Mahakumbh 2025

মহামানবের মহাতীর্থে একাকার পুণ্য আর মোক্ষের উদ্দেশ্য, মহাকুম্ভ থেকে উঠে আসে কোন বার্তা?

একটি মাত্র ক্যাম্পের দৌলতে কতগুলি স্থানীয় পরিবারের রুজির ব্যবস্থা হচ্ছে! হলেও বা মাত্র ক’দিনের জন্য। কিন্তু হচ্ছে তো! সেটিই বা কম কী?

Advertisement
সুদীপ ঘোষ
শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১২:৪১
প্রয়াগে ত্রিবেণী সঙ্গমে গঙ্গারতি।

প্রয়াগে ত্রিবেণী সঙ্গমে গঙ্গারতি। ছবি: পিটিআই

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পুণ্যার্জনের বাসনা কতটা প্রখর সেটি বোঝা গিয়েছিল, গত ২০২৩ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি যখন গোমুখ গমনের অভিপ্রায়ে গঙ্গোত্রী পৌঁছেছিলাম। অক্টোবর মাসে গঙ্গোত্রীতে বিভীষণ শৈত্য। তাপমাত্রা রাতে এবং ভোরবেলা ৬-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। সূর্যোদয়ের পর কোনও মতে ১২-১৩-তে পৌঁছয়। ওই ঠান্ডাতেই দিব্যি গঙ্গাস্নান চলছে। গঙ্গার স্রোত গঙ্গোত্রীতে তীব্র। তাকে থোড়াই কেয়ার! পাথুরে তট। শ্যাওলা ধরা। পা পিছলে যাওয়ার ঝুঁকি সব সময় বর্তমান। তাতেও পুণ্যার্থীদের কোনও বিকার নেই। দিনের আলোয় দিব্যি জামাকাপড় ছাড়া, ভিজে পোশাক পাল্টানো, সবই চলছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। কনকনে ঠান্ডায় তিনথাক গরম পোশাকের মধ্যে ঢুকেও আমার হাড় পর্যন্ত কাঁপছে। পুণ্যার্থীরা কিন্তু নির্বিকার। এঁরা সকলেই গৃহী। অর্থাৎ আপনার-আমার মতোই সামান্য, সাধারণ মানুষ। কিন্তু কী অসম্ভব সহ্যশক্তি!

Advertisement
কনকনে ঠান্ডা অগ্রাহ্য করেই চলছে পুণ্যস্নান।

কনকনে ঠান্ডা অগ্রাহ্য করেই চলছে পুণ্যস্নান। ছবি: পিটিআই।

ঠিক একই জিনিস প্রত্যক্ষ করলাম ২০২৫-এর জানুয়ারি মাসে প্রয়াগরাজ শহরে মহাকুম্ভে গিয়ে। এই সময়ে প্রয়াগে তাপমাত্রা ২৩ থেকে ৭ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করে। গঙ্গার জল বেশ ঠান্ডা। কিন্তু তাতেও কেউ এতটুকু দোনামনা করছেন না জলে নামতে। নেমেই ঢক করে মাথা পর্যন্ত জলের তলায় ডুবিয়ে দিচ্ছেন। এবং কাঁপতে-কাঁপতে তীরে উঠছেন। এ দিকে মুখে যেন এক পূর্ণতার আবেশ মাখা। এবং এই ডুব চলছে সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা নির্বিশেষে। সূর্যের তাপ থাকুক, কি না থাকুক। পুণ্যের ছোঁয়া। পাপস্খালন। অমৃতের পরশ। বড় আকর্ষণীয়! বড় লোভনীয়।

