Shantiniketan

শান্তিনিকেতনের সাস-বহু, টেলিভিশন নয়, বাস্তবের গল্প, জিতল কে?

একতা কপূর এ লড়াই কী ভাবে শেষ করতেন বলা যায় না, তবে বাস্তবের সাস-বহুর লড়াইয়ে জিতে গিয়েছেন শাশুড়ি। পুতুলের মন্ত্রশক্তির জোরে ভিড়ের স্রোত তার হেঁশেলের দিকেই বাড়তে থেকেছে।

Advertisement
সুচন্দ্রা ঘটক
বোলপুর শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৪ ১৩:৫৭
Banalakshmi and Barishaler Rannaghor, the story of a mother-in-law and her daughter-in-law

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনেক দিনের এক ঘটনা আপনাদের জানাতে চাই।

Advertisement

আছেন মা। রয়েছেন বৌমা।

এটা কিন্তু একতা কপূরের সিরিয়ালের সেট নয়। ঘটনাস্থল বোলপুর।

কেন্দ্রে বনলক্ষ্মী। বাঙালি খাবারের রেস্তরাঁ হিসাবে নাম ছড়িয়েছে বহু দিন হল। শাক-চচ্চড়ি-চাপরঘণ্ট, যা এককালে ঘরে ঘরে হত এবং এখন অধিকাংশ বাড়ির খাওয়ার টেবিল থেকে প্রায় লুপ্ত, সবই সযত্নে খাওয়ানো হয় এখানে।

বনলক্ষ্মী আজকের নয়। নিরঞ্জন সান্যাল নামে এক বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ শুরু করেন গ্রামোন্নয়নের কাজ। ইলামবাজারের এই এলাকা তখন জঙ্গল। গাছ পুঁতে, গোয়াল করে নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গে কাজে লেগে পড়েন আরও পাঁচ মহিলা। গাছের আম, জাম, পেয়ারা, কমলালেবু এক সময়ে এত হতে শুরু করল যে, তাঁরা তা দিয়ে জেলি, আচার বানানো শুরু করলেন। গোয়ালের গরুর দুধ দিয়ে নিজেদের হেঁশেলেই তৈরি করতে শুরু করেন ঘি।

পঞ্চপাণ্ডবীর এক জন হলেন কানন পাল। নিজে শুধু নন, ভাইকেও এখানে নিয়ে আসেন। শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করবেন। চাকরি করবেন। এই সব ভেবে। কিন্তু মৃণালকান্তি পালও ধীরে ধীরে জুড়ে যান বনলক্ষ্মীর কাজের সঙ্গে। এর মধ্যে বনলক্ষ্মী বড় হয়। লোকজনের যাতায়াত বাড়ে। সকলের জন্য একটু ডাল-ভাত রান্নাও শুরু হয়। কানন বলেন, ‘‘মূলত যাঁরা বনলক্ষ্মীতে আমাদের কাজ দেখতে আসতেন, তাঁরা যেন অভুক্ত না ফিরে যান, সে কারণেই এখানে রান্না শুরু হয়।’’ তার পর দেখা যায়, শুধু সেই রান্না খাওয়ার জন্য লোকের ভিড় বাড়ছে।

Banalakshmi and Barishaler Rannaghor, the story of a mother-in-law and her daughter-in-law

বনলক্ষ্মীর ভাই-বোন। কানন পাল ও মৃণালকান্তি পাল। —নিজস্ব চিত্র।

ইতিমধ্যে মৃণালকান্তি বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর নাম পুতুল পাল। তিনি শুধু চুল বাঁধেন না, রান্নাও করেন। তাঁর হাতের রান্না খেয়ে তৃপ্ত শুধু সহকর্মীরা নন, বাইরে থেকে আসা অনেকেই। স্বাভাবিক ভাবে ধীরে ধীরে হেঁশেলের ভার গেল পুতুলের হাতে। তাঁর তৈরি কষা মাংস যেমন পছন্দ সকলের, তেমনই পছন্দের কচুবাটা-চাপড়ঘণ্ট। সাধারণ বাঙালির হেঁশেলে নিরামিষ রান্নার চল কমতে থাকলেও পুতুলের হেঁশেলের শুক্তো-চচ্চড়ির চাহিদা বাড়ে। এক সময়ে বনলক্ষ্মীর রেস্তরাঁর নাম আলাদা ভাবেই ছড়ায়। কলকাতা থেকে এক সপ্তাহ আগে ফোন যায়, বুকিংয়ের ব্যবস্থা শুরু হয়।

