শাড়ি কিংবা সালোয়ার, সঙ্গে একটা বাহারি শাল নিয়ে নিলেই ভোল বদলে যায়। প্রতীকী ছবি।
নভেম্বরের শেষের দিকে শীতের দেখা পেতে যে ভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছিল রাজ্যবাসী, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সেই হাকডাক অনেকটাই স্থিমিত। তাপমাত্রার পারদ নামছে ধীরে ধীরে। সকালের ঠান্ডা শিরশিরানি হাওয়ায় কাঁপন ধরছে। আর এই শীতের আমেজ গায়ে মেখেই মরসুম জুড়ে নানা উৎসবের সমারোহ। শীতকাল মানেই বিয়ের মরসুম। এ ছাড়া বড় দিন, নতুন বছর তো আছেই। সেই সঙ্গে রয়েছে জমিয়ে সাজগোজ। শীতের সাজে বরাবরই জনপ্রিয়তা পেয়ে এসেছে শাল। শাড়ি কিংবা সালোয়ার, সঙ্গে একটা বাহারি শাল নিয়ে নিলেই ভোল বদলে যায়। শাল ব্যবহারে পিছিয়ে নেই পুরুষরাও। পাঞ্জাবির সঙ্গে ব্যোমকেশ বক্সীর মতো করে শাল গায়ে জড়াতেও দেখা যায় অনেককে। শীতের ফ্যাশানে শাল একটা বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু শাল মানে কি শুধু কাশ্মীরি শাল? এ প্রশ্ন উঠছে কারণ, শাল ব্যবহারে তেমন বৈচিত্র দেখা যায় না। কিন্তু শালেও রয়েছে নানা রকম বিকল্প। প্রত্যেকটির উষ্ণতার আঁচও ভিন্ন ভিন্ন। শীতের ফ্যাশানে সেগুলি আপনার সঙ্গী হতে পারে। রইল তেমন কিছু শালের খোঁজ।
পশমিনা শাল
কমবেশি অনেকের সংগ্রহেই পশমিনা শাল রয়েছে। এ ধরনের শাল রোজের ব্যবহারের নয়। একটু তোলা তোলা করে পরলেই ভাল। শীতকালীন বিশেষ কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে অনায়াসে ব্যবহার করতে পারেন। অন্যান্য শালের তুলনায় পশমিনার দাম একটু বেশি। দু’ভাবে তৈরি হয় পশমিনা। হাতের তাঁতের বুনেটে কাঠের সুচের ফোঁড় তুলে তৈরি হয় কানি পশমিনা। আর উনিশ শতক থেকে এমব্রয়ডারি করে বোনা হচ্ছে পশমিনার আরও একটি সংস্করণ— আমিলকর শাল। কাশ্মীরের ইতিহাসের পটপরিবর্তন ধরা পড়ে কানি পশমিনার জমিতে। পশমিনা শাল চেনা কিন্তু খুব সহজ নয়। ইদানীং, বাজারে নকল পশমিনারও রমরমা বেড়েছে। কেনার আগে দেখেশুনে কেনা প্রয়োজন। ধর্মতলায় নিউ মার্কেটে কয়েকটি কাশ্মীরি শালের পুরনো দোকান রয়েছে। আলমারিতে একটা পশমিনা রাখতে সেখানে যেতে পারেন। পশমিনার দাম শুরু হচ্ছে ৪০০০ টাকা থেকে। পশমিনার সেই আভিজাত্য ও স্টাইলের আশ্চর্য মেলবন্ধন এখনও অম্লান। কারিগরি সূক্ষ্মতার জন্য এখনও আকাশছোঁয়া তার দাম। তবুও যদি একটি রাখতে পারেন সংগ্রহে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঐতিহ্য হয়ে রয়ে যাবে আপনার রুচি।
নাগা শাল
বাহারি শালের তালিকায় আরও একটি নাম নাগা শাল। নাম দেখেই এই শালের উৎপত্তিস্থল কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। নাগাল্যান্ডেই তৈরি শাল ঠান্ডার আঁচ আসতে দেবে না গায়ে। এই শালটি জুড়ে থাকে কালো এবং নীল রঙের ছোঁয়া। এখন অবশ্য আরও কিছু রং ব্যবহার করা হয়। এই শালের নকশাগুলিতে নাগাল্যান্ডে প্রচলিত লোককাহিনি ফুটে উঠেছে। এ ছাড়াও বাঘ, হাতি, যুদ্ধের দৃশ্য, বল্লমের মোটিফও রয়েছে। সাধারণত নাগা পুরুষদের গায়ে শোভা পায় এই শালগুলি। আসল নাগা শাল হলে তার দাম শুরু হয় প্রায় দু’-আড়াই হাজার টাকা থেকে। কাশ্মীরিদের মতো নাগাল্যান্ড থেকে বেশ কিছু শাল ব্যবসায়ী প্রতি শীতে শহরে আসেন। ওয়েলিংটনের ভুটিয়া মার্কেটে তাঁদের পেয়ে যাবেন। নাগা শাল কিনতে হলে এক বার ভুটিয়া মার্কেটে গিয়ে ঢুঁ মেরে আসতে পারেন।
