নীতীশ কুমার। —ফাইল চিত্র।
বিজেপি বিরোধী জোট ইন্ডিয়া গড়তে বড় ভূমিকা ছিল নীতীশ কুমারের। কিন্তু গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে সেই নীতীশই এখন ফের এনডিএ-তে যোগদান করতে পারেন, এমনই গুঞ্জন শুরু হয়েছে পটনার রাজনীতিতে। তাই বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে নিজেদের জোটে ধরে রাখতে উদ্যোগী হয়েছে কংগ্রেস। নীতীশ ও আরজেডি সভাপতি লালুপ্রসাদ যাদবের সঙ্গে কথা হয় কংগ্রেস নেতৃত্বের। তারপরেই ঠিক হয় বুধবার ভার্চুয়াল বৈঠক করবেন বিরোধী জোটের নেতারা। সেই বৈঠকেই নীতীশকে জোটের কোনও বড় পদে বসানোর কথা ঘোষণা করা হবে, এমনই সিদ্ধান্ত হয় তিন দলের আলোচনায়। কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’র সেই ভার্চুয়াল বৈঠক শেষ মূহূর্তে বাতিল হয়ে গেল।
বুধবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় রাজনীতির কারবারিরা জানতে উৎসুক ছিলেন যে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া নেতৃত্বের ভার্চুয়াল বৈঠকের কী ফল হয়। কিন্তু পরে জানা যায়, জোটের বৈঠক হচ্ছে না। বৈঠক পিছিয়ে গিয়েছে। বৈঠকের দিনক্ষণ পরবর্তী সময়ে জানানো হবে। পটনায় বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব বৈঠক পিছিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে দেন। সূত্রের খবর, জোটের বেশির ভাগ নেতা বৈঠকে যোগদান করতে চাননি। তাই বৈঠক ভেস্তে গিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে ভার্চুয়াল বৈঠকে কেন যোগদান করলেন না বিজেপি বিরোধী দলের নেতারা? যে জোটে মোট ২৮টি রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে, সেখানে বছরের শুরুতেই কেন ইতিবাচক মন নিয়ে বৈঠকে শামিল হতে পারলেন না রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফারুক আবদুল্লারা?
জোটে থাকা একটি দলের নেতা জানাচ্ছেন, বিহারে জোটের অন্যতম শরিক জেডি (ইউ) কংগ্রেসের হাতছাড়া হওয়ার পথে। নীতীশ ইতিমধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করেছেন বিহার সরকারের দুই শরিক কংগ্রেস ও আরজেডির সঙ্গে। সম্প্রতি লালু-তেজস্বী ঘনিষ্ঠ জেডি (ইউ)-এর জাতীয় সভাপতি লল্লন সিংহকে তাঁর পদ থেকে সরিয়েছেন নীতীশ। আবার ২২ জানুয়ারি রামমন্দিরের উদ্বোধনের আমন্ত্রণপত্রও তাঁর বাসভবনে পাঠানো হয়েছে। আরও সব অভ্যন্তরীণ সমীকরণের চিত্র দেখেই কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের ধারণা, আবারও শিবির বদল করে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-তে যোগ দিতে পারেন নীতীশ। তাই তড়িঘড়ি বৈঠক ডেকে জোটের কোনও বড় পদ দিয়ে নীতীশকে ধরে রাখতে চায় কংগ্রেস। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এই বৈঠক তলব করা হয়েছিল।
একটি সূত্র জানাচ্ছে, বৈঠকের যৌক্তিকতা বোঝানো হয়নি কোনও শরিককে। একমাত্র শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরেই বৈঠকে হাজির হওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রথমে বৈঠকের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে শরদ পাওয়ারের এনসিপি। একে একে কংগ্রেসের নীতীশকে ধরে রাখতে এই চটজলদি বৈঠকের আয়োজন করাকে ভাল চোখে দেখেনি জোটের অন্য শরিকদলগুলি। তাই একেবারে শেষ মুহূর্তে বৈঠক বাতিল করতে হয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বকে।
তবে নীতীশকে হাতছাড়া করার দায় বিরোধী জোটের নেতাদের বলেই মনে করছে জাতীয় রাজনীতির কারবারিদের একাংশ। তাদের ব্যাখ্যায়, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে জোট গঠন করতে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী ছিলেন নীতীশ। দেশের প্রায় সব বিরোধী নেতার কাছে গিয়ে নিজেই জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন তিনি। কলকাতায় উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বীকে নিয়ে এসে নবান্নে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন। জোটের নামকরণ না হলেও, জোটের প্রথম বৈঠক হয়েছিল নীতীশের শহর পটনাতেই। এত পরিশ্রম করলেও, জোটে তাঁকে যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি বলেই অভিযোগ জেডি (ইউ)-র। একটা সময় পর্যন্ত জোটের আহ্বায়ক হওয়ার আশায় ছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সেই আশাও পূরণ হয়নি তাঁর। ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে বিরোধী জোটের বৈঠকে আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মমতা ও আপ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়াল প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে কংগ্রেস সভাপতি তথা দলিত নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গের নাম প্রস্তাব করায় ক্ষোভ জন্মেছে নীতীশের মনে। এমনকি, বৈঠকে তাঁর হিন্দিতে করা বক্তৃতার সময় তা ইংরেজিতে অনুবাদ করা নিয়েও বিবাদ হয়েছিল। তাই নীতীশের মন আবারও বিজেপিমুখী। আর সেই প্রবণতা ঠেকাতেই তাঁকে জোটের কোনও বড় পদে বসাতে চায় কংগ্রেস। কিন্তু অন্য বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কংগ্রেসে এই প্রত্যাশা পূরণে আগ্রহী নয় বলেই বৈঠক বাতিল হয়েছে— এমনটাই মত জাতীয় রাজনীতির কারবারিদের একাংশের।
পটনার রাজনীতির কারবারিদের একাংশের মতে, নীতীশ বিরোধী জোটের নেতাদের আচরণে যেমন খুশি নন, তেমনই বিহারে আর কংগ্রেস ও আরজেডির সঙ্গে সরকার চালাতেও তাঁর আগ্রহ নেই। সূত্রের খবর, পৌষ মাস শেষ হলেই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছোটছেলে তেজস্বীকে ছেড়ে দিতে হবে, এমনই শর্ত নীতীশকে দিয়েছেন লালু। তাই বিজেপির ঘরে ফেরাকেই শ্রেয় বলে মনে করছেন নীতীশ। আর জোটের শরিক-সহ আরও একটি রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতা দখল রুখতে চাইছে কংগ্রেস। কিন্তু সেই কারণে কংগ্রেসের দাবি মানতে নারাজ বিজেপি বিরোধী জোটে থাকা দলগুলি।