Telangana Assembly Election 2023

কংগ্রেসের উইকেট নিতে বল করছেন ওয়েইসি

আপাতত এখানে সব রোমাঞ্চের শুরু ও শেষ ভোটেই! আধা খেঁচড়া বাড়িটির নাম মেমন সেন্টার। সামনেই আবর্জনার স্তুপ।

Advertisement
অগ্নি রায়
হায়দরাবাদ শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:১৫
Asaduddin Owaisi

আসাদুদ্দিন ওয়েইসি। —নিজস্ব চিত্র।

এই পাড়াটি এমনিতেই খুব মনমরা। হাইটেক প্রযুক্তির দ্রুতি নেই শহরের একাংশের মতো। আবার বেগম বাজার, চারমিনারের খানদানি রোশনাই-ই বা কোথায়! এ হেন ম্লান আঘাপুরার 'নামপল্লি' মহল্লায় খোঁজের পর সেই ত্রিতল নির্মীয়মাণ বাড়িটি পাওয়া গেল। ছাদ ঢালাই হয়নি, লোহার শিক যত্রতত্র। তার মধ্যেই মঞ্চ, মাইক, ফুল। এক ঝলক দেখলে মনে হয়, এখান থেকেই ওটিটি-র কোনও থ্রিলার শুরু হবে!

Advertisement

আপাতত এখানে সব রোমাঞ্চের শুরু ও শেষ ভোটেই! আধা খেঁচড়া বাড়িটির নাম মেমন সেন্টার। সামনেই আবর্জনার স্তুপ। অটো পার্টসের দোকান, মোবিলের গন্ধ পেরিয়ে প্রায় প্রতিটি গলিতে ঢুকে হাতজোড় করে ভোট চেয়ে আবর্জনা টপকে এসেছেন দীর্ঘদেহী আসাদুদ্দিন ওয়েইসি। যাঁর অনুমতি ছাড়া নাকি এখানে একটি পাতাও নড়ে না। এমআইএম-এর সর্বাধিনায়কের একটি হাত প্রকাশ্যেই ধরা রয়েছে কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের। অনেকে বলছেন, অন্য হাতটি ছোঁয়া আছে বিজেপি-র পদ্মে। অসম্ভব পরিশ্রম করছেন নিজের হাতে গোনা কয়েকটি (অন্তত সাতটি) আসন ধরে রাখতে। রোজ ছ’ঘণ্টা পদযাত্রা, তিন ঘণ্টা বিভিন্ন মুসলিম গোষ্ঠীর সঙ্গে মজলিশ, রাতে জনসভা অন্তত দু’টি। দীর্ঘ চাপকানের পকেটে রাখা খেজুর বের করে জ্বালানি নিচ্ছেন মাঝেমধ্যে।

‘‘এখানে আর কী কথা হবে, আপনি চট করে এক বার দার-এস-সালাম-এ আসুন, এখান থেকে খুব কাছেই।’’ উনি যে তাঞ্জানিয়ার কথা বলছেন না, বলছেন তাঁর নিজের অফিসের কথা, সেটা ওঁর সহকারী বুঝিয়ে দিলেন! কী ভাবে যেতে হবে সেটাও। মালা আর শাল তখন ঢেউয়ের মতো ধেয়ে আসছে ওয়েইসির দিকে। বাচ্চা কোলে মায়েরা এসেছেন তাঁর দোয়া নিতে। ওই আধা তৈরি হওয়া চারদিক খোলা বাড়িটি কখন যেন লোকারণ্য হয়ে গিয়েছে।

'হায়দরাবাদ হালাই মেমন জামাত'-এর আয়োজনে এই পাড়ার মজলিশ করা হয়েছে ‘নকিব-ই-মিল্লাত ব্যারিস্টার জনাব’ আসাদুদ্দিন ওয়েইসি সাহাবের জন্য। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে কংগ্রেসকে একহাত নিয়েছেন ওয়েইসি। বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস দেখছি অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু কখনও ওরা কথা রাখে না। হিন্দু মেয়ের বিয়েতে কংগ্রেস সোনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু মুসলিম নিকা নিয়ে মুখে কুলুপ।’’ রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পগুলি তাঁর দল কী ভাবে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসা, বৃত্তি, নিকাশির কাজ করেছে, সে কথাও জানালেন। নিজেদের উদ্যোগে ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য ভবন তৈরি হয়েছে, দাবি করলেন। মুসলিম ছাত্রদের বিদেশ পাঠানো, বেতনের ব্যবস্থা করেছে এমআইএম —এমনটাই তাঁর পরিসংখ্যান-সহ প্রচার।

কিন্তু এহ বাহ্য। দার-এস সালামের প্রকান্ড কম্পাউন্ডে (যার ভিতরে ইডেন গার্ডেনের সমান একটি মাঠ ছাড়াও রয়েছে তাঁর নামাঙ্কিত চিকিৎসা কেন্দ্র এবং পত্রিকার দফতর) নিজের মহার্ঘ্য ঝাড়বাতিশোভন ঘরে ওয়েইসিকে একা পেয়ে সেই প্রশ্নটি করে ফেলা গেল, যা সংসদে কখনও করা যায় না।

