Bangladesh Protest

অশান্ত বাংলাদেশ থেকে পড়ুয়া ফেরার স্রোত, কোন টানে এত ছাত্রছাত্রী পড়তে যান ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোরে

বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে আসেন। কলকাতা শহরেও আসেন এমন অনেক রোগী। অথচ চিকিৎসক হওয়ার ডিগ্রির খোঁজে বাংলার ছেলেমেয়েরা যান বাংলাদেশে। কিন্তু কেন?

Advertisement
পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৪ ০৯:০৩
Why Bangladesh attracts indian students

বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরছেন পড়ুয়া। ছবি: পিটিআই।

এখনও পর্যন্ত সাড়ে চার হাজার পড়ুয়া অশান্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরেছেন। আরও অনেকে সীমান্তে অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ এখনও আতঙ্ক নিয়েই আটকে সে দেশের হস্টেলে। ইতিমধ্যেই যাঁরা ভারতে চলে আসতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই বাঙালি। বিহার, ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দারাও রয়েছেন। আবার উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যের বাসিন্দারাও ফিরেছেন বাংলাদেশ থেকে। নেপাল, ভুটান, মায়ানমারের পড়ুয়ার সংখ্যা কম হলেও রয়েছে। এঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশে গিয়েছিলেন এমবিবিএস পড়তে। কারও চূড়ান্ত বর্ষ, তো কেউ সদ্যই ভর্তি হয়েছেন সে দেশের কোনও মেডিক্যাল কলেজে।

Advertisement

পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুরের বাসিন্দা সৌম্যদীপ চক্রবর্তীই তো মাস দেড়েক আগে ভর্তি হন বাজিতপুরের জরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজে। প্রথম বর্ষের ছাত্র সৌম্যদীপ কয়েকটা দিন আতঙ্কের মধ্যে কাটিয়ে গত শুক্রবার রাতে চলে আসতে পেরেছেন আগরতলায়। এর পরে নিজের বাড়িতে ফিরেছেন রবিবার। তিনিই জানালেন কেন যেতে হয়েছিল বাংলাদেশে। সৌম্যদীপ জানান, তাঁর চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রতিযোগিতায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন। আর বেসরকারি কলেজে পড়ার মতো সামর্থ্য ছিল না। তিনি বলেন, ‘‘ভারতে যে কোনও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে গেলে ৮০ লাখ টাকা দরকার। কোথাও কোথাও এক কোটি টাকাও লাগে। সে টাকা খরচের সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। তাই অনেকটা কম খরচে বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ মিলে যায়।’’ এখনও আতঙ্কের রেশ রয়ে গিয়েছে। তবুও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেই তিনি ফিরে যাবেন বাজিতপুরে। তাঁকে চিকিৎসক হতে হবে।

একই কথা বলছেন বীরভূমের নলহাটির মেয়ে তমন্না পরভিন। আতঙ্কের দিনরাত কাটানোর পরে পাঁচ বন্ধু মিলে শনিবার রাতেই পৌঁছে গিয়েছিলেন আগরতলায়। চট্টগ্রামের , কুমিল্লা ময়নামতী মেডিক্যাল কলেজের এই ছাত্রী জানালেন আগরতলা থেকে বাড়ি ফেরাও ছিল অনেক কষ্টের। আগাম টিকিট না-থাকায় রবিবার সকাল সওয়া ৮টায় ওঠেন শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। সাধারণ কামরায় প্রায় ৩২ ঘণ্টার যাত্রার শেষে সোমবার বিকেলে পৌঁছন বীরভূমের রামপুরহাট স্টেশনে। সেখান থেকে টোটোয় চেপে নলহাটি বাসস্ট্যান্ডের কাছে বাড়িতে। বাবা জাহির হোসেন গিয়েছিলেন রামপুরহাট স্টেশনে মেয়েকে আনতে। স্টোন চিপ্‌সের ব্যবসায়ী জাহির বলেন, ‘‘ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভাল আমার মেয়ে। কিন্তু সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ না-মেলায় খুব চিন্তা হয়েছিল। বেসরকারি কলেজে আমার কাছ থেকে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা চায়। শেষে অনেক কম খরচে বাংলাদেশের এই কলেজে ভর্তি করিয়েছি।’’

শুধু খরচই নয়, বাঙালি পড়ুয়াদের বাংলাদেশে আরও কিছু সুবিধা আছে বলে জানালেন সৌম্যদীপ-তমন্না। তাঁদের কথায়, বাংলাদেশে বড় সুবিধা ভাষার। আরও অনেক দেশে কম খরচে পড়ার সুযোগ মিললেও সেখানে ভাষার অসুবিধা থাকে। সেই সঙ্গে খাওয়াদাওয়ার সমস্যাও কম বাংলাদেশে। সবচেয়ে বড় কথা বাড়িতে আসা-যাওয়ার খরচও একেবারেই কম।