কিন্তু কেন? পাঁচটি কারণ আছে।

প্রথমত, বাঙালিদের মধ্যে বাড়ির বাইরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করার চল কিন্তু আগে বিশেষ ছিল না। পঞ্জাবিদের যেমন বাড়িতে যত ভালই রান্না হোক, বাইরে ধাবাগুলিতে যাওয়াও প্রচলিত ছিল। বাঙালিদের সে সবের পাট ছিল না। বহু বাঙালিই মনে করে, বাড়িতে যেটা রান্না হচ্ছে, সেটা আবার খরচ করে রেস্তরাঁয় গিয়ে খাব কেন! তা ছাড়া, বাঙালিরা স্বভাবত বাইরে খাওয়া মানে চড়ুইভাতি বুঝত। একা একা গিয়ে বাইরে খেত না। আরও পাঁচ জনকে নিয়ে বাইরে খেতে গেলে তার জন্য উপযুক্ত আবহ দরকার। বহু ক্ষেত্রেই কলকাতার কোনও বাঙালি রেস্তরাঁয় তেমন পরিবেশ পাওয়া যায় না। ফলে সে ভাবে যেতেও চায় না। যাওয়ার মধ্যে পছন্দ হয় বড় হোটেল, নয়তো পার্ক স্ট্রিট চত্বরের সাহেবি কোনও রেস্তরাঁ। সকলে মিলে বাইরে গিয়ে বাঙালি খাবার খাওয়ার চল প্রায় ছিল না।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন ঘটেছে।

যৌথ পরিবার সবই প্রায় ভেঙে গিয়েছে। ছোট ছোট পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে কাজ করেন। এখন দু’জনে মিলে সংসার সামলে আর সব সময়ে ঘরে রান্না করার সুযোগ হয় না। ফলে মাঝেমধ্যে বাইরের খাবার খাওয়া প্রয়োজনও হয়। সব মিলে বাড়ির বাইরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করার চল বেড়েছে। এটি হল দ্বিতীয় কারণ।

তৃতীয়ত, নগরসভ্যতা যেমন ছড়িয়েছে, তেমন বেড়েছে শহরের বাইরে গিয়ে অবকাশ-যাপনের চল। এককালে যেমন হোটেলে গিয়ে উঠলেই থাকা-খাওয়া সব সেখানেই ছিল। এখন তা নেই। এখন হোটেলে থাকলেও আলাদা করে খাবার কিনতে হয়। আলাদা করে যখন টাকা খরচ করতেই হবে, তখন আর একই হোটেলের খাবার কেন বার বার খাবেন? অনেকেরই তাই বেড়াতে গিয়ে যে হোটেলে থাকেন, রাত-দিন সেখানে আর খেতে ইচ্ছা করে না। নিত্যনতুন রেস্তরাঁয় গিয়ে নানা ধরনের খাবার চেখে দেখার চল হয়েছে। রেস্তরাঁর সংখ্যাও বেড়েছে।

Banalakshmi and Barishaler Rannaghor, the story of a mother-in-law and her daughter-in-law

বনলক্ষ্মী এক অর্থে শিখিয়েছে বাঙালি খাবার বাইরে গিয়েও খাওয়া যায়। —নিজস্ব চিত্র।