কিন্তু প্রশ্ন হল, ‘কুম্ভ’ জিনিসটি ঠিক কী? ‘কুম্ভ’ শব্দটির বাংলা মানে কলস বা কলসি। অর্থাৎ এমন এক পাত্র যার মধ্যে তরল সংরক্ষণ করা যায়। তো এই কুম্ভে কোন তরলটি ধরা ছিল? উত্তর, সমুদ্রমন্থনে ওঠা অমৃত। তা হলে তার সঙ্গে গঙ্গা, যমুনা এবং অন্তঃসলিলা সরস্বতীর কী সম্পর্ক? না, এই সঙ্গমস্থলে সেই মন্থননিঃসৃত অমৃতের খানিকটা নাকি চলকে পড়েছিল। পড়েছিল আরও বারোটি জায়গায়। যার মধ্যে আটটিই অন্যান্য লোকে। পৃথিবীতে পড়েছিল প্রয়াগের সঙ্গম ছাড়া আরও তিন স্থলে—গঙ্গাদ্বার (আন্দাজ করা হয় হরিদ্বারের খুব কাছেই অবস্থিত কোনও পুরনো জনপদে), নাসিক এবং উজ্জয়িনীতে। এই তথ্য ‘মহাভারতে’ই রয়েছে। এই ‘মহাভারত’ কিন্তু বাংলা কাশীদাসী ‘মহাভারত’ নয়। এ হল খোদ ব্যাসদেবের মূল সংস্কৃতে রচিত স্মৃতিগ্রন্থ। যার লেখনী, বিশ্বাস করা হয় গণেশদেবের। এ হেন ‘মহাভারতে’ই রয়েছে দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনের বিবরণ। তো এই সমুদ্রমন্থনের ফলস্বরূপ কী কী উত্থিত হয়েছিল? নানা জিনিস। ‘মহাভারতে’র সূত্র অনুযায়ী শুরুতে উঠেছিল শুদ্ধ ঘি। তার পর একে একে উত্থিত হন চন্দ্রদেব, লক্ষ্মীদেবী, বারুণী মদ্য, ধন্বন্তরী, আয়ুর্বেদিক ঔষধি, পারিজাত পুষ্প, অমৃত এবং সবশেষে হলাহল। বিষ্ণুদেবের বুদ্ধিতে এই মন্থনকার্য সমাধা হয় যৌথ ভাবে সুরাসুরের প্রচেষ্টায়। মন্থনদণ্ড হন মন্দার পর্বত এবং মন্থনরশি হতে রাজি হন বাসুকী নাগ। মন্দার পর্বতের ভারসাম্য বজায় রাখতে, কূর্মরূপে অবতরণ করেন স্বয়ং বিষ্ণু, যা থেকে তাঁর কূর্মাবতারের উদ্ভব। এগুলির প্রায় প্রত্যেকটিই জানা তথ্য। প্রসঙ্গত, অসুরেরা মন্থন-উত্থিত প্রায় কোনও জিনিসই শেষ পর্যন্ত পাননি, বারুণী মদ্য ছাড়া। চন্দ্রকে নিয়েছিলেন দেবাদিদেব শিব তাঁর জটাজুটের আভরণ হিসাবে, লক্ষ্মীকে বিষ্ণু স্বয়ং। ঘৃতও সম্ভবত জুটেছিল দেবতাদের ভাগ্যে। ধন্বন্তরী হয়ে ওঠেন দেবচিকিৎসক। পারিজাত তো স্বর্গের নন্দনকাননের শোভা বৃদ্ধি করছে। হলাহল গ্রহণ করতে কোনও পক্ষই রাজি না হওয়ায়, তা শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করেন শিব।এই ধন্বন্তরীই উঠেছিলেন অমৃতের কলস হাতে নিয়ে। এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন হিন্দু-পুরাণবিদ এবং সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। তাঁর নিজস্ব একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে। এ বছর কুম্ভমেলা শুরু হতেই তিনি কুম্ভ নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেন সেই চ্যানেলে। এ বার প্রশ্ন, সমুদ্রমন্থন নির্গত অমৃত, ঠিক কী? নৃসিংহবাবুর মতানুযায়ী, অমৃতই হয়তো বৈদিক যুগের সোমরস। ঋগ্বেদের একটি সূক্ত সোমরসকে এ ভাবে বর্ণনা করে:

