গোপীনাথ চক্রবর্তী। নিজস্ব চিত্র।
অজয় নদের কাছেই পশ্চিম বর্ধমানের খনি এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম চিচুড়িয়া। স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা পেতে সেখানকার মানুষকে যেতে হয় আসানসোল বা রানিগঞ্জ। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রায় ৮০-৯০ জন আক্রান্ত হয়েছেন সেখানে। সেই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ৫ জনের মৃত্যু। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামবাসীদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থার চেষ্টা শুরু করেন চিচুড়িয়ার দিব্যেন্দু দাঁ। কিন্তু কী করলে ভাল, ভেবে পাচ্ছিলেন না।
এর মধ্যেই গ্রামের এক যুবকের মৃত্যু হয় শুধু অক্সিজেনের অভাবে। এই মৃত্যুতে বিচলিত হয়ে পড়ে গোটা গ্রাম। দিব্যেন্দুর পাড়াতেই থাকেন গোপীনাথ চক্রবর্তী। তিনিও কিছু দিন আগে হারিয়েছেন নিজের জেঠাকে। দু’জনে ঠিক করেন নিজেদের খরচেই গ্রামের মানুষের জন্য অক্সিজেন-যুক্ত শয্যার ব্যবস্থা করবেন। তাঁর পরিকল্পনার কথা শুনে আশার আলো দেখেন দিব্যেন্দু। তাঁর মনেও যে এক রকম চিন্তা ছিল। শুরু হয় চিচুড়িয়াবাসীর জন্য অক্সিজেন-যুক্ত শয্যা তৈরির কাজ।
চিচুড়িয়া গ্রামে রয়েছে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মূল ভবনের পিছনে একটি ঘর অনেক দিন ধরে পড়ে রয়েছে। ব্যবহার হয় না। সেই ঘরেই শয্যা এবং অক্সিজেনের ব্যবস্থা করবেন বলে ঠিক করেন গোপীনাথ এবং দিব্যেন্দু। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রধান এবং গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে নিজেদের ইচ্ছার কথা জানান তাঁরা। গ্রামের দুই যুবকের উদ্যোগে রাজি হয়ে যান তাঁরাও। কর্তৃপক্ষের থেকে সবুজ সঙ্কেত পেতেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওই ঘর পরিষ্কার শুরু হয়। নিজেদের টাকাতেই অক্সিজেন সিলিন্ডার, নেবুলাইজার, পাল্স অক্সিমিটার-সহ চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগাড় করতে শুরু করেন ওঁরা।
গোপীনাথ এবং দিব্যেন্দুর এই উদ্যোগের কথা অল্প সময়েই জানতে পারেন গ্রামবাসীরা। তাঁরাও নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ সাহায্য করেন দু’জনকে। ওই গ্রামেরই সঞ্জয়, সঞ্জিতের মতো যুবকেরা পাশে দাঁড়ান। গোপীনাথ বলেছেন, ‘‘আমি আর আমার দিব্যেন্দু নিজেদের টাকাতেই শুরু করি কাজ। পরে গ্রামবাসীরাও এগিয়ে আসেন। এখন সকলেই আমাদের সাহায্য করছেন।’’ দিন কয়েকের প্রচেষ্টায় চিচুড়িয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিত্যক্ত ঘরেই তৈরি হয় গোপীনাথ-দিব্যেন্দুর ‘কোভিড নিরাময় কেন্দ্র’। যেখানে গত সপ্তাহে দু’টি শয্যা এবং দু’টি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
চল্লিশোর্ধ্ব গোপীনাথের নিজের ব্যবসা রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে সংসারের নানা ভাবনা। সব সামলে কী ভাবে নতুন দায়িত্ব কাঁধে নিলেন তিনি? গোপীনাথ বলেছেন, ‘‘আমাদের পঞ্চায়েত এলাকায় অনেকে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এখান থেকে হাসপাতালে পৌঁছতেও সময় লাগে অনেকটা। খবরে দেখছি, হাসপাতালে গেলেও শয্যা পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামের কারও অসুবিধা হলে তাঁর পাশে যাতে দাঁড়াতে পারি, সে জন্যই এই কাজ।’’ একই কথা পেশায় অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের ব্যবসায়ী দিব্যেন্দুর গলায়ও। তিনি বলেছেন, ‘‘স্থানীয় যুবকের অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু আমাকে বিচলিত করেছিল। আর কোনও গ্রামবাসীকে যাতে এই পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়, সে জন্যই আমাদের এই প্রচেষ্টা।’’ এই কাজের জন্য গোপীনাথ যে ভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, সে কথাও বারবার উঠে এসেছে দিব্যেন্দুর গলায়।
এমন উদ্যোগ কোভিড আক্রান্তদের মনোবল বাড়াতেও সাহায্য করবে বলে মনে করেন গোপীনাথ। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার জেঠা কোভিডে মারা যাওয়ার পরে জেঠিমাও আক্রান্ত হন। তাঁর অক্সিজেনের দরকার পড়েনি। কিন্তু আমরা একটা সিলিন্ডার এনে রেখেছিলাম। ওটা দেখেই যেন জেঠিমা অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেলেন।’’
এই উদ্যোগ দেখে খুশি গ্রামবাসীরা। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান-সহ বাকিরাও পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। এ নিয়ে চিচুড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বিশ্বনাথ সাঙ্গুই বলেছেন, ‘‘এই পঞ্চায়েত এলাকায় প্রচুর মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। স্থানীয় যুবকদের এই উদ্যোগ গ্রামবাসীদের মনোবলও অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা ওঁদের পাশে আছি।’’ উদ্যোক্তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন জামুরিয়ার বিডিও জিশানু দে-ও।
গত সপ্তাহে খোলার পরে এখনও কোনও গ্রামবাসীকে নিতে হয়নি অক্সিজেনের সাহায্য। তবে ব্যবস্থা রয়েছে। কারও দরকার হলে কী ভাবে পরিষেবা দেবেন? তাও জানিয়েছেন গোপীনাথ। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের এই উদ্যোগের কথা শুনে এসেছিলেন পাশ্ববর্তী বাহাদুরপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক নার্স। তিনিই আমাদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ওই দিদি জানিয়েছেন, কোনও দরকার হলে তিনি এসে সব রকম সাহায্য করবেন।’’ পিপিই কিট, গ্লাভ্স ও পর্যাপ্ত পরিমাণ স্যানিটাইজার কিনেও রেখেছেন বলে জানিয়েছেন দিব্যেন্দু। সব মিলিয়ে করোনায় আক্রান্ত গ্রামবাসীদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য তৈরি রয়েছেন চিচুড়িয়ার গোপীনাথ এবং দিব্যেন্দু।