অ্যাডিনোর ফলে কি ফাইব্রোসিসের আশঙ্কা বাড়ছে। প্রতীকী ছবি।
গত কয়েক মাসে পর পর শিশু-মৃত্যুর ঘটনার জেরে অ্যাডিনোভাইরাস নিয়ে নির্দেশিকা জারি করেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু, বিপদ কি শুধু ছোটদের? বড়দের শরীরে এই ভাইরাসের প্রভাব কতটা?
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বড়রাও অ্যাডিনোয় সংক্রমিত হয়েছেন। কারণ, ছোটরা সংক্রমিত হওয়ায় সেই রোগ তাদের বাবা ও মায়েদের মধ্যেও ছড়িয়েছে। তবে, বড়দের শরীরে সেই অর্থে তার প্রভাব পড়েনি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে সর্দি, কাশি বা জ্বরেই নিস্তার মিলেছে। কিন্তু, যাঁদের শরীরে প্রভাব পড়েছে, তাঁদের কেউ কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আইসিইউ, এমনকি, ভেন্টিলেশনেও থেকেছেন। কলকাতার কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের সাম্প্রতিক তথ্য থেকে এমনটাই জানা যাচ্ছে। কেন একই ভাইরাসের সংক্রমণে এমন প্রভেদ?
সংক্রমণের বাড়াবাড়ির জন্য চিকিৎসকেরা দু’টি কারণকে চিহ্নিত করেছেন। এক, কোমর্বিডিটি। দুই, সেকেন্ডারি ইনফেকশন (এ ক্ষেত্রে ব্যাক্টিরিয়া সংক্রমণ)। হৃৎপিণ্ড, বৃক্ক বা যকৃতের অসুখ, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ, ডায়াবিটিসের সমস্যা থাকলে অথবা অঙ্গ প্রতিস্থাপন হওয়া রোগী অ্যাডিনোভাইরাসে সংক্রমিত হলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে। তবে, এ সব না থাকা সত্ত্বেও কমবয়সি কিছু রোগীকে আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনে থাকতে হয়েছিল।
যেমন, অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের বক্ষরোগ চিকিৎসক দেবরাজ যশ বলছেন, ‘‘চলতি মার্চেই অ্যাডিনোভাইরাসে সংক্রমণের কারণে ন’জন প্রাপ্তবয়স্ক ভেন্টিলেশন থেকে ফিরেছেন। এঁদের কম্প্রিহেনসিভ রেসপিরেটরি প্যানেল করে অ্যাডিনোভাইরাস পজ়িটিভ এসেছিল।’’ ওই চিকিৎসক জানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে মধ্য তিরিশের দু’জন মা এবং ২১ বছরের এক যুবকও আছেন। অথচ তাঁদের কোমর্বিডিটি ছিল না। দুই মায়েরই সন্তানেরা অ্যাডিনোয় সংক্রমিত হয়েছিল।’’
অনেকের প্রথমে জ্বর বা কাশির মতো মৃদু উপসর্গ থাকলেও পরে শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি প্রবল ভাবে চেপে ধরেছে। তাঁদের পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, অ্যাডিনোভাইরাসের পিছু পিছু শরীরে ঢুকেছে ব্যাক্টিরিয়া। কোমর্বিডিটি নেই, তবু সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত প্রসঙ্গে বক্ষরোগ চিকিৎসক রাজা ধর বলছেন, ‘‘করোনার সময়েও দেখা গিয়েছিল, প্রাপ্তবয়স্কদের এক শ্রেণির মধ্যে ভাইরাসের সঙ্গে রোগ প্রতিরোধের লড়াই এতটাই ভয়ঙ্কর হয় যে, নিজের ফুসফুস বা বিভিন্ন অঙ্গের সুস্থ টিসুরও ক্ষতি করে দেয়। তাতে সংক্রমণের মাত্রা ভয়াবহ হয়। তবে, এঁদের সংখ্যা কম। যে কোনও ভাইরাসের সংক্রমণেই এঁদের এমন প্রবণতা থাকে।’’
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, যে কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সেরে উঠলেও মাসখানেক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নড়বড়ে থাকে। তখন বাসা বাঁধতে পারে ব্যাক্টিরিয়া। স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনিয়া, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো কিছু ব্যাক্টিরিয়া এ বছর অ্যাডিনো সংক্রমিতদের কারও কারও অবস্থা জটিল করেছে। সংক্রামক রোগের চিকিৎসক যোগীরাজ রায়ের পর্যবেক্ষণ, ‘‘সরকারি হাসপাতালে প্রাপ্তবয়স্ক অ্যাডিনোভাইরাসের রোগী বেশি ভর্তি হননি। তার কারণ, সরকারি পরিকাঠামোয় অ্যাডিনোর ব্যয়বহুল পরীক্ষা না হওয়া। মূলত মৃদু উপসর্গ নিয়ে বাড়িতেই সেরে উঠছেন বড়রা। যাঁরা সঙ্কটজনক হচ্ছেন, তাঁরা অনেকেই বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন। শম্ভুনাথ পণ্ডিতে অ্যাডিনো ছাড়াও অন্যান্য ভাইরাস, নিউমোনিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার রোগীরাও ভর্তি। তাঁদের এক্স-রে দেখে, অন্য পরীক্ষা করে ও উপসর্গ বুঝে চিকিৎসা হচ্ছে।’’
ভাইরাসের সংক্রমণের পর পর ব্যাক্টিরিয়ার সংক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করছেন কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ারের চিকিৎসক কৌশিক মুন্সী। তিনি বলছেন, ‘‘সেকেন্ডারি ইনফেকশন যাতে না হয়, সতর্ক থাকতে হবে। সেরে ওঠার পরেও শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন কমে যাওয়া, জ্বর, কাশি না কমলে ডাক্তার দেখাতেই হবে।’’
সুস্থ হয়েও মাস দুয়েকে কড়া নজরদারিতে থাকার কথা বলছেন চিকিৎসকেরা। তখনও শ্বাসকষ্ট বা কাশি না কমলে ডাক্তার দেখাতে হবে। কারণ, ওই সব সমস্যা ফুসফুসে ফাইব্রোসিসের আশঙ্কা বাড়ায়। অ্যাডিনোর ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে কি না, আগামী মাস দুয়েকেই বোঝা যাবে।