গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কর্মক্ষেত্রেও সুরক্ষিত নয় নারী। গত এক মাসে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই দ্রোহে-বিদ্রোহে উত্তাল হয়েছে গোটা রাজ্য। দফায় দফায় চলছে আন্দোলন। সেই আবহে টলিপাড়ার এক পরিচালকের বিরুদ্ধে উঠল যৌন হয়রানির অভিযোগ। আর সেই অভিযোগের ভিত্তিতে পরিচালক অরিন্দম শীলকে সাসপেন্ড (নিলম্বিত) করেছে ডিরেক্টর্স গিল্ড। উল্লেখ্য, আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে এবং নারীর সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার মিছিলে হাঁটতে দেখা গিয়েছে অরিন্দমকে। আরজি কর-কাণ্ডের নির্মমতা এবং নৃশংসতা তুলনাহীন। তবে মাসখানেকের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া দু’টি ঘটনা একটি প্রশ্নেরই জন্ম দেয়— অন্তত কর্মক্ষেত্রে কেন নারীর সম্মান বজায় থাকবে না? প্রতি পদে কেন তাঁকে শারীরিক অথবা মৌখিক হেনস্থার শিকার হতে হবে?
বিনোদনের রুপোলি দুনিয়া নিয়ে চর্চা সবচেয়ে বেশি হয়। ভাল দিকগুলি যতটা প্রকাশ্যে আসে, অন্ধকার দিকগুলি ঠিক ততটাই বারুদের মতো জ্বলে ওঠে। যৌন হেনস্থার ঘটনাও নতুন নয়। শুধু টলিউড নয়, অন্যান্য ভাষার ইন্ডাস্ট্রির অন্দরেও এক ধরনের নারীবিদ্বেষী ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। এর কি কোনও শেষ নেই? অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র বলেন, ‘‘এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। নিজে বহু দিন ধরে টলিউডে কাজ করছি। চার বছর আগে ইন্ডাস্ট্রির অন্ধকার দিকগুলি নিয়ে কথা বলেছিলাম। তখন উল্টে আমার দিকেই আঙুল উঠেছিল। কুপ্রস্তাব আমার কাছেও এসেছে। আমার তখন অল্প বয়স। এক জন প্রযোজক বলেছিলেন, তোমায় কাজ দেব না। তুমি তো আমার সঙ্গে সময় কাটাতে চাও না। তার পর যে আমি কাজ পাইনি, তা নয়। তবে বাকিদের চেয়ে তুলনায় কম পেয়েছি। ইন্ডাস্ট্রিতে এমন ঘটনার ইতিহাস বহু পুরনো। সব প্রকাশ্যে আসে না। তার মানে এই নয় যে, ভাল মানুষ নেই। তবে সংখ্যায় কম।’’
ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের অভিজ্ঞতা এবং বয়সের নিরিখে শ্রীলেখার অনুজ টেলি-অভিনেত্রী অঙ্গনা রায়। কোনও পরিচালক কাজ নিয়ে আলোচনা করতে বাড়িতে ডাকলেই নানা ভয়-ভাবনা মনে জাঁকিয়ে বসে অঙ্গনার। অস্বস্তির কারণেই আর যাওয়া হয় না। হাতছাড়া হয় কাজ। অঙ্গনা বলেন, ‘‘মধ্যরাতে পরিচালকের মেসেজের উত্তর না দেওয়া কিংবা রাতের পার্টিতে থেকে না যাওয়ার কারণেই অনেক কাজই করা হয়ে ওঠে না। আমি না হয় এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু সবাই তো পারেন না। আমার মনে হয়, অভিযোগ জানানোর যদি নির্দিষ্ট কোনও জায়গা থাকে, তা হলে খুব ভাল হয়। অন্তত আসল ঘটনা যাতে আড়ালে না চলে যায়, সে দিকে জোর দেওয়া জরুরি। না হলে এই ধরনের ঘটনা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে।’’
সিনে দুনিয়া ছাড়াও অন্যান্য পেশাগত ক্ষেত্রে, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যৌন হেনস্থার একটা পূর্ব ইতিহাস আছে। নারীর উপর হেনস্থা, নির্যাতনের ভিত্তি অনেকটাই ক্ষমতার বিন্যাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটাও অজানা নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল পক্ষকেই হার মেনে নিতে হয়। তার উদাহরণও রয়েছে চারপাশে। তেমনই এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার পদস্থ কর্মী সুতপা দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘আমি তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি। এক রাতে আমারই ঊর্ধ্বতন এক কর্মী আমাকে শারীরিক ভাবে হেনস্থার চেষ্টা করেছিল। তবে বেশি দূর এগোতে পারেনি। রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। অভিযোগও করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে সেই প্রজেক্ট ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। এখনও তেমন হয় বিভিন্ন জায়গায়। আমার মনে হয়, ক্ষমতার আস্ফালনই যদি হেনস্থা করার সাহস জোগায় পুরুষকে, তা হলে হেনস্থা আর হয়রানি বন্ধ করতে নারীর ক্ষমতায়নে জোর দেওয়া জরুরি।’’
পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০১৪ থেকে ২০১৭-এর মধ্যে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার ঘটনা বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে এই ঘটনার বৃদ্ধির পায় আরও ১৪ শতাংশ। এমনকি, এই সংখ্যার বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটেছে, যার লিখিত কোনও অভিযোগ নেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অভাবেই কি এই ধরনের ঘটনা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে? এই বিষয়ে খানিকটা সহমত সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা সমতা বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিবাদ করা খুব জরুরি। না হলে নারীকে অসম্মান করা আর পণ্য হিসাবে দেখা যাদের মজ্জাগত, তারা বার বার পার পেয়ে যাবে। সেটা করা চলবে না। মহিলাদের উদ্দেশে নানা ধরনের আদিরসাত্মক মন্তব্য এবং চটুল শব্দবিন্যাস ছুড়ে দেওয়া হয়, সেগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে বেশি হয়, ছাত্রীকে নিয়ে পুরুষ শিক্ষকদের গোপন আলোচনা। সব কিছু তো বৃত্তের বাইরে আসে না। এই ধরনের ঘটনার ব্লু প্রিন্ট তৈরি হয়ে যায় তখনই। তাই সতর্ক এবং সচেতন হওয়া দরকার বলে আমার মনে হয়।’’
সময়টা একবিংশ শতক। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে আটকে রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর পুরুষ সহকর্মী বুচ উইলমোর। এর পরে মেধার পরীক্ষায় পাশ করে নিজের দমে চাকরি পেয়েও যদি কর্মক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের হাতে নিগৃহীত হতে হয়, তা হলে ধরে নিতেই হয় সমাজে ঘুণ ধরেছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর সাফল্য মানেই ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে তাঁর আদানপ্রদানের সম্পর্ক রয়েছে, অনেকেই এমন ভাবনা পোষণ করেন। এই ভাবনা যত দিন না মুছে যাচ্ছে, এই ধরনের ঘটনার শেষ হবে না বলে মনে করেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পরিচিত মুখ রাজন্যা হালদার। রাজনীতিতেও কি ক্ষমতার কাছে নারীকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করা হয়? রাজন্যা বলেন, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে তেমনটি হয় তো বটেই। ক্ষমতা প্রদর্শন তো সব ক্ষেত্রেই চলে। শুধু তো রাজনীতি বা অন্য ক্ষেত্র নয়, জীবনযুদ্ধেও পুরুষের নোংরা স্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে হয়। কিছু দিন আগে আমার সঙ্গেও এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। ট্রেনে মহিলাদের জন্য বরাদ্দ দু’টি কামরা ছেড়ে যদি কখনও সাধারণ কামরায় উঠি, তখনই নানা ধরনের কটু মন্তব্য আর হাত শরীরের দিকে তেড়ে আসে। সমাজমাধ্যমেও আমাকে কম আক্রমণ করা হয়নি। আমি একজন মেয়ে বলেই এই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। তবে চুপ করে থাকলে চলবে না। প্রতিবাদের ভাষা যেমনই হোক, তা স্বর হয়ে যেন বাইরে আসে।’’
বহু লড়াইয়ের পরে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে পাশ হয়েছিল ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অফ উইমেন অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস অ্যাক্ট’। আইন পাশ হওয়ার দশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কর্মক্ষেত্রে মৌখিক হেনস্থা অথবা যৌন হয়রানির ঘটনা থামেনি, বরং বেড়েই চলেছে। আইন থাকলেও, মহিলাদের নিরাপত্তা নেই। সাম্প্রতিক সময়ের দু’টি ঘটনা তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অনেক সময়ে সামাজিক সম্মানহানি এবং সহকর্মীদের চর্চার বিষয় হয়ে ওঠার ভয়ে চুপ করে থাকেন অনেকেই। আর এ ভাবেই বিষয়গুলিকে ঘিরে এক প্রকার নীরবতার আবরণ তৈরি হয়, যা আখেরে হেনস্থাকারীর পক্ষেই সুবিধাজনক হয়ে ওঠে।