অপম্ সোমম্ অমৃত আভূমা

অগন্ম জ্যোতির অবিদম্ দেবন্

কিম ন্যূনম্ অসমন্ ক্রণাভদ্ আরতিঃ

কিম্ উ ধুর্তির অমৃত মার্টিয়্যস্যা

অর্থাৎ, এক ভাবে সোমকে অমৃতের সঙ্গে তুলনা করেছে ঋগ্বেদ। এই তুলনা থেকেই নৃসিংহবাবুর দাবি, অমৃত হয়তো এক অর্থে সোমরসই। মনে রাখতে হবে, সোমরসও কিন্তু মন্থনজাত পানীয়। এবং সে পানীয়ও কলসে রাখা হত। সোম আসলে কী,তা নিয়ে দেশ-বিদেশের পণ্ডিতদের মধ্যে নানা বিতর্ক আছে। তবে নৃসিংহবাবু জানাচ্ছেন, হিমালয়ের পাদদেশে তৈরি হওয়া এক রকম ছত্রাকজাত পানীয় হতে পারে সোমরস। সেই ছত্রাক নাকি রাতের বেলা আভা বিচ্ছুরণ করত। বৈদিক যুগ পরবর্তী সময়ে সেই ছত্রাক ধীরে-ধীরে দুর্লভ হতে হতে ক্রমে লোপ পায়।

সঙ্গমে সাধু সমাগম।

সঙ্গমে সাধু সমাগম। ছবি: পিটিআই।

মন্থনের কাহিনি বলে, সমুদ্রমন্থনের ফলে অমৃত উত্থানের পর অসুরেরা তার অর্ধেক দেবতাদের দিয়ে, কলসসহ বাকিটুকু নিয়ে মন্থনস্থল ছেড়ে প্রস্থান করতে তৈরি হন। কিন্তু দেবতাদের লোভ! তাঁরা আরও অমৃতপান করতে চান। সুতরাং, দেবাসুরের মধ্যে সেই অমৃতকলসের অধিকার পাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। সেই সময়ে বিষ্ণু মোহিনী রূপে অবর্তিত হন, এবং প্রাথমিক ভাবে অসুরদের অধিকারে থাকা অমৃতপাত্রের অধিকার নেন। মোহিনীর রূপমুগ্ধ অসুরেরা তখন সহজেই অমৃতকলসটি সেই নারীর হাতে অর্পণ করেন। শেষ পর্যন্ত মোহিনীরূপী বিষ্ণুর হাত থেকে দেবরাজ ইন্দ্র কলসটি পান, এবং তিনি পুত্র জয়ন্তের কাছে সেটি জমা রাখেন। অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে এর পর বারো দিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে। দেবলোকের এক দিন হল মর্ত্যলোকের এক বছরের সমান। এই সময়ে দ্বন্দ্বক্লান্ত দেবতারা ১২ বার বারোটি জায়গায় সেই অমৃতকলস রাখতে বাধ্য হন। তাঁদের মধ্যে জয়ন্তও ছিলেন। এই বারোটি জায়গার মধ্যে মর্ত্যলোকের চারটি জায়গা পড়ে। বাকিগুলি অন্যান্য লোকে। তাই ১২ বছর অন্তর পূর্ণকুম্ভ যোগ আসে। আর মহাকুম্ভ যোগ আসে ১৪৪ বছরে এক বার। তার সঙ্গে আবার নক্ষত্রের অবস্থানের একটি সম্পর্ক আছে। বৃহস্পতি গ্রহ এক বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে লাগায় পৃথিবীর হিসাবে ১৪৪ বছর। সেই সময় এলে, তবেই ঘটে পূর্ণকুম্ভ। নৃসিংহবাবুর মতে অবশ্য এই পরবর্তী ঘটনাগুলির কোনও উল্লেখ বেদ, মহাকাব্য এ সবে নেই। পরবর্তী কালে রচিত নানা ‘অর্বাচীন’ পুরাণগুলিতে লেখা হয়েছে মাত্র। সুতরাং এ কথা বলাই যায় যে, কুম্ভের আসলে তেমন কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। গঙ্গাসাগরের উল্লেখ যেমন ‘মহাভারত’-এ আছে। সেখানে পাণ্ডবেরা এসেছিলেন।তা হলে কুম্ভ এত জনপ্রিয় হল কী করে? প্রয়াগে মাঘমেলার প্রচলন বহু দিনের। একটি মতানুযায়ী, শঙ্করাচার্য সেইখানে কুম্ভমেলার প্রচলন করেন। উদ্দেশ্য, হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আরও বেশি সংখ্যক ব্রহ্মচারীকে আকৃষ্ট করা। দিনে দিনে তাই এই তীর্থস্থানটি ভারতবর্ষে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এবং এর মহিমা ছড়িয়ে পড়ে। এ ভাবেই হয়তো আজকের কুম্ভমেলার জন্ম।