গ্রামে ছুটি কাটানোর প্রচলনও দিন দিন বাড়ছে। পর্যটন ব্যবসা যত বাড়ছে, ততই গ্রামে গ্রামে হোটেল-অতিথিশালা তৈরি হচ্ছে। আর বিলিতি ছবি দেখে, বই পড়ে শহুরে সব কিছু থেকে দূরে গিয়ে, মাটির কাছাকাছি সময় কাটানোর রোম্যান্টিকতা এখন অনেকের পছন্দের। বেড়াতে গিয়ে তাই দু-এক দিন গ্রাম্য পরিবেশে খাওয়াদাওয়া করার প্রতিও টান তৈরি হয়েছে। বনলক্ষ্মীতে গেলে সেই আটপৌরে আতিথেয়তা পাওয়াও যায়। জায়গাটি জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে এটিই হল চতুর্থ কারণ।

আর বনলক্ষ্মীর নাম ছড়ানোর পঞ্চম একটি কারণও আছে। ‘‘কোনও গ্রামের কোণের সাধারণ দোকান তো নয়। এর পিছনে ভাবনা আছে। রান্নার মান যথেষ্ট উন্নত,’’ বলেন বোলপুরের বাসিন্দা, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অহনা বিশ্বাস। ‘‘সেখানকার ভাত-পোস্ত-মাছের ঝোলের মান সাধারণ বহু বাড়ির চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ভাল,’’ স্বীকার করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। বাঙালি জিভ গলির খেলোয়াড় আর টেস্ট ক্রিকেটারের খেলার মানের ফারাক দিব্যি বুঝে নেয়। তাই তো কয়েক বছরেই বনলক্ষ্মী রেস্তরাঁর স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি হয়।

সব গল্পেরই মোড় থাকে। সব শহরে একতা কপূরও থাকেন।

বনলক্ষ্মীর পুতুলকে এখন আর সারা দিনে দেখতে পাওয়া যায় না সে চত্বরে। হেঁশেলে তো নয়ই। এমনকি, তাঁর নামে চিঠি এলেও পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাস্তার অন্য প্রান্তে। জনশ্রুতি হল, শাশুড়ি হওয়ার পর থেকে পুতুলের হেঁশেলে চিড় ধরেছে। পুতুল ও মৃণালকান্তির একমাত্র পুত্র মৃদঙ্গ পালের হাতে বনলক্ষ্মী দেখভালের দায়িত্ব যাওয়ার পরে জল অন্য দিকে গড়াচ্ছে।

এখন সবটা বুঝে নিয়েছেন মৃদঙ্গের স্ত্রী দিয়া পাল বিশ্বাস। বনলক্ষ্মীর এ প্রজন্মের মুখ। যে কোনও ব্যস্ত দিনে সেখানে গেলে দোকানের ক্যাশবাক্সের সামনে দেখা মেলে দিয়ার। দোকান থেকে রেস্তরাঁ, সব দেখাশোনা করেন তিনিই। আর বলেন, ‘‘বনলক্ষ্মীতে এলে কেউ না খেয়ে যান না। সকলে জানেন, আমাদের এটাই রেওয়াজ।’’ কিন্তু সেই খাবার রাঁধেন কে? পুতুল যে আর নেই এখানে!

Banalakshmi and Barishaler Rannaghor, the story of a mother-in-law and her daughter-in-law

দিয়া পাল বিশ্বাস। বনলক্ষ্মীর এ প্রজন্মের মুখ। —নিজস্ব চিত্র।

দিয়া কাজকর্ম বুঝেশুনে নিতে পারবেন বলেই কিন্তু বিয়েটা হয়েছিল। যে মেয়ের কাজে মন আছে, সকলকে নিয়ে চলতে পারবেন, এমন কাউকেই ভাইপোর জন্য চেয়েছিলেন পিসিমা। বাবা-মাও চেয়েছিলেন বনলক্ষ্মীর সঙ্গে যেন মানিয়ে নিতে পারেন তাঁদের একমাত্র বৌমা। দিয়ার বাবা-মায়ের তখন খুব বন্ধুত্ব ছিল বনলক্ষ্মীর কানন, সুমিত্রাদের সঙ্গে। প্রায় দিনই তাঁরা আসতেন। বিয়ের কথা তাঁরাই পেড়েছিলেন। দিয়াকে সকলেরই পছন্দ ছিল। নিরঞ্জনবাবু যে অতি উৎসাহী ছিলেন, তা ঠিক বলা যায় না। এখন অনেকে বলেন, নিরঞ্জনবাবু বিচক্ষণ ছিলেন।

