Fruits

FAD Diet: ফ্যাড ডায়েটের সাত-সতেরো

প্রাণিজ খাদ্য বাদ দেওয়া হয়। আনাজ, দানাশস্য, বাদাম ও ফল ছাড়া বিশেষ কিছু খাওয়া হয় না। দুধ খেতে হলে বেছে নিতে হয় আমন্ড বা কোকোনাট মিল্ক।

Advertisement
শ্রেয়া ঠাকুর
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২১ ০৮:৪১

শীত শুরু মানে পার্টি সিজ়ন শুরু। বারবিকিউ পার্টি, ক্রিসমাস, বর্ষপূর্তির উৎসবে খাওয়াদাওয়া তো হবেই। আর শীতের মরসুম মানেই পিঠে, কেক তৈরি শুরু। পার্টি সিজ়নের হুল্লোড় আর খাওয়াদাওয়ার পরেই আবার আসে রেজ়লিউশন, ‘জানুয়ারিতে বুঁচকি মাসির মেয়ের বিয়ে, তার আগে ২০ কেজি তো কমাবই কমাব!’ এই রেজ়লিউশনের হাত ধরে যাপনে ধীরে-ধীরে প্রবেশ করে ফ্যাড ডায়েট।

ফ্যাড ডায়েট কী?

Advertisement

‘এক মাসে রোগা হওয়া’- ফ্যাড ডায়েটের মূলমন্ত্র। দৈনিক খাদ্যাভ্যাসের বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে দ্রুত ওজন কমানোর পদ্ধতিকে বলা হয় ফ্যাড ডায়েট। পুষ্টিবিদ প্রিয়া আগরওয়াল বললেন, “দ্রুত ওজন কমানোর জন্য গত ৫-৬ বছর ধরে জনপ্রিয় হয়েছে ডায়েটের এই ধরন। কিন্তু এটি আদতে বিজ্ঞানসম্মত নয়। আইসিএমআর (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ) এই ধরনের ডায়েটকে মান্যতা দেয় না। ফ্যাড ডায়েটে যে ধরনের খাদ্যাভ্যাসের কথা বলা হয়, তা টানা মেনে চলাও যায় না।’’

জনপ্রিয়তাই এর জনক

‘চট করে রোগা হয়ে যান’- এই ডায়েটের মূল উপজীব্য। সাধারণত, একটি বিশেষ খাদ্যাভ্যাস পদ্ধতি মেনে কেউ ওজন কমাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি সেটার প্রচার করতে শুরু করলেন। তাতে কেউ লাভবান হলেন, কেউ হলেন না। কিন্তু অনেকের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হল যে, এই ডায়েটেই ওজন কমবে। ফ্যাড ডায়েটের সূচনা হয় এ ভাবেই।

* এই ধরনের ডায়েটে খুব সহজেই কিছু খাবারকে ‘উপকারী’ ও কিছু খাবারকে ‘অপকারী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। বাস্তবে পূর্ণবয়স্ক মানুষের খাদ্যে সব রকম উপাদানেরই প্রয়োজন রয়েছে।

* বিভিন্ন খাবার ও ডায়েটারি সাপ্লিমেন্টকে ‘ফ্যাট বার্নার’, ‘মেটাবলিজ়ম বুস্টার’ আখ্যা দেওয়া হয় এই ডায়েটে। অথচ নিয়মিত ব্যায়াম কিন্তু সর্বোৎকৃষ্ট ফ্যাট বার্নার ও মেটাবলিজ়ম বুস্টার...