কুম্ভে স্নানের প্রকৃষ্ট স্থানটি হল সঙ্গমস্থল। অর্থাৎ, ঠিক যে জায়গাটিকে গঙ্গা, যমুনা এবং অন্তঃসলিলা সরস্বতীর মিলনস্থল বলে মনে করা হয়, সে জায়গাটিতে পৌঁছনোর জন্য নৌকো ভাড়া করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ জায়গাটি নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। সঙ্গমের সবচেয়ে নিকটবর্তী ঘাটটির নাম হল আরেল বা আরৈল ঘাট। আমরা ছিলাম দিব্য প্রয়াগরাজ কুম্ভ ক্যাম্পে। যেখান থেকে আরৈল ঘাটের দূরত্ব ১.৫ কিমি। আসলে ত্রিবেণী সঙ্গম ঠিক প্রয়াগরাজ শহরের মধ্যে অবস্থিত নয়। সঙ্গম অবস্থিত নৈনী নামে প্রয়াগরাজ শহরের খানিক বাইরে অবস্থিত একটি শহরতলিতে। আমাদের ক্যাম্পটি তাই শহরের মধ্যে ছিল না। স্টেশনে নেমে এক ঘণ্টা মতো ভাড়াগড়িতে ভ্রমণ ছিল আবশ্যিক।

২৬ জানুয়ারি পৌঁছেছি প্রয়াগে। তখন ভোর তিনটে। মোটামুটি ভোর চারটে নাগাদ ক্যাম্পে পৌঁছনো গেল। বেসরকারি ব্যবস্থা। তবে বেশ পরিপাটি। রাতে অত বুঝিনি। কিন্তু দিনের আলো ফুটতে উপলব্ধি করলাম, আশপাশের পরিকাঠামো, রাস্তাঘাট অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। কলকাতাবাসী হিসাবে প্রথমেই যেটি দৃষ্ট হল, ক্যাম্পের সামনের চার লেনের পাকা রাস্তাটিতে (নাম: হনুমান মার্গ) একটিও প্লাস্টিক বর্জ্য পড়ে নেই। প্রত্যেক এক মিটার অন্তর একটি করে ‘কুড়েদান’ বসানো। সারা ক্ষণ পুরসভার কর্মীরা রাস্তা পরিষ্কার করছেন, ঝাঁট দিয়ে। ধুলো ফেলছেন বর্জ্যদানিতেই। পথের দু’পাশে অসংখ্য অস্থায়ী খাবার দোকান। সেই সব দোকানের কর্মী বা পথচারীরাও এর অন্যথা করছেন না। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের আইনরক্ষকেরা সারা দিন নজর রাখছেন রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে। নজর রাখছেন গাড়ি এবং মানুষের চলাচলের উপর। প্রয়োজন মতো আরপিএফের সদস্যেরাও রাস্তায় নামছেন। ২৫ তারিখেই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হেলিকপ্টার সহযোগে নৈনীতে এসেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর আগমনের আগেই ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল, প্রশাসন প্রধানের আগমনের মুহূর্তে ক্যাম্পের সদর বন্ধ থাকবে। ওই সময়ে সাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হবে। সে সময়ে লক্ষ্য করলাম মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেডের ব্যবস্থা। কাউকে এ পার-ও পারও করতে দেওয়া হচ্ছে না। এই শৃঙ্খলাবদ্ধতা সবার জন্য। কোনও ভিআইপি পাসেও এর অন্যথা করা হচ্ছে না। তিন দিন ছিলাম। সারা দিন, মাথার উপর দেখেছি দু’টি কপ্টার ঘোরাফেরা করছে। এগুলি বিশেষত ধনী পুণ্যার্থীদের যাওয়া-আসার জন্য, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। যাঁরা হাঁটাহাঁটি বা নৌকাযাত্রা এড়াতে চান, সোজাসুজি সঙ্গমে পৌঁছনোর জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে অনেক বেশি কড়ি হাতবদল করতে হবে। উল্লেখ করে রাখা ভাল, রাস্তায় টহল দেওয়া আইনরক্ষকদের মধ্যে যাঁরা আধিকারিক পর্যায়ের, তাঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত অতিথিবৎসল। প্রথম দিন সঙ্গমে পৌঁছনোর কী উপায়, সেই সম্বন্ধে পাশের অস্থায়ী দোকানে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। তা শুনতে পেয়ে এক জন পুলিশ আধিকারিক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে এসে, সহযোগিতা করলেন। পইপই করে বলে দিলেন, “এক পয়সাও বেশি দেবেন না। এখান থেকে আরৈল ঘাট পৌঁছতে, অটোর সরকার নির্দেশিত ভাড়া হল জনপ্রতি ২০ টাকা। আরৈল থেকে সঙ্গমে যেতে-আসতে নৌকা ভাড়া হল জনপ্রতি ৭৫ টাকা। আগে পৌঁছবেন গন্তব্যে, তার পর মাঝি বা চালকের ভাড়া মেটাবেন। কোনও মতেই শুরুতে টাকা গুনবেন না। ঠকে যেতে পারেন যে কোনও মুহূর্তে। “ইঁয়াহ্ সবলোগ মৌকা সমঝকে আপ জ্যায়সে লোগোঁকো লুঠ রহা হ্যায়। দেড় কিলোমিটার কি দূরি পর হ্যায় ঘাট কি রাস্তা। চাহে তো পয়দলহি যা সকতে।”

