আরজি কর-কাণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত সঞ্জয় রায়। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
ফাঁসি হওয়াই কি উচিত ছিল? যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কি যথেষ্ট?
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার ৫ মাস ১০ দিন পরে অপরাধী সঞ্জয় রায়কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে শিয়ালদহের নিম্ন আদালত। তার পর থেকেই সমাজের বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে, ওই শাস্তি কি উচিত শাস্তি হল? কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বলেছেন, অপরাধের শাস্তি ফাঁসির চেয়ে কম না হলেই ভাল হত। মনোসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ অবশ্য বলছেন, ‘‘আর জি করে যা ঘটেছিল, ফাঁসি দিয়ে সেই অপরাধের প্রতিকার করা সম্ভব বলে আমি অন্তত মনে করি না। ফাঁসি এর আগেও হয়েছে। কিন্তু তাতে সমাজের ওই অসুখ সারেনি। তবে সঞ্জয়কে যে শাস্তিই দেওয়া হোক, সেই সিদ্ধান্তও বড্ড তড়িঘড়ি নেওয়া হল বলে আমার মনে হয়।’’
২০২৪ সালের ৯ অগস্ট রাতে আরজি করে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল। তার পর থেকেই এই ঘটনায় বিচার চেয়ে উত্তাল হয় শহর। ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ অপরাধী হিসাবে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয়কে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করেছিল ঠিকই, কিন্তু তার পরেও তৈরি হয়েছিল একাধিক প্রশ্ন। যে প্রশ্নের জবাব চেয়ে পথে নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ থেকে চিকিৎসক, সমাজকর্মী, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতো অনেকেই। বর্তমানে পূর্ব বর্ধমানের মেডিক্যাল কলেজের উপমুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুবর্ণ গোস্বামীও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। সঞ্জয়ের শাস্তি প্রসঙ্গে সোমবার সুবর্ণ বলছেন, ‘‘সঞ্জয় যদি সত্যিই অপরাধীদের এক জন হয়, তা হলেও আমি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডেরই পক্ষে। তার কারণ, শুধু এই নয় যে, সভ্য দেশে ফাঁসি দেওয়া উচিত নয়। বরং সঞ্জয় ছাড়াও ওই অপরাধে আরও যারা যুক্ত, তাদের চিহ্নিত করার জন্য।’’ আন্দোলনের সময়ে তিনি যা বলেছিলেন, সেই অবস্থান বজায় রেখেই সুবর্ণের ব্যাখ্যা, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্র সরকারের মধ্যে গোপন আঁতাঁতেই আরজি কর কাণ্ডের বাকি অপরাধীর নাম প্রকাশ্যে আসেনি। তাই সুবর্ণ বলছেন, ‘‘চিরকাল তো এই দুই সরকার আর তাদের সেটিং থাকবে না। যদি পরবর্তী কোনও সরকার এসে সত্য উদ্ঘাটন করতে চায়, তবে সঞ্জয় তাদের কাছে এক জন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসাবে থাকবে। কিন্তু সঞ্জয়কে ফাঁসি দিয়ে নিকেশ করলে সেটা সম্ভব নয়।’’
সুবর্ণের মতো অনেকের সেই সময়ে বক্তব্য ছিল, আরজি কর-কাণ্ডে আসল অপরাধীদের চিহ্নিতই করা যায়নি। তা নিয়ে সরকারকে আক্রমণও করেছিলেন কেউ কেউ। সেই তালিকায় রয়েছেন আরও এক চিকিৎসক কুণাল সরকার। তাঁদের মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে লালবাজারে ডেকেও পাঠানো হয় চিকিৎসক সুবর্ণ এবং কুণালকে। সঞ্জয়ের শাস্তি নিয়ে সেই চিকিৎসক কুণাল বলছেন, ‘‘শাস্তির থেকেও বড় কথা ছিল শহরের বুকে একটা মেডিক্যাল কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার তদন্ত কী ভাবে হল। সেই তদন্তের নানা দিক নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন ছিল। তদন্তকে প্রভাবিত করা হচ্ছে বলে মানুষের মনে ভয়ও তৈরি হয়েছিল। সঞ্জয়কে যে শাস্তিই দিক আদালত, আমার প্রশ্ন, সেই ভয় কি কাটল? সিবিআইয়ের যে রিপোর্ট দেখে মাস কয়েক আগেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বলেছিলেন, ‘আমার ৩০ বছরের অভিজ্ঞতায় এমন ঘটনা দেখিনি’, সেই ঘটনা যে শেষ পর্বে জল-ভাতের মতো হয়ে গেল, সেটা কি মানুষ বুঝল না? সঞ্জয়ের শাস্তি সেই ভয় কি আদৌ কাটাতে পারল? ফাঁসি হলেও কি পারত?’’