* সুষম আহারের মধ্যে মূলত পাঁচটি খাদ্যের ভাগ রয়েছে— ফল, আনাজ, শস্য, প্রোটিন ও দুগ্ধজাত খাবার। ফ্যাড ডায়েটে যে কোনও একটি খাদ্যের ভাগকে সম্পূর্ণ বাদ দে‌ওয়া হয়।

পুষ্টিবিদ কোয়েল পালচৌধুরীর মতে, ‘ফ্যাড’ মাত্রই ভুল ধারণা, “এগুলিতে শরীরের ক্ষতি হয়। শর্করা কমিয়ে ফ্যাটের পরিমাণ বাড়ালে শরীরে কিটোসিস হতে পারে। সম্ভাবনা থাকে ফ্যাটি লিভার হওয়ার। একটা সময়ের পরে বাড়তে থাকে রিভেঞ্জ ইটিংয়ের প্রবণতা।”

ফ্যাড ডায়েটে রকমফের

ফ্যাড ডায়েটের ইতিহাসে অনেক দিন ধরে রয়েছে অ্যাটকিনস ডায়েট। এতে কার্বোহাইড্রেট বাদ দিতে বলা হয়। যত ইচ্ছে প্রোটিন ও ফ্যাট খাওয়া যায়। প্রিয়া জানালেন, দশ বছর আগেও মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিল অ্যাটকিনস। ‌এখন সেই স্থান নিয়েছে কিটো।

* কিটো ডায়েট— খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে কার্বোহাইড্রেট। বেশি করে খেতে হবে ফ্যাট জাতীয় খাবার। সঙ্গে সামান্য প্রোটিন। আর তা থেকেই শরীরে এনার্জির ঘাটতি মিটবে। দীর্ঘ দিন ধরে এই ডায়েট মেনে চললে ক্রমে দেখা দিতে পারে প্যানক্রিয়াসের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য। হজমের সমস্যাও শুরু হয়। যদিও গোড়ার দিকে ওজন কমে। পুষ্টিবিদ সুবর্ণা রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘অতিরিক্ত প্রোটিন খাওয়ার ফলে কিডনির নানা সমস্যাও দেখা দিতে পারে।’’ একই কথা শোনা গেল পুষ্টিবিদ প্রিয়া আগরওয়ালের কাছে, ‘‘উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা বা অ্যানজাইনা থাকলে এই ডায়েট অত্যন্ত ক্ষতিকর।’’

* ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং— ওজন কমানোর জন্য বেশ ‘ইন থিং’ এই ডায়েট। এককথায়, রোজ অল্প অল্প করে উপোস করার পদ্ধতি। ধরুন, সকাল সাতটায় ভারী ব্রেকফাস্ট করলেন। তার পর বিকেল তিনটেয় ভারী কিছু খেলেন। মাঝের সময়টা উপোস। এ ভাবে উপোসের সময় বাড়িয়ে ২৪ ঘণ্টায় নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এই ডায়েটে সমস্যা কোথায়? দুর্বলতা, হজমে সমস্যা, বিশেষত ডায়াবেটিক রোগীদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। প্রিয়া বললেন, “ঠিক ভাবে করতে পারলে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কাজে দেয়। কিন্তু মুশকিল হল, এটা ঠিক ভাবে পালন করা অত্যন্ত কঠিন।”

* ভিগান ডায়েট— প্রাণিজ খাদ্য বাদ দেওয়া হয়। আনাজ, দানাশস্য, বাদাম ও ফল ছাড়া বিশেষ কিছু খাওয়া হয় না। দুধ খেতে হলে বেছে নিতে হয় আমন্ড বা কোকোনাট মিল্ক। কম ক্যালরির বেশি ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার কারণে ওজন প্রাথমিক ভাবে খানিক কমে। কিন্তু তার পরেই হয় সমস্যা। শরীরে ব্যাপক ভাবে আয়রন, ফোলেট, ক্যালশিয়াম ও ভিটামিন বি-এর অভাব হয়।

* প্যালিয়ো ডায়েট— এই ডায়েট ভিগান ডায়েটের একেবারে বিপরীত। মূলত পর্যাপ্ত পরিমাণে মাংস খেতে হয়। সঙ্গে দুগ্ধজাত, শস্যজাতীয় খাদ্য ও আনাজ। মাত্রাতিরিক্ত মাংস খাওয়ার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য, বদহজম, ডায়েরিয়া ছাড়াও কোলেস্টেরল ও ইউরিক অ্যাসিডের উচ্চ মাত্রা দেখা দিতে পারে। হতে পারে বাতও।