দিয়া বনলক্ষ্মীর মহিলাদের পিসি-পিসি বলে ডাকতেন। রান্নাঘরে গিয়ে গ্রামের মেয়েদের হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করতেন। বাড়ির সকলকে সাজিয়েগুছিয়ে খেতে দিতেন। তত দিনে বাকিদের বয়স হচ্ছে। দিয়ার প্রাণবন্ত উপস্থিতি ভালই লাগত। কিন্তু ছন্দপতন ঘটতে শুরু করল বিয়ের পর থেকে। আধুনিক মেয়ে দিয়া নিজের মতো করে বুঝে নিচ্ছিলেন সবটা। এক দিন মৃদঙ্গ এসে আলমারির চাবি চাইলেন বড়দের কাছে। বনলক্ষ্মীর কাগজপত্র দেখেবুঝে নিতে চান। নিয়েও যান কিছু কাগজ। বড়রা ভাল ভাবে দেখেননি সে সব। অন্দরের এক জন বলেন, ‘‘সে সব কাগজ যে তার পর কোথায় গেল, কে জানে!’’

দূরত্ব বাড়তে থাকে। দিয়া আসার পর বনলক্ষ্মী আরও বড় হয়েছে। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা থাকে স্বামী-স্ত্রীর। বিশ্ব বাংলার বিপণিতে বনলক্ষ্মীর ঘি রাখা শুরু হয়। পর্যটকদের জন্য কয়েকটি থাকার জায়গার ব্যবস্থা হয়। ‘নিজের’ বাগানের আম-পেয়ারার ছবি সমাজমাধ্যমে দিয়ে সকলকে আমন্ত্রণ জানাতে থাকেন বনলক্ষ্মীতে আসার জন্য। বলেন, ‘‘এখনও নিজে হাতে রান্না করি। ঘি বানাই।’’ গুগলে বনলক্ষ্মীর খোঁজ করলে দিয়ার ফোন নম্বর পাওয়া যায়। রেস্তরাঁয় কেউ বুকিংয়ের জন্য ফোন করলে তাঁর সঙ্গেই কথা হয়। কবে কে আসবেন, কী রান্না হবে, ঠিক করতে থাকেন বৌমা। বনলক্ষ্মী হয়ে ওঠে দিয়াময়। পুতুলের কপালের ভাঁজ বাড়তে থাকে। নিজের মতো কিছুই হচ্ছিল না আর।

পুতুলের রান্নার জয়জয়কারের গুণেই তো বনলক্ষ্মীর নাম ছড়িয়েছিল। সেখানে এত লোকের যাতায়াত তো আগে ছিল না। তাঁর অবশ্য হাতে আলাদা করে বিশেষ কিছু যেত না। সোসাইটির যেমন নিয়ম আর কি। সকলের সমান ভাগ। তার উপরে এত ঝঞ্ঝাট। ঠিক করে ফেলেন, হাঁড়ি ভাগ হবে। যেমন ভাবনা। তেমন কাজ। বছর দশেক আগে এক দিন বনলক্ষ্মীরই রান্নাঘরে কয়েক জন মহিলার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। তাঁরাও যেতে চান পুতুলের সঙ্গে। খুব যে রাখঢাক করেছিলেন, তেমন নয়। এর পরেই ১৮ জন মহিলাকর্মীকে নিয়ে বেরিয়ে যান তিনি।

Banalakshmi and Barishaler Rannaghor, the story of a mother-in-law and her daughter-in-law