সাধুদের পুণ্যক্ষেত্র কুম্ভ।

সাধুদের পুণ্যক্ষেত্র কুম্ভ। ছবি: পিটিআই।

কুম্ভমেলা শুরুর দিন একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে প্রয়াগরাজের ব্যবস্থাপনা, সুযোগ-সুবিধা এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে একটি বিস্তারিত লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সাকুল্যে ৪৬ দিনের কুম্ভমেলায় উত্তরপ্রদেশ ও কেন্দ্রীয় সরকার যৌথ ভাবে কাজ করেছে বলে জানা যায় এই লেখা থেকেই। জানা যাচ্ছে, ২০২৫-এর কুম্ভমেলায় সরকারি ভাবে আন্দাজ করা হয়েছে দেশের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার ৪০ কোটি মানুষই উপস্থিত হবেন মেলা চলার ৪৫ দিনের মধ্যে। তার মধ্যে বিশেষ স্নানের তিথিগুলিতে এই ভিড় বহু গুণে বেড়ে যাবে, কয়েক দিনের জন্য। গঙ্গার ঘাটের ৪০০০ হেক্টর জমিতে তাই গড়ে তোলা হয়েছে এক অভিনব তাঁবু-শহর। পোশাকি নাম ‘টেন্ট সিটি’। কিন্তু গোটা ব্যবস্থাটিই অস্থায়ী। ৪৫ দিন পরে এই শহর পৃথিবীর বুক থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। সরকারি ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা ‘টেন্ট সিটি’ ছাড়াও একটি বিস্তীর্ণ এলাকাকে প্লটে প্লটে ভাগ করে, তুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি হাতে। আমাদের ক্যাম্পটিই ছিল এমন বেসরকারি উদ্যোগে নির্মাণ করা পরিকাঠামো। প্রত্যেক ঘরে লোহার ফ্রেমের উপর প্লাইউডের তক্তা। তার উপর গদি। বালিশ, কম্বল। ঘরগুলি সম্পূর্ণ প্লাইবোর্ড নির্মিত। গঙ্গার বিস্তৃত তট জুড়ে এই সব ক্যাম্প অবস্থিত। গঙ্গামাটির উপর ইট পেতে তৈরি করা হয়েছে মেঝে। তার উপর পুরো ক্যাম্প জুড়ে ছড়ানো রয়েছে পাতলা কার্পেট। ২৪ ঘণ্টা জল, বিদ্যুতের বন্দোবস্ত। ঘরে ঘরে লাগোয়া স্নান ইত্যাদির ঘর। সেখানে গিজারের ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রত্যেক ঘরে আছে ছোটখাটো রুম হিটার। যেটি লক্ষণীয়, গঙ্গাতীরের মাটিতে পা বসে যেতে পারে। যেখানে আলাদা করে ঢালাই পথ করা সম্ভব হয়নি, সেখানে চলাফেরার সুবিধার জন্য গায়ে গায়ে ফেলা হয়েছে ঢালাই লোহার বড় বড় পাত। এবং প্রকৃতির ক্ষতি যতটা কম পারা যায়, করা হয়েছে। বড় রাস্তার দু’পাশের গাছগাছালি, মাঠ ইত্যাদি যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি, খাটাল উচ্ছেদও করা হয়নি। তার সামনে কাপড়ের পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন ভাবে যাতে রাস্তা থেকে নজরে না পড়ে।