প্রসঙ্গত, শুধু বাংলাদেশই নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই ভারতীয় পড়ুয়ারা ডাক্তারি পড়তে যান। যাঁর যেমন আর্থিক ক্ষমতা, তেমন ভাবে দেশ বাছেন পড়ুয়ারা। তবে ডিগ্রি যে দেশেরই হোক, বিদেশ থেকে এমবিবিএস পাশ করে এলেই ভারতে চিকিৎসক হওয়ার ছাড়পত্র মেলে না। তার জন্য ভারতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিলের নেওয়া ‘ফরেন মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট এগ্‌জ়ামিনেশন’ (এফএমজিই) পাশ করতে হয়। অনেকেই তা পারেন না। তবে সেই পরীক্ষা বেশ কঠিন। পাশের হার এতটাই কম যে, না পারার সংখ্যাটাই বেশি। তবুও ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বিদেশে টেনে নিয়ে যায় মেধা আর অর্থবলে পাল্লা দিতে না-পারাদের।

এখন বাংলাদেশ অশান্ত হওয়ায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, ঠিক এমনটাই হয়েছিল রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির সেই সময়টায় দলে দলে ছাত্রছাত্রীরা ইউক্রেন থেকে ভারতে ফিরে আসেন। অনেকে ভেবেছিলেন ভারতে কোর্স শেষ করার সুযোগ মিলবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যেই সেই পড়ুয়াদের বড় অংশ ফিরে গিয়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে। কারণ, অনলাইনে পড়াশোনা করা গেলেও প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস তো কলেজে গিয়েই করতে হবে। হাতেকলমে রোগী দেখার শিক্ষাও তো দরকার। সেই সময়েই ভারতীয় পড়ুয়াদের বিদেশে পড়তে যাওয়া নিয়ে সত্য সামনে এনে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী। সমাজমাধ্যমে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘যাঁরা বিদেশে পড়তে যান, তাঁদের ৯০ শতাংশ এ দেশে ডাক্তারি করার যোগ্যতা নির্ধারক পরীক্ষায় (এফএমজিই) ফেল করেন।’’

ভারতে সাড়ে ৫০০-র বেশি মেডিক্যাল কলেজ থাকলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। ২৮৯টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ পান জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ভাল ফল করা ছাত্রছাত্রীরা। বাকিদের পড়তে হয় বেসরকারি কলেজে। জানালেন কলকাতায় বিদেশে লেখাপড়া করতে যাওয়ার এজেন্সিতে কর্মরত শৌভিক হালদার। তিনি বলেন, ‘‘এখানে যদি কোটি টাকা খরচ হয়, সেখানে বাংলাদেশে পাঁচ বছরে খরচ খুব বেশি হলে ৪০ লাখ টাকা। এটা টিউশন ফি। প্রতিটি সেমেস্টার অনুযায়ী খেপে খেপে টাকা জমা করতে হয়। এর বাইরে হস্টেল এবং খাওয়াদাওয়ার খরচ।’’ তিনি এ-ও জানালেন যে, বাংলাদেশে মোট সরকারি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে ৩৭টি। সেগুলিতে মূলত সে দেশের পড়ুয়ারাই সুযোগ পান। আর বেসরকারি কলেজ এখন ৭০-এর আশপাশে। সে দেশের সেনাবাহিনীও সাতটি মেডিক্যাল কলেজ চালায়। শৌভিক আরও বলেন, ‘‘ঢাকা শহরে বা তার আশপাশের কলেজগুলিতে খরচ একটু বেশি। সেখানেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পড়ুয়া যান। গুজরাত থেকে কর্নাটক— সব জায়গার ছেলেমেয়ে পাবেন। তবে সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লার দিকের কলেজগুলিতে লেখাপড়া তুলনায় কম খরচে হয়। বাংলা তো বটেই, অসম, ত্রিপুরার ছেলেমেয়েরাও ওই সব কলেজে ভর্তি হন।’’

কলকাতায় শিক্ষাঋণ প্রদানকারী সংস্থায় কর্মরত কৌশিক মিত্রের বক্তব্য, ‘‘এখন পেশা হিসাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রই বেশির ভাগ পরিবারের পছন্দ। আমাদের কাছে যাঁরা ঋণ নিতে আসেন তাঁদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত। কিন্তু সকলেই চান ছেলেমেয়ে চিকিৎসক হোক। চড়া সুদেই ঋণ নেন।’’

ভারতে সব মিলিয়ে মেডিক্যালের আসনসংখ্যা ৮৮ হাজারের মতো। কিন্তু দেশে ডাক্তারি পড়তে চাওয়া পড়ুয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। সেই চাওয়াতেই মিল উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরের সম্পন্ন ঘরের সফিরুল্লাহ খান আর উলুবেড়িয়ার শুভদীপ মিস্ত্রির মধ্যে। রাজশাহির কলেজের দুই ছাত্রই ডাক্তার হতে চেয়েছেন। বাড়িতে বসে আপাতত তাঁদের চোখ বাংলাদেশের দিকে। কবে ক্যাম্পাসে ফিরতে পারবেন জানেন না তাঁরা।

আরও পড়ুন
Advertisement