভেল তথা মাঙ্গাও। তবে কমিকসের বিক্রিই বেশি কার্নিভালে, জানালেন শুভময়। পাল্লা দিয়ে বিক্রি হয় মার্চেন্ডাইজ়ও। এ বছর ৩২টি সংস্থা বা ব্যক্তি অংশ নিচ্ছেন কার্নিভালে। এঁদের মধ্যে কমিকস সংগ্রাহকেরাও রয়েছেন। কিন্তু কেন মাত্র তিন দিন? শুভময়ের কথায়, “ভাল জিনিস বেশি দিন ধরে চলা ভাল নয়।” তবে আসল সমস্যা স্পনসরের। এখনও কোনও ‘বড় হাত’ এগিয়ে আসেনি শহর কলকাতার মুকুটে সংযোজিত নতুন পালকটির পৃষ্ঠপোষকতায়।
গত বছরও বাংলাদেশের কমিকস বা গ্রাফিক নভেল প্রকাশকেরা এসেছিলেন, এ বার সে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাঁরাও গরহাজির। অথচ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে গ্রাফিক নভেল এক অতি জনপ্রিয় সাহিত্য। তাঁদের প্রকাশনার মানও বেশ উঁচু। তাঁদের অনুপস্থিতি খানিকটা মনখারাপ তৈরি করছে কমিকস-প্রেমীদের কাছে। তবে জাপানি মাঙ্গা বা অ্যানিমে নিয়ে ছোট-বড় সব বয়সের কমিকস-খ্যাপাদের উল্লাস চোখে পড়ার মতোই। নিল গেইম্যান থেক জো হিল, লি ফক থেকে বব কেন— সকলেই হাজির শীতের কলকাতায়।
কার্নিভাল ফেরত খুদের হাতে চমকাচ্ছে ডেডপুলের অস্ত্র, মুখে আয়রনম্যানের মুখোশ। তার পাশটিতে হাঁটতে হাঁটতে চল্লিশোর্ধ্ব বাবা কিনে ফেলেছেন কবেকার হারিয়ে যাওয়া ইন্দ্রজাল কমিকস ‘বেতালের বিয়ে’। ডেনকালির অরণ্যে খুলিগুহায় আয়োজিত সেই বিয়ের আসরে আইভরিলানার প্রেসিডেন্ট লুয়াগা আর জাদুকর ম্যানড্রেকের সঙ্গে নিমন্ত্রিত ছিলেন তিনিও। ভোজ অসম্পুর্ণ থেকে গিয়েছিল বইখানি হারিয়ে যাওয়ায়। আজ আবার নেমন্তন্ন। এই সব পরিতৃপ্তির ফাঁক দিয়ে আকাশে কি ভেসে উঠল বাদুড়ছায়া? একটা বাঁক ঘুরলে নির্জন ফুটপাথে টকটকে লাল রঙের হাসি ছড়িয়ে কেউ বলে উঠতেই পারে— “হোয়াই সো সিরিয়াস?” তার আপাত হাসিমুখের পিছনে খেলে যাচ্ছে ক্রুরতা আর বিষাদের বর্ণমালা… কলকাতা সত্যিই গথাম সিটি এই তিন দিন।
ছবি: শুভময় কুন্ডুর সৌজন্যে