দিব্য প্রয়াগরাজ কুম্ভ ক্যাম্প ছাড়াও নৈনীতে আছে আরও দু’টি। প্রত্যেকটিই এক একরের মতো প্লটে। আমাদের ক্যাম্পের কর্ণধার শশীকান্ত মিশ্র। মিশ্র পরিবারের তিন সদস্য— বাবা, মা আর বড় পুত্র মিলে সেগুলির দেখাশোনা করেন। বক্সারের মানুষ মিশ্র খুবই অমায়িক স্বভাবের। জীবনের শুরুতে ভারতীয় বায়ুসেনায় ছিলেন। একটি পা হারিয়ে কাঠের পায়ে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটেন। বায়ুসেনা থেকে অবসর নিয়ে কিছু দিন ভারতীয় জীবন বিমা নিগমে বেতনভুক ছিলেন। তার পর থেকে কুম্ভমেলাগুলিতে ক্যাম্প চালানোর ব্যবসায় নামেন। দিব্য প্রয়াগরাজ কুম্ভ ক্যাম্প স্থাপনা হয় প্রত্যেক কুম্ভমেলায়। চার জায়গাতেই। মিশ্রবাবুর বয়স এখন ৭০ বছর। কিন্তু দেখে ষাটের বেশি মনে হয় না। আমাদের থাকার তিন দিনের এক দিনও তাঁর আপিসঘরের দরজা বন্ধ হতে দেখিনি। এ রকম বিচিত্র কর্মজীবনের খবর পেয়ে নিজেই আলাপ করেছিলাম ভদ্রলোকের সঙ্গে। মনে প্রশ্ন জেগেছিল, মানুষটির কি এক ফোঁটাও বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না? তার উত্তরে মিশ্রবাবু যা জানালেন, তার অন্তর্নিহিত জীবনদর্শনটিই চমকপ্রদ শোনাল— “মানুষ মাঝেমধ্যেই আমায় এই প্রশ্নটি করেন। আমি তখন বলি, আমার বয়সটি আসলে কুড়ি বছর, আর বাকি পঞ্চাশ বছর হল আমার অভিজ্ঞতার বয়স। বয়স হয়ে গিয়েছে, অথর্ব হয়ে পড়েছি, এমন মনে করলেই বয়সের ভূত ঘাড়ে চেপে বসবে। পাত্তা না দিলে, বয়স শুধুমাত্র একটি সংখ্যা।”