‘‘অনেকেই বলছেন, আপনি কংগ্রেসের বিরোধিতা করে আসলে কেন্দ্রে বিজেপি-র সুবিধাই করে দিচ্ছেন। বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে সংখ্যালঘু ভোট ভাগ করে দিচ্ছেন। কী বলবেন এই অভিযোগের উত্তরে?’’ রাজ্য সরকারের সাহায্যে গত কয়েক বছরে মুসলিমদের কী কী উন্নয়ন হয়েছে তার একটি লিঙ্ক মোবাইলে খুঁজছিলেন ওয়েইসি। এই প্রশ্নের উত্তরে কোনও ভাবান্তর হল না বরং আরও মনোনিবেশ করলেন স্ক্রিনে। একটি গ্রাফিক বের করে বললেন, ‘‘ছবি তুলে নিন।’’

ছবি তুললাম। সঙ্গে প্রশ্নটি আবার করতে হল। এ বার যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে একটানা বলে গেলেন, যা ঠিক উত্তর নয় বরং উত্তরের চারপাশ দিয়ে কৌশলী বৃত্তপাক। ‘‘আজ যে নরেন্দ্র মোদী দু'বার প্রধানমন্ত্রী হলেন, তার জন্য দায়ী কে? অবশ্যই কংগ্রেস। কংগ্রেসের অপদার্থতার জন্য আজ বিজেপি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। গত লোকসভা ভোটে তেলঙ্গানায় ১৭টি আসনের মধ্যে মাত্র তিনটি পেয়েছে কংগ্রেস। তার জন্য কে দায়ী? মুসলমানরা কংগ্রেসকে আর বিশ্বাস করে না। ওরা মিথ্যা কথা বলে। আমি তো কংগ্রেস এবং বিজেপি-র মধ্যে কোনও তফাৎ দেখি না। আমি তাই ডাক দিয়েছি, যে ন'টি আসনে আমরা লড়ছি তার বাইরে প্রত্যেকটি আসলে বিআরএস প্রার্থীকে মানুষ ভোট দিন। হিন্দু মুসলিম নির্বিচারে।’’

আবারও জানতে চাইলাম, ‘‘শুধু তেলঙ্গানাতেই তো নয়, আপনি বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিচ্ছেন।’’ এ বার তিনি কিছুটা খোলসা। বলছেন, ‘‘আমি কী করব বলুন তো? রাহুল গান্ধী নিজে তেলঙ্গানায় দাঁড়িয়ে জনসভায় বলেছেন বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার দরজা ওয়েইসি এবং কেসিআর-এর জন্য বন্ধ। আমরা তাই নিজেদের মতো করে পরিশ্রম করছি। আর বিজেপি-কে সাহায্যের কথা বলছেন! এটা তো আমরা ভাল
করেই জানি, বিজেপি এমন একটা দল যারা কাউকে ছাড়ে না। কাউকে সঙ্গে নেয় না।’’

তেলঙ্গানার রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশ্নটা 'সঙ্গে নেওয়ার' নয়। বরং শান্ত রাখার। গত কয়েক বছর হায়দরাবাদে মুসলিমরা একপ্রকার শান্তিতেই রয়েছেন খেয়ে পরে। এমনকি, পুরনো শহর থেকে বেরিয়ে এসে অনেকেই নতুন শহরের উন্নয়নের সুফল কুড়াচ্ছেন। শহরে কোনও সাম্প্রদায়িক অশান্তির খবর নেই। হলেও কয়েকটি জেলায় খুবই সামান্য। ওয়েইসি এবং বিজেপি-র পারস্পরিক নিখুঁত বোঝাপড়া না থাকলে এটা অসম্ভব ছিল। তেলঙ্গানার মোট ১১৯টি বিধানসভার আসনের মধ্যে মাত্র সাত বা আটটি নিয়ে যদি খুশি থাকেন ওয়েইসি, তা হলে বাকি রাজ্যের মুসলিম বৃত্তে তাঁকে কাজে লাগানো বিজেপি-র জন্য লাভজনক। এ একরকম শান্তি কিনে রাখা। আরও এটাও মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ওয়েইসি তাঁর নিজের রাজ্যে লড়ছেন মাত্র ন’টি আসনে। কিন্তু অন্য রাজ্যে গিয়ে, যেখানে আসন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, সেখানে অধিক আসনে প্রার্থী দিতে দেখা
যাচ্ছে তাঁকে।

আপাতত ন'টির মধ্যে সাতটি আসনে তিনি মনে করছেন, জয় নিশ্চিত। জুবিলি হিল-এ মহম্মদ আজহারউদ্দিনকে হারানোর প্রশ্নেও ওয়েইসি আত্মবিশ্বাসী। "ওর ব্যাটিং দেখতে খুবই ভাল লাগত। কিন্তু ওই পর্যন্ত। টাকার লোভ আজহারকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে আমি জানি। ওর দুই ভাই আমার খুবই বন্ধু।" এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখলেন, তিনিও বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত নিয়মিত মিডিয়াম পেস বোলিং করে গিয়েছেন!

আপাতত যাঁর কাছে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান একজনই। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।

Advertisement
আরও পড়ুন