(বাঁ দিক থেকে) অনুপ মতিলাল, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জয়ন্ত সেনগুপ্ত। —নিজস্ব চিত্র।
রামরাজ্য গড়া চাট্টিখানি কাজ নয়! এক সাহেবও চেষ্টা করেছিলেন। সুন্দরবনে।
নাম স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিলটন। এ দেশে এসেছিলেন সেই কোম্পানির আমলে। ব্যবসা করবেন বলেই। বম্বে থেকে কোনও ভাবে চলে আসেন বঙ্গে। তার পর এ অঞ্চলকে প্রায় ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেন। মন দেন পল্লিসমাজের উন্নয়নে। বিশেষ করে সুন্দরবনের গোসাবায়।
অমুক সাহেব, তমুক সাহেবের কথা মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। তবে সেই সাহেবের কী কাজ, কেমন জীবন, কী ভাবনা থেকে কী করেছিলেন, তা সব সময়ে ধরে রাখা হয় না। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অনুপ মতিলাল সেই কাজ করেছেন। যে হ্যামিলটন সাহেবকে এ দেশে ‘কোঅপারেটিভ’-এর জনক বলে ধরা যায়, স্কটল্যান্ডের সেই ভদ্রলোকের কিছু লেখাপত্র এক জায়গায় করে সম্পাদিত একটি বই প্রকাশ করেছেন। নাম ‘দ্য ফিলোজ়ফার্স স্টোন’। সোমবার সন্ধ্যায় বিড়লা অ্যাকাডেমি অফ আর্ট অ্যান্ড কালচারে ছিল সেই বই আনুষ্ঠানিক প্রকাশ পাওয়ার পালা। সকলের সঙ্গে বইটির পরিচয় ঘটালেন সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ। আর তার পরেই হল হ্যামিলটনের সঙ্গে কলকাতা শহরের আলাপ। তা ঘটাতে বইয়ের দুই সম্পাদক আলাপনবাবু ও অনুপবাবুকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন ইতিহাসবিদ জয়ন্ত সেনগুপ্ত।
‘দ্য ফিলোজ়ফার্স স্টোন’ কানে এলে এখন হ্যারি পটারের কথাই সাধারণত মনে হয়। আলাপনবাবুও সে কথা উল্লেখ করলেন। তবে এই বইয়ের নাম রাখা হয়েছে হ্যামিলটনের একটি প্রবন্ধের নাম থেকে নিয়ে। ‘দ্য ফিলোজ়ফার্স স্টোন’ হল এমন এক পাথর যা পরশপাথরের মতো কাজ করে, জানালেন আলাপনবাবু। আর স্কট সাহেবের সেই পরশের কথাই যেন তুলে ধরতে চেয়েছেন দুই সম্পাদক। পল্লিসমাজের উন্নয়নে একে অপরের পাশে থাকা, বেঁধে থাকা জরুরি। সেই ভাবনা থেকেই একটি ‘কোঅপারেটিভ’ তৈরি করেন সুন্দরবনের গোসাবা অঞ্চলে। বিশ শতকের গোড়ার কথা। তখন সুন্দরবন শহুরে জনজীবন থেকে আরও অনেক দূরে। জমিদারি বন্দোবস্তও নেই। ফলে জীবন আরও অগোছালো। দারিদ্র প্রখর। জমির উপর দখল নিলে যে সাধারণের জীবন এমনিতেই উন্নত হবে, সে ভাবনা আসে তাঁর মনে। সেই থেকেই এত কাজ। অনুপবাবু সঙ্গে জোড়েন, গোসাবার সামগ্রিক উন্নয়নের কথাই ধীরে ধীরে ভাবেন হ্যামিলটন সাহেব। তাঁর চেষ্টায় সে এলাকায় স্কুলও গড়া হয়। যে এলাকা আগে শহুরে বন্দোবস্তের একেবারে বাইরে ছিল, তা অন্তত সাধারণের ভাবনায় প্রবেশ করে।
তবে কি ড্যানিয়েল হ্যামিলটনকে সাধারণ মসিহা বলে মানা হত সে কালের ভারতে? সম্পাদকেরা সে সব উত্তর যে খোঁজেননি একেবারে, তা নয়। এ বই স্বয়ং সেই সাহেবের লেখাপত্রেরই বিশেষ সন্ধান দেয়। নিজের মতো করে তাঁকে খুঁজে নেওয়ার দিকেই ঠেলে দেয়। তবে আলাপনবাবু জানান, ১৯০৪ সালে এ দেশে যে কোঅপারেটিভ অ্যাক্ট তৈরি হয়, তার পিছনে অনেকটাই হাত ছিল এই সাহেবের। কিন্তু তাই বলে কি তাঁর কোনও সমালোচনা হয় না? ইতিহাস পড়ার নানা ভাঁজ থাকে। সেই ভাঁজ যাঁরা দেখেন ও দেখতে শেখান, তাঁরাই আগামীর পথ দেখান। সোম-সন্ধ্যা সে সবের সাক্ষীও রইল। যেমন আলাপনবাবু তুললেন ‘ইউটোপিয়া’র কথা। থমাস মোরের চর্চিত সেই বই প্রকাশের পর থেকে যেন বদলেই গিয়েছিল গোটা ইউরোপের বৌদ্ধিক চর্চার বাতাসের দিক। শেক্সপিয়র থেকে শুরু করে নানা সময়ের সেরার সেরা বুদ্ধিজীবী সেই ভাবনায় বাঁধা পড়েছেন। দিশেহারাদের পথ দেখিয়ে ইউটোপিয়া বা আদর্শ সমাজ অথবা বলা যায় ‘রামরাজ্য’ গড়ে তোলার মসিহা হয়ে ওঠার স্বপ্ন নানা জনেই দেখেছেন। আলাপনবাবু বলেন, ‘‘গোসাবাতেও নিজের ইউটোপিয়াই গড়তে চেয়েছিলেন যেন হ্যামিলটন সাহেব।’’
রামরাজ্য গড়ার সেই স্বপ্ন কি সার্থক হয় সাহেবের? দর্শক আসন থেকে প্রশ্ন ভেসে আসে। খানিকটা তো বটেই। অন্তত সাধারণের আলোচনার মানচিত্রে তো গোসাবার সঙ্গে ঢুকে পড়ে গোটা সুন্দরবনও। উত্তর দেন সম্পাদকেরা। তবে অমিতাভ ঘোষ সে চেষ্টাকে যে খুব ভাল ভাবে দেখেছেন, তা বলা চলে না। বরং তাঁর ভাবনা বলে, ওই এলাকা আসলে জনসাধারণের বাসের জন্যই নয়। এ সব চেষ্টা হয়তো বা না হলেই ভাল হত।
ফলে রামরাজ্য গড়ার চেষ্টাই রয়ে যায় বিতর্কের বিষয় হয়ে। যদিও বলে রাখা ভাল, হ্যামিলটন সাহেবের জন্ম ও মৃত্যুর দিনটি এক। তার যোগ থাকতেও পারে রামরাজ্য নিয়ে এ কালের ইতিহাস চর্চায়। তারিখটি ডিসেম্বরের ৬।