দিব্য প্রয়াগরাজ কুম্ভ ক্যাম্পের এক একর জমিতে ৭০০ জনের থাকার ও খাওয়াদাওয়ার অস্থায়ী ব্যবস্থা রয়েছে। নানা আয়তনের ঘর— ডর্মিটরি, ইকোনমি, ডিলাক্স, প্রিমিয়াম ভাগে ভাগ করা, সুযোগ-সুবিধার সামান্য পার্থক্য আছে। ডর্মিটরির ভাড়া জনপ্রতি ১৫০০ টাকা প্রতিদিন। বাকিগুলির প্রত্যেকটিতেই দু’জনের থাকার ব্যবস্থা। দাম দিনপ্রতি ৫৯০০ থেকে ৯,৯০০ টাকার মধ্যে, ঘরের সুযোগ-সুবিধের উপর নির্ভর করে। ক্যাম্পের মধ্যেই ঢালাও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। খাওয়ার বিষয়টি ইচ্ছামতো, সামান্য বেশি অর্থের বদলে থাকার মধ্যেই ঢুকিয়ে নেওয়া যায়। না হলে, রাস্তার উপর প্রচুর খাবার দোকান। সবই অস্থায়ী। ইচ্ছে হলে সেখান থেকেও দানাপানির ব্যবস্থা করে নেওয়া যায়। তবে ক্যাম্পের আহার নিরামিষ হলেও সুস্বাদু তো বটেই, উপরন্তু উষ্ণ। শীতের মুখে সেটিই বেশির ভাগ পছন্দ করছেন দেখলাম। শাহি স্নানের দিনগুলিতে ভাড়া খানিক বেড়ে যায়। সব ব্যবস্থাই লক্ষ করলাম, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে চলছে। চার বেলার ভোজনের আয়োজন। প্রাতরাশ, দুপুরের খাবার, বিকালের চা বা কফি এবং রাতের খাবার। আমরা যত দিন ছিলাম, মোটামুটি শ’খানেক থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ অতিথি ছিলেন। ২৮ তারিখ, মৌনী অমাবস্যার শাহি স্নানের আগের দিন মিশ্রবাবু জানালেন, ৭০০ জন মতো এসে যাবেন ক্যাম্পে। এত মানুষের জন্য চার বেলা খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা মুখের কথা নয়। সঙ্গে আছে সারা দিনের নানা সময়ে অতিথিদের স্টেশন বা বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। তার জন্য আলাদা মাসুল গুনতে হবে অবশ্য। সারা ক্ষণই খোঁজখবর নিচ্ছেন অতিথিরা। কখন স্টেশন বা বিমানবন্দরের উদ্দেশে গমন শুরু করা উচিত, কাছাকাছি যাওয়া-আসার কী ব্যবস্থা, প্রশ্ন বহু। রাস্তাঘাটে যানের গতি মাঝেসাঝেই অবরুদ্ধ রাখা হচ্ছে। কারণ, পথে অনেক মানুষ। কিন্তু বড় কথা হল, সবই হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা মেনে। ক্যাম্পে লক্ষ করলাম, যাঁরা রান্নাবান্না করছেন, ব্যুফে টেবিল সাজাচ্ছেন, ঘরবার পরিষ্কার রাখছেন— সবাই রাজ্যের দেহাত থেকে এসেছেন। একেকটি ক্যাম্পে, একেকটি পরিবার এ সবের ভার নিয়েছেন। এ ছাড়া অতিথিদের সাহায্যের জন্য আগত কর্মচারীরা সবাই হয় নৈনী বা প্রয়াগরাজের বাসিন্দা। তরুণ-তরুণী সকলেই। দিনরাত এক করে খাটছেন। আর এই সব কিছুর দেখভাল করছেন শশার মতো মাথাঠান্ডা মিশ্রবাবু। অর্থাৎ, একটি মাত্র ক্যাম্পের দৌলতে কতগুলি স্থানীয় পরিবারের রুজির ব্যবস্থা হচ্ছে! হলেও বা মাত্র ৪৬ দিনের জন্য। কিন্তু হচ্ছে তো! সেটিই বা কম কী?

বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছে পুরো এলাকায়। তারই যেন এক ঝলকের দেখা পেলাম আমাদের ক্যাম্পে। অনস্বীকার্য, ২৯ তারিখের মৌনী অমাবস্যার স্নানের সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে। পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন একাধিক জন। আহত অনেকে। তবে নিজের চোখে যে পরিকাঠামোর সাক্ষী থেকেছি, তাকে অস্বীকার করি কী করে? ব্যক্তিগত একটি ব্যাখ্যা খাড়া করতে পারি। দুর্ঘটনার জন্য কেবল মাত্র প্রশাসনকে দায়ী করা কি উচিত হচ্ছে? দায়িত্ব যতটা প্রশাসনের, ততটাই কি পুণ্যার্থীদেরও নয়? পুণ্য লগ্নে সবার প্রথমেই জল ছোঁয়ার একটি প্রবণতা হিন্দুদের মধ্যে আছে। শাহি স্নানের সময় প্রচলিত রীতিই হল, সবার আগে জলে নামার সুযোগ পাবেন নাগা সন্ন্যাসীরা। তাঁদের পর বাকিরা। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে যা জেনেছি, জলে নামার জন্য মৌনী অমাবস্যার দিন শুরুর আগেই, অন্ধকারে হুড়োহুড়ি করে জলে নামার চেষ্টা করেছিলেন অনেকে। ঘাটে ঘাটে পর্যাপ্ত বিজলিবাতির ব্যবস্থা থাকলেও, মাঝনদীতে তা তো আর সম্ভব নয়! তা হলে? রাত থাকতে থাকতেই পুণ্যার্জনের এই আকুলতা কিসের জন্য? এই প্রশ্ন তোলারও প্রয়োজন আছে মনে হয়। রবিবার বসন্ত পঞ্চমী। আর একটি শাহী স্নানের লগ্ন। আবারও জনসমুদ্র উপচে উঠবে ত্রিবেণী সঙ্গমে। নিজেদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সাধারণ পুণ্যার্থীরা যদি সে দিন আরও একটু সচেতন থাকেন, তা হলে বোধ হয় এমন দুঃখজনক ঘটনা এড়ানো যেতে পারে।

পুণ্যলাভের আশায়।

পুণ্যলাভের আশায়। ছবি: পিটিআই।

শেষে একটি বিশেষ দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন বোধ করছি। কলকাতাবাসী হিসাবে শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা হুগলি নদীর জল ছুঁয়ে দেখতেও ইচ্ছা করে না, এত বর্জ্যপূর্ণ সেই নদীর জল। সরকারি ব্যবস্থা এবং তদুপরি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সাধারণের তা মেনে চলার কথা মনে থাকে না। খুচখাচ শুকনো ফুল-বেলপাতা, পূজার দ্রব্য, মালা তাঁরা গঙ্গাতেই বিসর্জন দিতে পছন্দ করেন। তাই সঙ্গমের জলের স্বচ্ছতা আলাদা করে চোখে পড়ে। সে জলে আকর্ণ ডুব দিতে ঘেন্না করে না। আসলে বাঙালিরা, হুগলি নদীকে ‘গঙ্গা’ নামেই ডাকতে অভ্যস্ত। কিন্তু নৈনীতে পথনির্দেশ পাওয়ার চেষ্টায় যখনই সাধারণ মানুষের সাহায্য চেয়েছি, তাঁরা উত্তর দিয়েছেন, “ইয়ে সিধে রাস্তা পাকড় কর চলা যাইয়ে, গঙ্গা মাইয়া মিল যায়েঙ্গে।” ‘গঙ্গা মাইয়া’— এই নামেই নদিটিকে সম্বোধন করেন সেখানকার মানুষ। নিদেন পক্ষে ‘গঙ্গাজি’। এবং ততখানিই সম্মান করেন মনে মনে। মায়ের মতোই পরিছন্ন এবং সুন্দর রাখতে চেষ্টা করেন নিজেদের শ্রদ্ধার নদীটিকে। আসলে সম্বোধনের রকমফেরে হয়ত মানসিকতারও হেরফের ঘটে যায়। ঘটে যায় ব্যবহারের ব্যবধান।

ত্রিবেণী সঙ্গমে ব্যক্তিগত ভাবে পুণ্যের লোভে যাইনি। তাই নদীতে স্নান দূরে থাক, নদীস্পর্শও করিনি। প্রয়াগ গমনে আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মানবসমুদ্র প্রত্যক্ষ করা। তাঁদের সঙ্গে কথা কওয়া। সে উদ্দেশ্যের কলস আমার উপচে গিয়েছে। উপলব্ধি করেছি এই দেশের চারদিকের মানুষের বিচিত্র রূপ, সজ্জা, ব্যবহার, বিশ্বাস, যাপনের নানা ছবি। এই মহাভারতের মহামানবের নদীতীর্থে পাওয়া সেই অমৃতাভিজ্ঞতাই বা কম কিসে?

Advertisement
আরও পড়ুন