নিজের তৈরি বরিশালের রান্নাঘরে পুতুল পাল। —নিজস্ব চিত্র।

নতুন হেঁশেল চালু করেছেন। বনলক্ষ্মীর কাছেই। রাস্তার এ পার আর ও পার। পুতুলের হাতে তৈরি মোচা-ছেচকি-ছানার পায়েস খেতে হলে যেতে হয় এখন সেখানেই। নাম বরিশালের রান্নাঘর। রান্না মোটের উপর বরিশাল ঘরানার। পুতুলের শ্বশুরবাড়ির সকলেই তো আসলে বরিশালের লোকজন। সেখানকার রান্নার ধরন রপ্ত করেছেন ভালই। নতুন করে তাঁর রান্নার নাম ছড়িয়েছে যথেষ্ট।

ঘটনাটি খানিকটা যেন মিমি চক্রবর্তী আর সোহম চক্রবর্তীর ‘বাঙালি বাবু দেশি মেম’ ছবির গল্পের মতো। ঝগড়া করে যেমন কানাডার রাস্তার দু’পারে স্বামী আর স্ত্রী দু’টি ভাতের হোটেল খুলেছিলেন, যার একটিতে কাজ নিয়েছিলেন নায়িকা মিমি আর অন্যটিতে ছিলেন নায়ক সোহম। এ কাহিনি তেমনই। আবার তেমন নয়ও। সেই গল্পে শেষে মিল হয়েছিল স্বামী-স্ত্রীর। তবে এখানকার শাশুড়ি-বৌমার মধ্যে মিলমিশের ইঙ্গিত এখনও মেলেনি। পুতুলের বরিশালের রান্নাঘরের নাম যত ছড়াচ্ছে, সম্পর্কে নিমপাতার ফোড়নও যেন ততই বাড়ছে। বনলক্ষ্মীর চৌকাঠে পা রাখলেই টের পাওয়া যায় সে তিক্ততা।

রাস্তার ও পারে পুতুলের মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি। সেখানে শুরু হয় বরিশালের রান্নাঘর। তার পর থেকে মা-বৌমার মুখ দেখাদেখি এক প্রকার বন্ধ। বৌমা নামই নেন না শাশুড়ির। কেউ জিজ্ঞাসা করলে সোজা বলে দেন, ‘‘বরিশালের রান্নাঘরের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।’’

পুতুল আর মৃণালকান্তির সংসার বনলক্ষ্মীর চত্বরেই আছে। তবে সন্ধ্যার আগে বাড়িতে পা রাখেন না পুতুল। ভোরে উঠেই বেরিয়ে যান। সারা দিন থাকেন বরিশালের রান্নাঘরে। বনলক্ষ্মী বন্ধ করে বৌমা চলে যান উপরের সাজানো সংসারে। তার পরে তিনি বাড়ি ফেরেন। বনলক্ষ্মীতে বরাবরের নিয়ম ছিল সেখানকার সকলের রান্না একসঙ্গে হবে। এক হেঁশেলে। কানন-মৃণালকান্তি-পুতুল এখনও বাকিদের সঙ্গে সে হেঁশেলের রান্না খান। দিয়া আর মৃদঙ্গের হেঁশেল আলাদা। তবে সে সবে দমে যাননি পুতুল। এ সব তিক্ততার মাঝেই অন্যত্র বাড়ছে তাঁর হেঁশেল। ঘরে ফিরলে যে টাকার লোভের খোঁটা শুনতে হয় না, তা নয়। অনেকেই বলেন, পুতুলের টাকার লোভ। তাতেই সংসারে অশান্তি বাড়ছে। পিছনে তো বলেনই। তবে সাফল্যের তৃপ্তিও দেখা যায় সত্তর পার পুতুলের চোখের চামড়ার ভাঁজে।

