উদ্ধব ঠাকরে (বাঁ দিকে) এবং শরদ পওয়ার (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
ব্যবধান ঠিক এক বছরের। সেই সময়ও বর্ষাকাল ছিল। গত বছর জুন মাসে অনুগামী বিধায়কদের নিয়ে শিবসেনা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন একনাথ শিন্ডে। চলতি বছরের জুলাই মাসে প্রায় একই পন্থায় এনসিপি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন শরদ পওয়ারের ভাইপো অজিত পওয়ার। শিন্ডে শিবসেনা ভেঙে দেওয়ায় মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস, এনসিপি, শিবসেনার জোট সরকার ভেঙে গিয়েছিল। ২০২৩-এর জুলাই বিপ্লবে তেমন বৈপ্লবিক কোনও পরিবর্তন না হলেও, মরাঠাভূমে বিরোধীরা আরও একটু দুর্বল হল বলেই মনে করা হচ্ছে।
দুই ভাঙনের নেপথ্যেই বিজেপির ‘হাতযশ’ দেখছে বিরোধী দলগুলি। স্বাভাবিক ভাবেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে কেন্দ্রের শাসকদল। তবে বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, ক্ষমতার লোভ তো বটেই, ইডি, সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অতিসক্রিয়তা থেকে বাঁচতেও অনেকেই বিজেপি শিবিরে গিয়ে ভিড়ছেন। শিন্ডে দল ছাড়ার পরেও উদ্ধব ঠাকরের শিবির থেকে এমন দাবি করা হয়েছিল। গত বছর জুন মাসেই ৩৭ জন অনুগত বিধায়ককে নিয়ে বিজেপি শাসিত অসমে উড়ে যান বিদ্রোহী শিন্ডে। গুয়াহাটির একটি হোটেলে কিছু দিন থাকার পর বিজেপি শাসিত আর এক রাজ্য গোয়ায় আসেন তাঁরা। পরে আরও দু’জন শিবসেনা বিধায়ক শিন্ডেকে তাঁদের নেতা হিসাবে স্বীকৃতি দেন। মহারাষ্ট্রের তৎকালীন রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ারি তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীকে আস্থা ভোটে গিয়ে শক্তি পরীক্ষা করতে বলেন। সুপ্রিম কোর্টে উদ্ধব আস্থা ভোট স্থগিত করার আর্জি জানালেও, শীর্ষ আদালত তা খারিজ করে দেয়। ইস্তফা দেন বালাসাহেব ঠাকরের পুত্র উদ্ধব।
জুলাই মাস জুড়েই শিবসেনায় ভাঙন চলতে থাকে। গত বছর বাদল অধিবেশনে দলের ১৮ জন সাংসদের মধ্যে ১২ জন শিন্ডে শিবিরের অংশ হতে চেয়ে আবেদন জানান স্পিকার ওম বিড়লার কাছে। যদিও বিজেপির সমর্থন নিয়ে ৩০ জুন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হন শিন্ডে। উপমুখ্যমন্ত্রী হন বিজেপির দেবেন্দ্র ফডণবীস।
গত বছরের পরিস্থিতির সঙ্গে এই বছরের পরিস্থিতিকে মেলাতে পারছেন অনেকেই। এ বারও কার্যত গোপনে এনসিপির পরিষদীয় দলের সিংহভাগ সদস্যকেই ভাঙিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন অজিত। ছগন ভুজবলের মতো প্রবীণ নেতা কিংবা দলের নয়া কার্যকরী সভাপতি প্রফুল পটেলও অজিতের সঙ্গে আছেন বলে মনে করা হচ্ছে। অজিত শিবিরের একটি সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, ৫৩ জন বিধায়কের মধ্যে ৪৩ জনের সমর্থন রয়েছেন অজিতের দিকে। সে ক্ষেত্রে সংখ্যার নিরিখে দলের ঘড়ি প্রতীকের দাবিদার হয়ে উঠতে পারে অজিত শিবিরই। এই প্রসঙ্গে অজিত বলেন, “এনসিপির নাম এবং প্রতীক ব্যবহার করেই আমরা ভবিষ্যতে নির্বাচনে লড়াই করব।” তাঁরাই যে ‘প্রকৃত’ এনসিপি, সে দিকেই অজিত ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
ঘটনাচক্রে, শিবসেনার প্রকৃত স্বত্বাধিকারী কারা, এই নিয়ে দ্বন্দ্বের মাঝেই গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দেয়, ‘শিবসেনা’ নাম এবং নির্বাচনী প্রতীক তির-ধনুক ব্যবহার করতে পারবে শিন্ডেগোষ্ঠীই। কমিশন জানায়, অস্থায়ী প্রতীক নিয়ে এবং শিবসেনা (বালাসাহেব উদ্ধব ঠাকরে) নিয়ে নির্বাচনে লড়তে পারবেন উদ্ধবরা।
এর আগে গত এপ্রিল মাসে যখন অজিত মহারাষ্ট্র সরকারে যোগ দেবেন বলে জল্পনা ছড়িয়েছিল, তখন শিন্ডে বিজেপির উদ্দেশে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, তেমন কিছু ঘটলে তিনি বিজেপি-সঙ্গ ত্যাগ করবেন। তিন মাস পর জল্পনা যখন সত্যি হল, তখন অবশ্য শিন্ডে অজিতকে নিজের সরকারে স্বাগত জানিয়ে জানান, এ বার ট্রিপল ইঞ্জিন সরকার হল মহারাষ্ট্রে। বিজেপির তেঁতুলপাতায় শিবসেনা এবং এনসিপিকে ‘সুজন’ বানানোর পিছনেও পদ্মশিবিরের শীর্ষ নেতৃত্বের সূক্ষ্ম কূটকৌশল দেখছেন অনেকে।
শিবসেনার বিদ্রোহীদের দাবি ছিল, উদ্ধব শিবসেনা প্রতিষ্ঠাতা বালাসাহেবের হিন্দুত্বের সঙ্গে আপস করে কংগ্রেস এবং এনসিপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসা আঞ্চলিক দল এনসিপির ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন আদর্শগত কোনও বন্ধন নেই। তবে দেশের প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসাবে পওয়ার এই মুহূর্তে বিজেপি বিরোধী অন্যতম রাজনৈতিক মুখ। তিনি কী ভাবে এই বিদ্রোহ সামাল দেন, তা-ই এখন দেখার। ২০১৯ সালেও এক বার দলের নির্দেশ অমান্য করে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন অজিত। এনসিপির একটি অংশ মনে করছে, তখন থেকেই বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে দিয়েছিলেন অজিত। বিষয়টি টের পেয়েই পওয়ার এনসিপিতে ক্রমশ অজিতের ডানা ছাঁটছিলেন কি না, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছিল। দুই বিদ্রোহেই অবশ্য চূড়ান্ত ফলাফল জানা যায়নি। তবে রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ মনে করছেন আপাতত মহারাষ্ট্রে বিরোধী শিবিরকে আরও ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে রয়েছে বিজেপিই। ২০২৪ সালেই দেশে লোকসভা নির্বাচন এবং মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে বিরোধীরা কিস্তিমাত করতে পারে কি না, তা-ই এখন দেখার।