* মেডিটেরেনিয়ান ডায়েট— মূলত ডাল ও দানাশস্য জাতীয় খাবার খেতে বলা হয়। বাদ দিতে বলা হয় রেড মিট। সব রান্নাই অলিভ অয়েলে করা হয়। রেড ওয়াইন পান করার কথাও বলা হয় এই ডায়েটে। কমিয়ে ফেলতে বলা হয় দুগ্ধজাত দ্রব্য। ফল? দেখা দিতে পারে ক্যালশিয়ামের অভাব। উচ্চ পটাশিয়াম ও অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা হতে পারে।

* জ়োন ডায়েট— সাধারণত স্থানীয় খাবার থাকে খাদ্যতালিকায়। খাবারের ভাগ এমন থাকে, যাতে ৪০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ৩০ শতাংশ প্রোটি‌ন ও ৩০ শতাংশ ফ্যাট থাকে। এই ডায়েটে দুগ্ধজাত উপাদান কম থাকায় ক্যালশিয়ামের অভাব হয়।

ফ্যাড ডায়েটের ক্ষতিকর দিক

দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা বলে আসছেন, ওজন কমানোর যে কোনও রকম চটজলদি পদ্ধতি অস্বাস্থ্যকর। ফ্যাড ডায়েট মেনে চললে প্রাথমিক ভাবে যে ওজন কমে, তা আসলে আমাদের দেহের জলের পরিমাণ। নিয়মিত পুষ্টিসম্মত ডায়েট ও ব্যায়াম ছাড়া ওজন কমানো বেশ মুশকিল। রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি ক্ষতিকর দিক। পুষ্টিবিদ সুবর্ণা রায়চৌধুরীর কথায়, “খুব বেশি হলে পাঁচ-সাত দিন এ ধরনের ডায়েট মেনে চলা যেতে পারে, কিন্তু তার বেশি হলেই শরীরের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। শরীরকে শক্তি ও কার্যক্ষমতা জোগান দেওয়ার জন্য প্রয়োজন কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাড ডায়েটে সেটাই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শরীরে ঘাটতি জমতে-জমতে দেখা দিতে পারে ক্লান্তি ও দুর্বলতার। সুবর্ণা আরও জানালেন, এক জন পুষ্টিবিদ যে ধরনের সুষম খাদ্যতালিকার কথা বলেন, এই ফ্যাড ডায়েটে সেই সুষম বিষয়টিই অনেক কম থাকে।

* আগেই বলা হয়েছে, চটজলদি ওজন কমানোর ডায়েটে আদতে যে ওজন কমে তা শরীরের জলের ভাগ। শরীরে জলের পরিমাণ কমতে থাকে বলে ডিহাইড্রেশনের সম্ভাবনা থাকে।

* হঠাৎ করে খাওয়া কমিয়ে দিলে শরীরে এনার্জির ঘাটতি দেখা যায়। ফলে ক্লান্তি ও দুর্বলতা দেখা যেতে পারে।

* খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, হঠাৎ করে শুধু ফাইবার খাওয়া বা শুধু মাংস বা উপোস, ডেকে আনতে পারে গ্যাস্ট্রিক আলসার ও অ্যাসিড রিফ্লাক্সের মতো সমস্যাও।
* এ ধরনের ডায়েটের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হল অপুষ্টি। বিভিন্ন খাবার বাদ দেওয়ার কারণে প্রায়শই ক্যালশিয়াম, আয়রন ইত্যাদির অভাব দেখা যায়। ফল হতে পারে গুরুতর।

সুবর্ণা বললেন, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সুষম আহার। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য খাদ্যের সব উপাদান গুরুত্বপূর্ণ। অবৈজ্ঞানিক প্রথায় ডায়েট করলে শরীরের সেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমতে থাকে ধীরে-ধীরে। প্রিয়ার মতে, ওজন কমাতে মাঝেসাঝে ফ্যাড ডায়েট মানা যেতে পারে, কিন্তু কখনওই এক মাসের বেশি নয়। আর তার জন্য অবশ্যই পুষ্টিবিদ ও ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

মডেল: অঙ্কিতা মজুমদার পাল

ছবি: দেবর্ষি সরকার

Advertisement
আরও পড়ুন