মঙ্গলবার সাধারণত বন্ধ থাকে বরিশালের রান্নাঘর। তবু মাঝেমাঝে ঝাঁপ খুলতে হয়। শহরের পর্যটকদের বায়না সামলাতে খুন্তি ধরতে হয় খোদ কর্ত্রী পুতুলকে। কয়েক বছরে পরিচিতি এমনই বেড়েছে যে, তারকা এবং পর্যটকদের ভিড় সামলাতে বেশ নাকানিচোবানি খেতে হয় কর্মীদের। নায়ক থেকে লেখক, বিচারপতি থেকে উদ্যোগপতি— ওই এক চিলতে ঘরে শালপাতায় ভাত-ডাল-কচুবাটা-চচ্চড়ি খাওয়ার জন্যই অনেক সময়ে কলকাতা থেকে বোলপুরে পাড়ি দেন।

একতা কপূর এ লড়াই কী ভাবে শেষ করতেন বলা যায় না, তবে বাস্তবের সাস-বহুর লড়াইয়ে জিতে গিয়েছেন শাশুড়ি। পুতুলের মন্ত্রশক্তির জোরে ভিড়ের স্রোত তার হেঁশেলের দিকে বাড়তে থেকেছে। বরিশালের রান্নাঘর যেন হয়ে উঠেছে আর এক বনলক্ষ্মী। ১০ বছরে এত প্রাপ্তির কথা নির্লিপ্ত চিত্তেই বলেন পুতুল। শুধু ছেলের প্রসঙ্গ এলে কথার তোড়ে ভাটা পড়ে। মায়ের ঝলমলে চোখের একটি কোণ যেন চিকচিক করে ওঠে। পুতুল বলেন, ‘‘আমার ছেলের অভিমান হয়েছে। বলে, তুমি আবার আলাদা করতে গেলে কেন!’’

বুঝতে অসুবিধা হয় না, অভিমানের কেন্দ্রে এখন বনলক্ষ্মী নয়। বরং দিন দিন ভিড় টানতে থাকা বরিশালের রান্নাঘরই। সেটিই যেন হয়ে উঠেছে এ কালের বনলক্ষ্মী। অনেকেই এখন বলে থাকেন, সে কালের মতো রান্না এখন আর বনলক্ষ্মীতে হয় না। এখন বরিশালের রান্নাঘরের খাবারই খাঁটি বলে মনে করেন।

Banalakshmi and Barishaler Rannaghor, the story of a mother-in-law and her daughter-in-law

নায়ক থেকে লেখক, বিচারপতি থেকে উদ্যোগপতি— বরিশালের রান্নাঘরে শালপাতায় ভাত-ডাল-কচুবাটা-চচ্চড়ি খাওয়ার জন্যই অনেক সময়ে কলকাতা থেকে বোলপুরে পাড়ি দেন। —নিজস্ব চিত্র।

মাঝে পড়ে আছেন বরিশালের রান্নাঘরের কর্ত্রী, পুতুলের স্বামী এবং বনলক্ষ্মীর কর্তা মৃদঙ্গের পিতা, মৃণালকান্তি। তিনি যে একই ব্যক্তি। দিনভর বনলক্ষ্মীতেই থাকেন। বরিশালের রান্নাঘর নিয়ে বিশেষ মুখ খোলেন না। বনলক্ষ্মীর কাজকর্মের কথা উঠলে চোখ চকচক করে ওঠে। বলেন, ‘‘আমার ছেলেই তো দেখাশোনা করে!’’ কিন্তু স্ত্রীর হাতের রান্নাই সবচেয়ে ভাল খান তিনি। আজও। হাঁড়ি ভাগাভাগি হয়েছে বটে। তবে সংসার তো তাঁর একটাই। সন্ধ্যার পর স্ত্রী কাজ সেরে ঘরে ফিরলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন, দিদি কাননকে নিয়ে বসে গল্পগুজব করেন। বৌমার কথা উঠলেই অবশ্য ছন্দপতন ঘটে। বলেন, ‘‘আমাকে একটু ভিতরে যেতে হবে।’’ মৃদঙ্গকে যখন-তখন দেখা যায় না বনলক্ষ্মীতে। কেউ গেলে বনলক্ষ্মীর ‘বৌদি’ই আতিথেয়তা করেন। বাড়ির বড়দের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও দিয়া বলেন, ‘‘এখন তো আর আগের বিশেষ কেউ নেই!’’

