রাত পোহালেই মহালয়া। ছবি: সংগৃহীত।
রাত পোহালেই মহালয়া। শনিবার তো বটেই, শুক্রবার রাত থেকেই মোবাইলে ‘শুভ মহালয়া’ মেসেজ আসতে শুরু করবে। সমাজমাধ্যমে শুরু হবে বিতর্ক। কেউ বলবেন, পিতৃতর্পণের দিনকে ‘শুভ’ বলা যায় নাকি! কেউ জবাবে বলবেন, মানুষকে শুভেচ্ছা জানাতে আবার তিথি মানতে হয় নাকি! এরও পাল্টা জবাব রয়েছে— তিথিই না মানলে মহালয়ার দিন আলাদা করে মেসেজ পাঠানোর কী রয়েছে?
এ বাঙালির প্রতি বছরের বিতর্ক। সেই তর্কাতর্কিতে না গিয়ে, বরং জেনে নেওয়া যাক শাস্ত্রজ্ঞেরা কী বলছেন। পশ্চিমবঙ্গ বৈদিক আকাদেমির রাজ্য সম্পাদক নবকুমার ভট্টাচার্যকে এই প্রশ্ন করতেই রাগী জবাব শোনা গেল। তিনি বললেন, ‘‘এটা হচ্ছে হুজুগের সময়। কোনও নিয়ম না মেনেই মানুষ যা ইচ্ছে করে। মহলয়ার দিনটা পার্বন শ্রাদ্ধের দিন। এই দিন পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য তর্পণ করে জল দেওয়া হয়। সেই দিনটা শুভ হয় কী করে?’’ নবকুমারের আরও প্রশ্ন, ‘‘বিবাহকে শুভ বলা হয়। মহালয়াকে শুভ বলা হলে এর পরে তো ‘শুভ শ্রাদ্ধ’ বলাকেও সঠিক হিসাবে মানতে হবে।’’
‘শুভ মহালয়া’ কেন বলা ঠিক নয়, তা শোনা গেল প্রবীণ পুরোহিত তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্যের মুখেও। তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। কেউই কিছু করার আগে ঔচিত্য বিচার করতে চায় না। এটা ঠিক যে পুজোর গন্ধ লেগে যায় এই সময়টায়, কিন্তু তাই বলে অমাবস্যার মহালয়ায় কখনও শুভেচ্ছা জানানোর রীতি ছিল না। শাস্ত্রসম্মতও নয়।’’
মহালয়ার সঙ্গে মহাভারতের কাহিনিও জড়িয়ে রয়েছে। দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে অবস্থান কালে তাঁকে সোনা এবং বিভিন্ন রত্নদ্রব্য খাদ্য হিসাবে দেওয়া হয়। কর্ণ এর কারণ জানতে চাইলে তাঁকে বলা হয়, তিনি কোনও দিন পিতৃপুরুষের উদ্দেশে খাদ্যদ্রব্য এবং জল দান করেননি। তিনি কেবলমাত্র সোনা এবং রত্নই দান করেছেন। সেই কারণেই কর্ণকে স্বর্গলোকে সোনা বা রত্ন খাদ্য হিসাবে দান করা হচ্ছে। কর্ণ স্বীকার করেন, তিনি পিতৃপুরুষ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। সেই কারণে তিনি পিতৃপুরুষকে অন্ন এবং জল দান থেকে বিরত ছিলেন। কর্ণকে এক পক্ষকাল সময় দেওয়া হয় মর্ত্যলোকে গিয়ে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জল দান করে পিতৃপুরুষের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য। এই সময়কাল ছিল পিতৃপক্ষ, ১৬ দিন।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, স্বর্গ এবং মর্ত্যের মাঝে অবস্থান করে পিতৃলোক। এই লোকের শাসনকর্তা যম, যিনি মৃত ব্যক্তির আত্মাকেকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন পুরুষ পিতৃলোকে অবস্থান করেন। লোকবিশ্বাস, পিতৃপক্ষে পূর্বপুরুষের আত্মা তৃষ্ণা নিবারণের উদ্দেশে মর্ত্যলোকে আগমন করে। পিতৃপক্ষে পূর্বপুরুষের উদ্দেশে জল দান করলে পূর্বপুরুষের তৃষ্ণা নিবারণ হয়।
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পূর্বপুরুষের উদ্দেশে দান করা জলে তাঁদের তৃষ্ণা নিবারণ হয়। যাঁরা পূর্বপুরুষের বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে সক্ষম হন না, তাঁরা পিতৃপক্ষে পূর্বপুরুষকে জল দান করতে পারেন। পিতৃপক্ষ প্রেতকর্মের জন্য (শ্রাদ্ধ, তর্পণ, মৃত্যু সংক্রান্ত আচার বা কর্ম) প্রশস্ত, শুভ কর্মের জন্য নয়। অমাবস্যা তিথি প্রেতকর্মের পক্ষে সর্বোত্তম তিথি।
এই কারণে মহালয়ার দিন অর্থাৎ পিতৃপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে পূর্বপুরুষের উদ্দেশে জল দান বা তর্পণ প্রথা পালিত হয়। পিতৃপক্ষে পূর্বপুরুষের উদ্দেশে তর্পণে জল দানে পূর্বপুরুষের আশীর্বাদ মেলে বলে মনে করা হয়। সনাতন বিশ্বাসে সাংসারিক সুখ, সমৃদ্ধি এবং শান্তি প্রাপ্তি হয়।