রাবাড়ি শাল
গুজরাতে তৈরি এই শাল এক কথায় যেন গোটা একটা ছবি। রং আর নকশার মেলবন্ধনে এই শাল সৌন্দর্যের ধাপ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে। রাবাড়ি শাল সাধারণত হাতে বোনা হয়। সিল্ক সুতো দিয়ে তৈরি এই শালজুড়ে এমব্রয়ডারির কাজ। এই শালে রঙের ব্যবহার অপূর্ব। জমকালো শাল পছন্দ করেন যাঁরা, অনায়াসে তাঁরা এই শালটি নিজের সংগ্রহে রাখতে পারেন। শীতপোশাকের সংগ্রহে একটা রাবাড়ি শাল রাখতেই পারেন। কলকাতায় অনেক গুজরাতি শাল ব্যবসায়ীদের কাছে এই ধরনের শাল পেয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া নিউ মার্কেট চত্বরে বেশ কিছু শালের দোকানে এক বার খোঁজ নিতে পারেন। ঢাকুরিয়ার দক্ষিণাপণও এক বার খুঁজে দেখতে পারেন। এই ধরনের গুজরাতি শালের দাম একটু বেশিই। খুব কম দামে এই শাল পাবেন না। অনলাইনেও পেয়ে যাবেন রাবাড়ি শাল। চাইলে খুঁজে দেখতে পারেন।
কুলু শাল
এই শাল কলকাতার ঠান্ডায় ব্যবহার করার নয়। হিমাচল প্রদেশে তৈরি এই শাল একেবারেই মসৃণ নয়। বরং বেশ খসখসে। খুব রংচঙে হয় এই ধরনের শাল। বিভিন্ন প্রজাতির ছাগলের পশম দিয়ে তৈরি হয় এই শাল। কুলু শালের কদর জগৎজোড়া। কুলু-মানালি বেড়াতে গেলে অনেকেই কম দামে এই শাল কিনে আনেন। তবে এখন সব কিছুই প্রায় এ শহরে পাওয়া যায়। সব শালের দোকানে পাওয়া যাবে না। ধর্মতলা চত্বরে বেশ কিছু পুরনো শালের দোকান রয়েছে। সেগুলিতে এক বার খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। এগুলির দাম প্রায় শুরু হয় হাজার-বারোশো টাকা থেকে। সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকা দামেরও শাল পেয়ে যাবেন।
শাহতুশ
লাদাখের সুউচ্চ পাহাড়ের ঢালে কনকনে ঠান্ডার দেশে শিং তোলা বুনো ছাগল ঘুরে বেড়ায়। সেই ছাগলের রোঁয়া দিয়েই তৈরি হয় এই শাহতুশ শাল। পশমের রাজা বলা হয় এই রোঁয়াগুলিকে। এই চাদরে তেমন কোনও কারুকাজের হিড়িক নেই। কিন্তু উলের মহিমায় তা মহার্ঘতম। মসলিনের মতো শাহতুশকে ঘিরেও আংটির ভিতর দিয়ে শাল গলে যাওয়ার লোকগাথা জারি রয়েছে। বাতাসের মতো ফিনফিনে আর আদরের আশ্লেষের মতো উষ্ণ সে শাল এখন অনেকেই আর দোকানে রাখতে চান না। কারণ তেমন শাল কেনার শৌখিনতা অনেকটাই কমে এসেছে। তার উপর দামও আকাশছোঁয়া। সাধ্যের বাইরে গিয়ে এমন শৌখিন জিনিস কেনার লোক এখন হাতেগোনা। তেমনটাই মনে করছেন বাইরে থেকে এসে কলকাতায় বসতি স্থাপন করা শাল ব্যবসায়ীরা। আর শাহতুশ তৈরিও হয় খুব কম। কারণ, যে ছাগলের রোঁয়া দিয়ে এটি তৈরি হয়, সেই প্রজাতির ছাগল এখন বিরল বলা চলে।