আদি বনাম আধুনিকের এ বিতণ্ডা এখনই থামার নয়। তবে আদি যেমন নানা রূপে নিজেকে ফিরিয়ে আনে, তেমনই আধুনিক নিজের মতো করে বিস্তার ঘটায়। বনলক্ষ্মী যে সময়ের, তখন হয়তো এত হইচই ছিল না দেশজ খাবার, ভেষজ পণ্য নিয়ে। কিন্তু সমাজে বিপ্লবের যে পদধ্বনি শুনিয়েছিল বনলক্ষ্মী, তাতে কান পাততে এখন আর শান্তিনিকেতন পাড়ি না দিলেও চলে। বোলপুরের সেই বিপ্লবের প্রভাব কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। এখন খাঁটি বাঙালি রান্না খেতে কলকাতার রেস্তরাঁতেও কয়েক সপ্তাহের লাইন থাকে। বনলক্ষ্মী এক অর্থে শিখিয়েছে বাঙালি খাবার বাইরে গিয়েও খাওয়া যায়। তাতে কলকাতার শহুরেদের রুচি নির্মিত হয়েছে নতুন ভাবে। তেমন ধারার, আধুনিক মোড়কের রেস্তরাঁ তৈরি হচ্ছে শহরে। আশপাশের গ্রামের মহিলাদের নিয়ে আসা হয় শহুরে বাঙালিকে রেস্তরাঁয় বসিয়ে মাটির কাছাকাছি স্বাদের রান্না খাওয়ানোর জন্য। দক্ষিণ কলকাতার ‘আমার খামার’ তৈরি হওয়ার পর থেকে সেখানে ভিড় জমছে গ্রামে তৈরি জিনিসপত্র কেনাকাটা ও গ্রামের ধাঁচের রান্না খাওয়ার জন্য। ‘সিয়েনা’য় আবার ঘরোয়া জিনিস দিয়ে রকমারি রান্না হয়। স্থানীয় শাকসব্জি খাওয়ানোর চল হয়েছে। বাঙালির ঘরের জিনিস যে রেস্তরাঁর সম্ভ্রমের দাবি রাখে, তা বোঝে এই সময়। ‘‘সময়টাই এখন নিজেদের সংস্কৃতির দিকে ফিরে তাকানোর। কলকাতায় বসে ঘরোয়া ঘি, আচার, কাসুন্দি খাওয়ার চাহিদা এখন,’’ বক্তব্য সিয়েনার শেফ আরুণি মুখোপাধ্যায়ের। শহরে তাই সে ধরনের রুচিকে সম্মান জানানোর মতো রেস্তরাঁও হচ্ছে বলে মনে করেন আরুণি।

Banalakshmi and Barishaler Rannaghor, the story of a mother-in-law and her daughter-in-law

পুতুলের পরিশ্রমে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে বরিশালের রান্নাঘর। —নিজস্ব চিত্র।

একটি অ্যামিবা ভাগ হয়ে গিয়ে যেমন অনেকগুলি অ্যামিবা তৈরি করে, বনলক্ষ্মীর বিপ্লব খানিকটা তেমন। বোলপুরের এক হেঁশেলে চিড় ধরায় প্রথমে দুই হেঁশেল তো হলই। তার পর ধীরে ধীরে সে ধারণার ‘বাইনারি ফিশন’ হয়ে প্রথম দিকে বোলপুরে একের পর এক রেস্তরাঁ হল। তার পর সে ভাবনা নানা প্রকারে ছড়িয়ে পড়ে প্রভাব ফেলল কলকাতা শহরেও। একের পর এক রেস্তরাঁ নিজের নিজের মতো করে বনলক্ষ্মীর ভাবনার ঐতিহ্যকে তুলে ধরছে।

আরও পড়ুন
Advertisement