আর জি কর নিয়ে আন্দোলনে চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিভিন্ন মহলের মানুষ। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পীরা। সঞ্জয়ের শাস্তি নিয়ে তাঁরা কী বলছেন? অভিনেত্রী দেবলীনা দত্তকে প্রশ্ন করতে তিনি বললেন, ‘‘আমার কাছে কোনও গুরুত্ব নেই ,জানেন! সঞ্জয় শাস্তি পেল কি পেল না! ফাঁসি হল না যাবজ্জীবন, তাতে আমার কিচ্ছু এসে যায় না। সঞ্জয় তো ওই ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ধরা পড়েছিল। তা হলে তার পরেও মাসের পর মাস আন্দেলন চলল কী করে? আমরা যে বিষয়গুলি নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম, তার জবাব এখনও পাইনি। তবে সঞ্জয়ের শাস্তি প্রসঙ্গে যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, ফাঁসি ভাল না যাবজ্জীবন উচিত শাস্তি, তবে আমি বলব, যাবজ্জীবনই ঠিক শাস্তি। যাবজ্জীবন ফাঁসির থেকে অনেক কঠিন শাস্তি। আর তা ছাড়া কাউকে প্রাণ দেওয়ার যখন আমাদের ক্ষমতা নেই, তখন কারও প্রাণ নেওয়াও উচিত নয়।’’
কিছুটা একই মত লেখিকা সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি অবশ্য শাস্তিতে বিশ্বাসী নন। তিনি বলছেন, ‘‘আমি অপরাধীর শাস্তির চেয়ে অনেক বেশি তাঁর বোধোদয়ে বিশ্বাসী। কিন্তু যাঁরা ওই বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন, গবেষণা করেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে আমি জেনেছি, আমাদের দেশে সেই বোধোদয়ের জন্য যা যা করা জরুরি, তা সম্ভব নয়। কয়েক বছর আগেও আমি ফাঁসির বিরোধী ছিলাম। এখন পুরোপুরি বিরোধী, তা বলতে পারব না। তবে ফাঁসি উচিত শাস্তি না যাবজ্জীবন, সে কথা যদি জানতে চান, তবে আমি যাবজ্জীবনই বলব, কারণ আমার মতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলে কিছুটা হলেও বোধোদয়ের সময় বা সুযোগ থাকে।’’
ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি হওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার কমিশনের সদস্য অনন্যা চক্রবর্তীও। তিনি বলছেন, ‘‘ফাঁসি দেওয়ার পক্ষপাতী নই আমি। কারণ, ফাঁসি দিয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধে রাশ টানা যায় না। বরং শিশু অধিকার কমিশনে থেকে জেনেছি এবং দেখেছি, তাতে নির্যাতিতকে খুন করার প্রবণতা বাড়ে। মানবাধিকারকর্মী কবিতা কৃষ্ণণও কথাটা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ধর্ষণের আর খুন, দু’য়েরই শাস্তি যদি ফাঁসি হয়, তা হলে অপরাধী ধর্ষণ করার পরে খুনও করবে। কারণ দু’ক্ষেত্রেই শাস্তি এক, কিন্তু খুন করলে প্রমাণের অভাবে সে বেঁচে যেতেও পারে।’’
আরজি করে নির্যাতিতার বাবা-মা অপরাধীর ফাঁসি চেয়েছিলেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অপরাধীর ফাঁসি চেয়েছিলেন। সঞ্জয়ের পরিবারও চেয়েছিল, ফাঁসিই হোক। এমনকি, ফাঁসি দেওয়া হলে সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করবেন না বলেও জানিয়েছিলেন সঞ্জয়ের দিদি। সঞ্জয় অবশ্য চেয়েছিলেন, তাঁকে বিকল্প শাস্তি দেওয়া হোক। দেখা গেল, আরজি কর নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেছেন বা করেননি তাঁরাও কেউ মনে করেন না সঞ্জয়ের ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। বরং অনেকে এটাই মনে করেন যে, সঞ্জয়কে বাঁচিয়ে রেখে তাঁর সাহায্যে আরও কেউ অপরাধী থাকলে তাঁদের চিহ্নিত করা যেতে পারে। দেখা গেল আদালতও ফাঁসি দেয়নি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু তার পরেও কি সমাজের কোনও লাভ হবে? আর জি কর বা শহরের যে কোনও মেডিক্যাল কলেজে রাতের ডিউটি করতে গিয়ে নির্জন করিডরে কি এক বারও ভয় পাবেন না কোনও মহিলা চিকিৎসক?
(ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনায় যত ক্ষণ না অভিযুক্তকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করা হচ্ছে, তত ক্ষণ তাঁর নাম, পরিচয় প্রকাশে আইনি বাধা থাকে। আনন্দবাজার অনলাইন সেই নিয়ম মেনেই আরজি কর পর্বের প্রথম দিন থেকে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের নাম বা ছবি প্রকাশ করেনি। শনিবার আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করায় আমরা তাঁর নাম এবং ছবি প্রকাশ করা শুরু করছি।)